হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র বায়তুল হিকমাহ
নবম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বায়তুল হিকমাহ সর্ববৃহৎ বইয়ের ভা-ার এবং যুগের অন্যতম জ্ঞানবিকাশ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়। অসংখ্য আরব-অনারব মেধাবী বায়তুল হিকমাহর প্রতি আকৃষ্ট হন। মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ভর্তি করা হতো। বায়তুল হিকমাহর মতো জ্ঞানবিকাশ কেন্দ্র তৎকালীন যুগে জ্ঞানচর্চার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে
ইশতিয়াক আহমাদ
বাগদাদকে বলা হতো জ্ঞান-বিজ্ঞান উৎপাদনের কারখানা। প্রায় ১ হাজার ২০০ বছর আগে মুসলিম খলিফাদের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদ শহরÑ যেখানে ধর্ম, বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, আলকেমি, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল, মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যা থেকে শুরু করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা নিয়ে চর্চা করা হতো। প্রায় ৫০০ বছর বাগদাদ ছিল খেলাফতের রাজধানী। এ শহরেই প্রতিষ্ঠিত হয় জগদ্বিখ্যাত পাঠাগার ও জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র ‘বায়তুল হিকমাহ’ বা ঐড়ঁংব ড়ভ ডরংফড়স। এটিকে ইসলামের সোনালি যুগের একটি প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি ছিল একাধারে একটি গ্রন্থাগার, অনুবাদ কেন্দ্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
খলিফা হারুনুর রশিদ (৭৮৬-৮০৯) এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার ছেলে খলিফা মামুনের সময় এটি সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে। খলিফা হারুনুর রশিদ পৃথিবীর সব মূল্যবান বইপত্র এখানে সংগ্রহ করে রাখতেন। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সব মুসলিম প-িত ও স্কলারকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বায়তুল হিকমায় নিয়ে আসতেন। রাষ্ট্র তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করত। খলিফার পক্ষ থেকে স্কলারদের নতুন নতুন বইপত্র সংগ্রহ করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হতো। বায়তুল হিকমাহর প-িতরা সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হতেন।
বায়তুল হিকমাহর গবেষকরা বিভিন্ন বিষয়ে মৌলিক গবেষণা পরিচালনা করতেন। বিখ্যাত গণিতবিদ আল খাওয়ারেজামি বায়তুল হিকমায় গবেষণা করে বীজগণিতের ওপর ব্যাপক অবদান রাখেন। এখানে কর্মরত থাকার সময় তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুল জাবর’ রচনা করেন। এছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানেও বায়তুল হিকমাহর প-িতদের অবদান অনস্বীকার্য। এখানকার গবেষক মুহাম্মদ জাফর ইবনে মুসা, মুহাম্মাদ মুসা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের বিশ্বজনীনতার কথা প্রথম বলেন। পরবর্তীতে ১০ শতকে আল হাসান আলোক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বেশকিছু পরীক্ষা সম্পাদন করেন, যা এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে হুনায়ন ইবনে ইসহাক চক্ষূরোগ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও গবেষণাপত্র রচনা করেন। আরও প-িতরা গুটিবসন্ত সংক্রমণ ও অস্ত্রোপচার নিয়ে বিশদ গবেষণা করেন এবং গ্রন্থ রচনা করেনÑ যা পরবর্তীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের আদর্শ পুস্তক হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
শুধু আরবি ভাষা নয়, বরং বিভিন্ন ভাষার কয়েক লাখ বইপত্র এ বিশ্বখ্যাত গ্রন্থাগারে স্থান পেয়েছিল। অন্যন্য বিভিন্ন ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ করা হতো। লেখকদের সম্মানী হিসেবে দেয়া হতো বইয়ের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্নমুদ্রা। পিথাগোরাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সক্রেটিসসহ নানা ভাষার বিখ্যাত জ্ঞানী-প-িতের লেখা অনুবাদ করে বায়তুল হিকমাহর সংগ্রহকে আরও সমৃদ্ধ করা হয়। খলিফা আল মামুনের সময় বায়তুল হিকমাহর অর্থনৈতিক সুবিধা ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আব্বাসীয়রা এ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করে বায়তুল হিকমাহর পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসে। বাগদাদের ব্যবসায়ী ও সামরিক বাহিনীও এতে সাহায্য করে। বায়তুল হিকমাহ তৎকালীন যুগে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বেশি অবদান রাখে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বায়তুল হিকমাহর উপকারিতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। খলিফা আল মামুন ব্যক্তিগতভাবে বায়তুল হিকমাহর প্রতিটি কাজে যুক্ত থাকতেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন।
নবম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বায়তুল হিকমাহ সর্ববৃহৎ বইয়ের ভা-ার এবং যুগের অন্যতম জ্ঞানবিকাশ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়। অসংখ্য আরব-অনারব মেধাবী বায়তুল হিকমাহর প্রতি আকৃষ্ট হন। মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ভর্তি করা হতো। বায়তুল হিকমাহর মতো জ্ঞানবিকাশ কেন্দ্র তৎকালীন যুগে জ্ঞানচর্চার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সে সময় পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় ধাঁচের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। বায়তুল হিকমাহর পথ ধরে নবম শতকে বিভিন্ন শহরে মক্তব গড়ে উঠতে থাকে। উচ্চশিক্ষার জন্য মক্তবগুলোকে উচ্চবিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এগারোশ শতকে নিজামুল মুলক মাদরাসা নিজামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইরাকের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
আল মামুনের উত্তরাধিকারী আল মুতাসিম (৮৩৩-৮৪২) ও তার ছেলে আল ওয়াসিকের সময়কালেও বায়তুল হিকমাহর সৌকর্য বজায় রাখে। কিন্তু আল মুতাওয়াক্কিলের (৮৪৭-৮৬১) আমলে এর অবনতি শুরু হয়। ১২৫৮ সালে সর্বশেষ বর্বর হালাকু খানের অবরোধের সময় বাগদাদের অন্য লাইব্রেরির মতো বায়তুল হিকমাহও ধ্বংস করে দেয়া হয়। নাসিরুদ্দীন তুসীর তৎপরতায় প্রায় ৪০ হাজার পা-ুলিপি রক্ষা পায়, যা তিনি অবরোধের আগেই মারগোহে নিয়ে যান। কয়েক লাখ বই ও পা-ুলিপি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। প্রচলিত আছে হালাকু খানের ধ্বংসযজ্ঞের পরবর্তী ৬ মাস দজলা ও ফোরাত নদীর পানি বইয়ের কালিতে কালো হয়ে ছিল। করুণ সমাপ্তি ঘটে বিশ্বখ্যাত এক জ্ঞানকেন্দ্রের। পরিতাপের হলেও সত্য, মুসলিম জাতি পরে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় আর সেভাবে নেতৃত্বে আসতে পারেনি, যা উম্মাহকে বিশ্বনেতৃত্ব থেকেই পিছিয়ে দিয়েছে।