হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইসলাম ছাড়া অন্যান্য অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তারাই ভোগের একচেটিয়া অধিকার পায়। উৎপাদনে অক্ষম লোকদের জন্য সেসব অর্থব্যবস্থায় সম্পদের যে অংশ রয়েছে, তা হলো বিত্তশালীদের করুণা। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে যারা অক্ষমতার দরুন উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না, তাদের জন্যও সম্পদের একটি হিস্যা রয়েছে। অক্ষম, গরিব ও অসহায় লোকদের জন্য ধনীদের সম্পদে যে অনিবার্য অংশ রাখা হয়েছে, তা-ই জাকাত। জাকাত কিছুতেই অনুদান নয়। জাকাত ফরজ হতেই ধনীরা যেন গরিবদের কাছে ঋণী হয়ে গেল। ঋণের ক্ষেত্রে তার পাওনাদারকে খুঁজে বের করে অথবা তার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসা তার কর্তব্য। তা দিয়ে না আসা পর্যন্ত সে দায়মুক্ত হয় না, তেমনি জাকাতদাতাও এর হকদারের কাছে ঋণী থাকে। জাকাতে নগদ অর্থ হাতবদল হয়। সম্পদে গতিশীলতা আসে। মানুষ ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করে। ভোক্তা সৃষ্টি হয়। ক্রেতা সৃষ্টি হলে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়। প্রতিষ্ঠা হয় শিল্প-কারখানা। তৈরি হয় কর্মসংস্থান।
বংলাদেশ জাকাতে সমৃদ্ধ হওয়ার অপার সম্ভাবনার এক দেশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে আদায়যোগ্য জাকাতের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমান বাংলাদেশে ১ লাখ ১৯ হাজার ৩৬১ জন কোটিপতি আছেন। (মানবজমিন : ২৫-১১-২০১৬)। তাদের কেউ তো হাজার কোটি টাকার মালিক, কেউ ১ লাখ কোটি টাকার মালিক। তাদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থানায় জাকাত আদায় করলে দারিদ্র্য বাংলাদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশে জাকাতদাতার পরিমাণও কম নয়। কিন্তু এর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা নেই। জাকাত আনতে গিয়ে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। স্বধীনতার পর থেকে ৩ শতাধিক লোক মারা গেছেন জাকাত আনতে গিয়ে। ২ বছর আগে ময়মনসিংহে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল জাকাত আনতে গিয়ে। প্রতি বছরই দীর্ঘ হচ্ছে ‘জাকাতের কাপড়’ আনতে গিয়ে নিহত মানুষের তালিকা। স্বাধীনতার পর থেকে ৩ শতাধিক মানুষ জাকাত আনতে গিয়ে মারা গেলেও ৩০০ পরিবারকে কি দারিদ্র্যমুক্ত করা গেছে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক জাকাত ব্যবস্থা থেকে? ‘জাকাতের শাড়ি’ বণ্টন করার জন্য বেছে নেয়া হয় সরু জায়গা। ঠেলাঠেলিতে যত আহত-নিহত তত নাম! শাড়ি দিয়ে গরিবের উপকার করার সদিচ্ছা থাকলে ঢাকঢোল পেটানোর কী প্রয়োজন? একটি এলাকার গরিবদের তালিকা করে তাদের ঘরে পৌঁছে দেয়া দুরূহ নয় নিশ্চয়ই। ‘জাকাতের শাড়ি’ কতটা উপকারে আসে? দেখা যায়, একেকজন গ্রহীতা ১০টির মতো কাপড় পাচ্ছেন। জাকাতদাতা হয়তো অর্ডার দিয়ে ২০০ টাকায় নিম্নমানের কাপড় কিনছেন আর গ্রহীতা তা ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি করছেন। এর চেয়ে ২০০ টাকা দিয়ে দিলেই তো ভালো ছিল। না, তাতে তো ‘দানবীর’ হিসেবে প্রচারটা কম হয়ে যায়। শ’খানেক কাপড় দিয়েই যদি ‘দানবীর’ হিসেবে প্রচারণা দেয়া যায় তাতে ক্ষতি কী! এ তো জাকাত নয়। এটি হলো ধনাঢ্যদের আত্মপ্রচারের মাধ্যম। জাকাতের কাপড় না দিয়ে জাকাতের গাড়ি, রিকশা, জাকাতের সেলাই মেশিন, জাকাতের ঠেলাগাড়ি হলে কী সমস্যা? ব্যক্তিগতভাবে জাকাত দিয়ে সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের উন্নয়নে বিশেষ কিছু করা যায় না। তাই জাকাতের মূল লক্ষ্যকে সফল করতে প্রয়োজন সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাবস্থাপনা।
জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় দারিদ্র্য জয় যে কল্পনিক নয় বরং একেবারেই বাস্তব, তা প্রমাণিত হয়েছে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গির নামে খুচরা জাকাত না দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানমূলক খাতে ব্যবহার করে অল্প সময়ের ব্যবধানেই পাঁচ হাজার পরিবারকে স্বাবলম্বিতার মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত করেছে। (দৈনিক মানবজমিন : ১১-০৬-২০১৬)। জাকাতের টাকার কোনো সুদ তো দূরের কথা, আসল টাকাও ফেরত দিতে হয় না। নেই কোনো কিস্তির চিন্তা। কর্মসংস্থানের পর মনিটরিং করলে সহজেই দারিদ্র্যকে জয় করা যায়।
বাংলাদেশে ‘জাকাত বোর্ড’ নামে সরকারি একটি জাকাতের প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা খানিকটা ‘জাকাতের কাপড়ের’ মতোই। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও দীর্ঘ ৩৫ বছরেও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দুঃখজনক হলো, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে মাত্র ২০১৩-১৪ পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের তথ্য হালনাগাদ করা। মিডিয়ার মাধ্যমে তা জনগণকে জানাবে তো দূরের কথা, নিজেদের ওয়েবসাইটেও নেই হালানাগাদ তথ্য। এ কারণে দীর্ঘ ৩২ বছরে তাদের আদায়কৃত জাকাতের পরিমাণ হলো মাত্র ১৩ কোটি টাকা। যেখানে ১ বছরে বাংলাদেশে আদায় হতে পারে ৬০ হাজার কোটি টাকা, সেখানে সরকারি জাকাত বোর্ডের ৩২ বছরে আদায় হলো মাত্র ১৩ কোটি টাকা। কে জানে তাতেই তারা মহাখুশি কিনা!
সরকারিভাবে জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা সক্রিয় করতে হলে প্রথম কাজ হবে জাকাত বোর্ডকে গণমানুষের আস্থাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। একজন দক্ষ, আমানতদার, পরিশ্রমী ও আন্তরিক ব্যবস্থাপক বা প্রশাসক এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। জাকাত বোর্ডের কর্মকর্তারাও হবেন সংশ্লিষ্ট কাজে আন্তরিক ও আমানতদার। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য শীর্ষ আলেমদের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি থাকবে জাকাত বোর্ডের কার্যক্রম কঠোরভাবে মনিটরিং করার জন্য। জাকাত বোর্ডের কার্যক্রমে অসংগতি থাকলে তা তারা শুধরে দেবেন। আলেমদের ওই কমিটি ধনী মুসলমানদের জাকাত প্রদানে উদ্বুদ্ধ করবেন। এক বছরে কতজনকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়া গেল সে তথ্য ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে বছর শেষে জনগণের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হবে। পেশ করা হবে আগামী বছরের জাকাত আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। সরকারের বাজেটেও থাকবে জাকাতের একটা অধ্যায়।
জাকাতভিত্তিক দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচির সঙ্গে সরকারি কর্মসূচির সফল সংযোগ স্থাপন হবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আয়কর ও জাকাত উভয়ই যেহেতু জনগণের কল্যাণেই ব্যবহার হয়, তাই আয়কর বিভাগ ও জাকাতের মধ্যকার সফল সমন্বয় দরকার। কোনো ব্যক্তির মোট আয়করের পরিমাণ থেকে পরিশোধিত জাকাতের পরিমাণের অর্ধেক কমিয়ে দিলে জাকাতদাতাদের আন্তরিকতা অনেক বাড়বে। এতে আয়কর কিছুটা কমলেও জাকাত আদায় অনেক গুণে বেড়ে যাবে। আর জাকাত যেহেতু রাষ্ট্রই আদায় করছে, তাই ঘুরেফিরে উপকারটা তো রাষ্ট্রেরই হবে। জানগণকে জাকাতে উৎসাহিত করতে সর্বোচ্চ করদাতাদের যেভাবে পুরস্কৃত করা হয়, সেভাবে সর্বোচ্চ জাকাতদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় জাকাত ব্যবস্থাকে সচল করলে অবহেলার গোনাহ থেকে মুক্তি পাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা; অনেকটাই সুষ্ঠুভাবে আদায় হবে জাকাত। দারিদ্র্য বাংলাদেশ থেকে চিরতরে পালাতে বাধ্য হবে।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ,
বোর্ডবাজার (আ. গণি রোড), গাজীপুর