জাকির হোসাইনঃ বাজানরে হাওর নিজেও মরছে, আমরারেও মারছে। অহন, জীবন বাঁচাইতে যুদ্ধে নামছি। সারাদিন কাজ করে যা কামাই সেইটা দিয়া ঠিকমতো খাইতেও পারি না। আর অহন তো চালের বাজারে আগুন লাগছে। আমরা খামু ক্যামনে। আমাগো কথা তো কেউ চিন্তা করে না।’ কথাগুলো তেজকুনিপাড়ার আমজাদ হোসেনের। গতকাল কাওরানবাজারে চাল কিনতে এসে তিনি এমনই মন্তব্য করেন। কিছুদিন ধরেই চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। চালের বাড়তি দামের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস। ৪৬ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সরকারি হিসাব অনুযায়ীই গত এক মাসে সাধারণ মানের মোটা চালের দাম বেড়েছে আট শতাংশের বেশি। আর এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। গতকাল রাজধানীর মালিবাগ বাজার, কাওরান বাজার, খিলগাঁও বাজার, মোহাম্মদপুরসহ আরো কিছু বাজার ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের ক্ষোভের কথা। চালের বাড়তি দাম নিয়ে ব্যবসায়ীরা অজুহাত দিচ্ছেন হাওরে বন্যার পানিতে সব ভাসিয়ে নিয়েছে। এবার ফলন ভালো হয়নি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কাঞ্চন আলী বলেন, হাওরে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই অজুহাতে চালের বাজার এতো ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কথা না। মিল মালিকদের দুর্নীতির কারণে এরকম অবস্থা। তারা চাল স্টক করে রেখে দেয়ার কারণে বাজারে চালের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজিব উদ্দিন সিদ্দিক বলেন, আমরা অল্প আয়ের মানুষ। মাসে যে টাকা বেতন পাই খরচ তার চেয়ে অনেক বেশি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, বাসাভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে গতিতে বাড়ছে সে তুলনায় আমাদের আয় তো বাড়ছে না। দুদিন আগে যে চালের বস্তা কিনতাম ২০০০-২২০০ টাকায় এখন সে বস্তা কিনতে হয় ২৬০০-২৭০০ টাকায়। তিনি বলেন, আমরা মধ্যবিত্তদের টিকে থাকা কঠিন। আড়ং ডেইরি ফার্মের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ ফজলুর রহমান বলেন, ৩৫ টাকা দিয়ে যে চাল কিনতাম ক’দিন আগে এখন সেই চাল ৫২ টাকা দিয়ে কিনছি। এবং ৪০-৪৫ টাকার চাল ৫৮-৬০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। সবকিছু সিন্ডিকেটের কারণে হচ্ছে। ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, বন্যার কারণে হাওরে ধান উৎপাদন ঠিকমতো হয়নি। তবে আমি এটা মনে করি না। কারণ বন্যা সারা দেশে হয় নাই। কিছু অসাধু আড়তদার এই কাজ করে। তারা পরিকল্পনা করে গুদামে চাল স্টক করে রাখে। আর বাজারে চালের অভাব দেখায়।
ভ্যানচালক আফজাল বলেন, আগে চালের সঙ্গে ডিম, মাছ, সবজি কিনতাম। এখন আর মাছ, ডিম কেনা হয় না। কারণ চালের বাজারে আগুন। মোটা চাল কিনতে হলে ৪৬ টাকা লাগে। মিন্তি নাজমুল বলেন, ভাতের উপরই আমরা নির্ভরশীল। কষ্টের কাজ করি। দিনে তিনবেলা ভাত খেতে হয়। কিন্তু চালের দাম যেভাবে বাড়ছে এখন আর তিনবেলা খেতে পারবো না। চাবি তৈরির কারিগর আমির হোসেন জানান, আমি তেমন বাজারে যাই না। কিন্তু আমার বড়ভাই প্রতিদিন বাসায় এসে চালের দাম নিয়ে আলাপ করে। আমার পরিচিত অনেকেই বলাবলি করছে। তিনি বলেন, সবাই আন্দাজ করছে মিলের মালিকরা কারসাজি করে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বাজারে চালের দাম যেভাবে বাড়ছে এভাবে চলতে থাকলে আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাবো? এমনিতেই অল্প আয় দিয়ে আমাদের পরিবার চলে। তার উপর যদি নিত্যপণ্যের দাম এতো বাড়ে আমরা বাঁচবো কিভাবে?