ময়মন নেছার অন্যরকম দিন

৬৮ বছর আগে জন্ম নেয়া পাঁচ অক্ষরের একটি নাম ‘ছিটমহল’ শব্দটি আজ থেকে চিরতরের জন্য হারিয়ে যাবে মানুষের মুখ থেকে। আগামীকাল শনিবার সকালে নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে নতুন স্বপ্ন নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠবে দীর্ঘ সময় ধরে শেকলে বাঁধা মানুষগুলো। পাবে একটি নতুন ঠিকানা, পাবে নাগরিকত্ব। এতদিনের না পাওয়া বেদনাগুলো দুমড়ে-মুচড়ে মুছে ফেলে নতুন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবে তারা। তাই বাঁধ ভাঙা আনন্দে ভাসছে ছিটমহলবাসীরা। ৩১শে জুলাই, মধ্য রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্তি ঘটবে ‘ছিটমহল’ এর।
তবে ছিটমহলে এমন আনন্দের সময়েও জনগনানায় অন্তর্ভুক্ত হতে না পারার দুঃখের কথা বলেছেন, নীলফামারীর ডিমলার বড় খানগির ছিটমহলের বাসিন্দা ময়মন নেছা। ১২০ বছর বয়সী এই নারী বলেছেন, মরনের আগে যদি আমি বাংলাদ্যাশের নাগরিক অইয়া মরতে পারতাম তইলে আত্নাডা শান্তি পাইতো। নাম লয়নাই তাতে কি অইছে তারপরেওতো শ্যাখের বেডি হাসিনা আমাগো মুক্ত করছে। আল্লায় হ্যার হায়াত দারাজ করুক। আমি আমার নাতীরে কইছি আমি মইরা গ্যালে বাংলাদ্যাশের মাটিতে তর দাদার কবরের লগে আমারে কবর দিস।
১৯৭৪ সালে সম্পদিত বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি মতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১ ছিটমহল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের সঙ্গে একীভূত হবে। সেই সঙ্গে বিশেষ ওই মহলের বাসিন্দারা পাবে তাদের পছন্দমত দেশের নাগরিত্ব। দ্বিপক্ষীয় ওই চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সীমান্ত পাকাপোক্ত হবে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত। কেবল ছিটমহল সমস্যার সামাধানই নয়, ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি মতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অচিহ্নিত সীমানায় চিহ্নিত করা এবং সীমান্ত এলাকার অপদখলীয় ভূমির ন্যায্য বন্টনের বিশাল কর্মযজ্ঞও সম্পন্ন হবে আজ। ঢাকায় গতকাল ওই সব এলাকার প্রায় ৩০টি স্টিপম্যাপ সই হয়েছে। গত ২৩ ও ২৪ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত দুদিনের যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে খুঁটনাটি আলোচনার চূড়ান্ত হয় ওই খন্ড খন্ড মানচিত্রগুলো। গতকাল ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ এবং দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তাতে নিজ নিজ দেশের পক্ষে সই করেন। উল্লেখ্য ২০১১ সাল থেকে সীমান্ত এলাকার স্টিপম্যাপগুলো সই করার কাজ চলছে। গতকালের ম্যাপ সইয়ের আনুষ্ঠানিকতায় সরকারের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, ভূমি মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর এবং হাই কমিশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তির চূড়ান্ত বাস্তবায়ন আজ: এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রেরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও বাংলাদেশ- ভারত স্থল সীমানা চুক্তি এবং প্রটোকলের চূড়ান্ত বাস্তবায়েনের বিষয়ে আনুষ্টানিকভাবে জানানো হয়েছে। গতকালের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স’ল সীমানা সংক্রান্ত সমস্যাসমূহ সমাধানকল্পে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে স্বাক্ষরিত স’ল সীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪ (মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি) এবং পরবর্তীতে ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রটোকলের আলোকে ৩১শে জুলাই (আজ) মধ্য রাতে ভূমি বিনিময় সম্পন্ন বলে গন্য হবে। অর্থাৎ ৩১ জুলাইয়ের মধ্য রাত থেকে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে অবসি’ত সকল ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখন্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে অবসি’ত সকল বাংলাদেশী ছিটমহল ভারতের ভূখন্ড হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হবে। একই সাথে উভয় দেশের অপদখলীয় জমি সে দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশে নতুন ভাবে অন্তর্ভুক্ত জমি সংযুক্ত করে এবং বহির্ভূত জমি বাদ দিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট নোটিফিকেশন জারী করা হ”েছ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় বাংলাদেশের ভূখন্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ১১১টি ছিটমহলে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকার অপশন প্রদানকারীগন ব্যতীত অন্যান্য বাসিন্দাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। ভারতের অভ্যন্তরে অবসি’ত বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ৩১ জুলাই মধ্য রাত থেকে ভারতীয় ভূখন্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং এদের নাগরিকরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। আগামী ১ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশের ভূখন্ডে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ভারতের পূর্ববর্তী ১১১ টি ছিটমহলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে বলেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। ওই চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ঢাকার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ২০১১ সালের ছিটমহলে সবৃশৈষ পূণাঙ্গ জরীপ হয়। সেখানে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর এবং জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৮৩ জন এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে আয?তন ৭ হাজার ১১০ দশমিক শূন্য ২ একর এবং লোক সংখ্যা ১৪ হাজার ৯০ জন পাওয়া গিয়েছিল। চলতি মাসে একটি জনগণনা হয়েছে। সেখানে জনসংখ্যা বেড়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে ভারতের কাছ থেকে ১৭ হাজার একর জমি বাংলাদেশের অধিকারে আসবে, বিনিময়ে ভারত পাবে সাত হাজার একর। এছাড়া ভারত বাংলাদেশকে দুই হাজার ২৬৭ একর জমি হস্তান্তর করবে এবং বাংলাদেশ ভারতকে দেবে দুই হাজার ৭৭৭ একর জমি। বাংলাদেশের সঙ্গে একীভূত ভারতের ১১১ ছিটমহলের ৯৭৯ জন ভারতের নাগরিত্ব চেয়েছেন। বাকীরা প্রায় ৪৪ হাজার বাংলাদেশের নাগরিত্ব পাবেন। ভারদের সঙ্গে একীভূত বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহলের কেউই বাংলাদেশে আসছেন না। কর্মকর্তারা জানান, মধ্য রাতে আলো জ্বালিয়ে ছিটমহল হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে ১৬২ ছিটমহলের বাসিন্দারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘ ৬৮ বছর অবরুদ্ধ জীবনের অবসানে ছিটমহলের প্রত্যেক মুসলিম পরিবারে ৬৮টি মোমবাতি আর হিন্দু পরিবারে ৬৮টি করে প্রদীপ জ্বলবে। ছিটমহলের সড়কগুলোও আলোকিত করা হবে।
আমাদের কলকাতা ও পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, আজ মধ্যরাতের ঐতিহাসিক ক্ষণে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে ছিটমহলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের দীর্ঘ ৬৮ বছরের অভিশাপ থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি ঘটবে। একই সঙ্গে দুই দেশের সীমান্ত স্থায়ীভাবে চিহ্নিত হবে। এদিনই সরকারিভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ছিটমহলের ভূখণ্ডে অধিকার কায়েম করবে। এই ঐতিহাসিক জয়যাত্রার উৎসবে সামিল হওয়ার জন্য তৈরি দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা। উৎসাহ আর উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছে এতদিনের রাষ্ট্রহীন জনপদ। অবশ্য এই আনন্দের মাঝেও অখুশি অনেক ছিটমহলবাসী। তাদের অনেকেই সময়মতো নাম তোলাতে পারেননি, জানাতে পারেননি তারা কোন দেশের নাগরিক হতে চান। ভারত অবশ্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে সমস্যার সমাধানের জন্য। তবে এই ছোটখাটো দুঃখ ভুলতে হচ্ছে ইতিহাসের এক জটিল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে। তবে ছিটমহলবাসী তাদের সংগ্রামের ৬৮ বছরকে মনে রেখেই আজ মধ্যরাতে ঘরে ঘরে ৬৮টি করে মোমবাতী প্রজ্জ্বলিত করবেন। বাংলাদেশের যে ছিটমহলগুলো ভারতের সঙ্গে মিশে যাবে সেখানে এখন খানিকটা শোকের ছায়া। ভারতের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যুতে সারা দেশে সাতদিনের শোক পালন হচ্ছে। এদিন ভারতের পতাকা ছিটমহলে তোলা হবে ঠিকই তবে তা রাখা হবে অর্ধনমিত। বাংলাদেশি ছিটমহল বলে পরিচিত এলাকার সব মানুষই ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে চেয়েছেন। শুক্রবার রাতের পর তারা সকলেই হয়ে যাবেন ভারতীয় নাগরিক। আবার বাংলাদেশের ভূখণ্ড ঘেরা ভারতীয় ছিটমহলের ৯৮৯ জন মানুষ ভারতে ফিরে আসতে চেয়েছেন। বাকিরা বাংলাদেশেই সেদেশের নাগরিক হয়ে থেকে যেতে চেয়েছেন। দু’দেশের ১৬২টি ছিটমহলেই রাত ১২টা ১ মিনিটে একই সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি। ছিটমহলগুলোর প্রতিটি অন্ধকার সড়কে মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করার পাশাপাশি ওড়ানো হবে আকাশ প্রদীপ। রাতভর চলবে নাচ-গানসহ নানা অনুষ্ঠান। এর প্রস্তুতি চলেছে কয়েক দিন ধরে। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর থেকে দু’দেশের ১৬২টি ছিটমহলের রাষ্ট্রহীন মানুষ আত্মপরিচয়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। শুধু ২০১৫-এর এইদিনই শেষ নয়, প্রতিবছর ৩১শে জুলাই উৎসবমুখর পরিবেশে এই দিনটি পালন করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দুই দেশের সঙ্গে একীভূত ছিটের বাসিন্দারা।
‘যদি শ্যাখের বেডি হাসিনার লগে একবার দ্যাহা করতে পারতাম’
ছিটমহল থেকে ফিরে মাজহারুল ইসলাম লিটন জানান, নীলফামারীর ডিমলায় ৪টি ছিটমহলের ২০১১ সালে ও ২০১৫ সালের জনগননায় বাদ পড়া ২৮ নং বড় খানকি ছিটমহলের বাসিন্দা মৃত বাবর আলীর স্ত্রী ১২০ বছর বয়সী ময়মন নেছার নাতী জিন্নুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, আমার দাদী ৬৮ বছর ছিটমহলে বসবাস করলেও ছিটমহল বিনিময় চুক্তির জনগননায় ২০১১ও ২০১৫ সালে জনগননাকারীরা তার নাম জনগননায় অর্ন্তভুক্ত করেনি। ১২০ বছর বয়সী ময়মন নেছা বয়সের ভারে কিছুটা চলাফেরায় কাতর হলেও শ্রোবন শক্তি ও দৃষ্টি শক্তিতে এখনো অটল। সাংাদিকদের কাছে নাতী জিন্নুর রহমানের অভিযোগের কথা ঘর হতে শুনতে পেরে দুহাতে লাঠির উপড় ভর করে বেড়িয়ে নাতীকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আমার বয়স ১২০, আমার পোলা মাইয়া ১৪ জন। ৭ পোলা ৭ মাইয়ার মধ্যে ৫ পোলা ও ৪ মাইয়া মইরা গ্যাছে। বড় পোলা উপজেলার পশ্চিম খড়িবাড়ীর বাসিন্দা লাল মামুদ (৬৫)১৯৭১ সালে শ্যাখ মুজিবরের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করছে। হেয় এ্যাহনো বাইচা আছে। স্বামিডারে হারাইছি যুদ্ধের এক বছর পরোই। এ্যাহন আমি নাতী জিন্নুর রহমানের ছিটমহলের বাত্তেই থাহি। মানুষগুলা (জনগননাকারীরা) আমার নাম নেয় নাই আমার নাহি বয়স অইছে। মরনের আগে যদি আমি বাংলাদ্যাশের নাগরিক অইয়া মরতে পারতাম তইলে আত্নাডা শান্তি পাইতো। নাম লয়নাই তাতে কি অইছে তারপরেওতো শ্যাখের বেডি হাসিনা আমাগো মুক্ত করছে। আল্লায় হ্যার হায়াত দারাজ করুক। আমি আমার নাতীরে কইছি আমি মইরা গ্যালে বাংলাদ্যাশের মাটিতে তর দাদার কবরের লগে আমারে কবর দিস। এই বয়সে আমি আর কিছুই চাইনা বাবা যদি মরনকালে একবার শ্যাখের বেডি হাসিনার লগে দ্যাহা করতে পারতাম! তোমরা আমারে তারলগে দ্যাহা করার ব্যবস্থা কনরা দিতে পারবা? বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। বলেন আমি আর কিছুই কইতে পারুম না বাবা।
ছিটমহলগুলোতে ৩১ জুলাই রাতে ২৮ নম্বর বড়খানকী ছিটমহল ও ৩১ নম্বর নগর জিগাবাড়ি ছিটমহলে ছিটমহলবাসীদের উদ্দ্যেগে ১২টা ১মিনিট থেকে বাধ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ উল্লাসে বিশাল খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে খগাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন জানায়, দীর্ঘ ৬৮ বছর বন্দীদশা থেকে মুক্তি উপলক্ষে ছিটমহলবাসীরা তার ইউনিয়নের ২৮ নম্বর বড়খানকিতে এ আয়োজন করেন। অপরদিকে টেপাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন জানায়, বৃহঃবার রাতে তার ইউনিয়নের ৩১নম্বর নগর জিকাবাড়ী ছিটমহলে বন্দীদশা দেশে মুক্ত জীবন উপলক্ষে বিশাল খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। ডিমলা থানার অফিসার ইনচার্জ রহুল আমিন খান বলেন, নীলফামারীর ডিমলার ৪টি ছিটমহলে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। বৃহঃবার রাতে বহিরাগত কেহ কোন প্রকার সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হবে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, সরকারী ভাবে কোন কর্মসূচির খবর পাওয়া যায়নি তবে পুলিশ প্রশাসন ছিটমহল বাসীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে বলে তিনি জানান।
১১১টি ছিটমহলের সাজসাজ রব
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার আনন্দ-উৎসব শুরু হয়ে গেছে ছিটমহলের ঘরে ঘরে। এ নিয়ে ওই এলাকায় চলছে সাজসাজ রব। কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়ায় আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের। রাত ১২টায় নামানো হবে ভারতের পতাকা। ১২.০১ মিনিটে উঠবে বাংলাদেশের পতাকা। জ্বালানো জবে ৬৮টি মোমবাতি। ওই এলাকার ভারতের অভ্যন্তরীল মশাল ডাঙ্গা ছিটমহলে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। তবে সাবেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর কারণে সেখানে দেশটির জাতীয় পতাকা অর্ধনিমিত রাখা হবে। বিভিন্ন ছিটমহল সরেজমিনে ঘুরে অনুসন্ধানে জানা যায়, যারা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর অভ্যন্তরের ছিটমহল দাশিয়ারছড়া থেকে ভারতের মূল ভূখন্ডে চলে যাচ্ছেন তাদের যাওয়া না যাওয়ার মধ্যে বেশ কিছু মানসিক দুশ্চিন্তা কাজ করছে। বাসিন্দা আতাউর রহমান বললেন, আমি প্রায় ৮ বছর ভারতের দিল্লিতে পল্লি চিকিৎসার কাজ করি। সেখানে আমার প্রতিদিন গড়ে ভারতীয় রুপিতে ৮ থেকে ৯ শ’ টাকা রোজগার করি। যদিও আমি দাশিয়ারছড়ার মানুষ আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এখানে আমার অনেক আত্বীয় স্বজন রয়েছে। কিন্তু আমি এখানে এত আয় রোজগার করতে পাররো না। সে কারনেই আমাকে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভারতে যেতে হচ্ছে। ছিটমহলের চেয়ারম্যানটারীর মোজাম্মেল হক ও তার স্ত্রী হামিদা জানান, ভারতে যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্ন এখানে নেই আমরা শুধু নিজেদের বেঁচে তাকার তাগিদে ভারতে যাচ্ছি। আমরা প্রায় ১৫ বছর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কাজ কামাই করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছি। এ মুহুর্ত্বে যদি বাংলাদেশে থেকে যাই তাহলে আমাদের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও আমরা ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেছি। রেজাউল জানালেন, আমাদের সবাই দাশিয়ারছড়া ও বাংলাদেশে রয়েছেন। আমার নানা বাড়ী ভারতে। তাছাড়াও আমার বয়স যখন ৭/৮ বছর তখন থেকে ভারতে থাকি। আন্ততপক্ষে ভারতে গেলে কিছু কাজ কামাই করে খেতে পারব। এখানেতো তেমন কোন কাজ নেই। ভারতবর্ষ বিশাল দেশ। অবশ্যই কাজ মিলবে। আতাউর রহমান তিন বছর পূর্বে বিয়ে করেছেন বাংলাদেশের বড়ভিটা গ্রামে। বিয়ের পর থেকে তাদের সুখের সংসার। স্বামী আতাউর ভারতে যাওয়ার জন্য মতামত জরিপে নাম স্বাক্ষর করে ছবিও তুলেছেন। স্ত্রী মিনু বেগম কোন ভাবেই যেন ভারতে যেতে চাইছেন না। তিনি শুধু চোখের জলে তার আকুতি টুকু স্বামীকে বুঝাতে পারছেন না। একই অবস্থা শাহানার। শাহানার পিতা উপজেলার কুঠিচন্দ্রখানা গ্রামের চোত্তারড়ীর সমজিদের পাড়ে। তার বিয়ে হয়েছে দাশিয়ারছড়ার খলিলের ছেলে আলতাফের সঙ্গে। শাহানার যখন বিয়ে হয় তখন সে ভেবেছিল এক সময়তো দাশিয়ারছড়া বাংলাদেশ হবে। কিন্তু বাংলাদেশ হলো বটে। তাকে এখন ভারত যেতে হচ্ছে। তিনি জানান, স্বামী আমাকে যাইয়ে বলুক আমি ভারতে যাব না। ৭১ সালে ৬ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের আলা উদ্দিন। ভালই চলছিল তাদের সংসার। এর মধ্যেই আলা উদ্দিনের মৃত্যু হলে বড় ছেলে সামসুল হক তার ছোট ভাই শাহাজাদা, শাহাজাহানকে নিয়ে ভারতের ইট ভাটায় কাজ করত। মতামত ও জনগণনা শুরু হলে তিনি বাংলাদেশে মতামত ফরম ও জনগণনায় অংশ নেন। তিনি কলেজ পড়ুয়া ছোট বোন আসমা (২০) ও খাদিজা (১৭)কে নিয়ে মা সামসুন বেওয়া ও ভাই খায়রুলকে রেখে ভারতে যাবেন। আসমা জানায়, মার্তৃভূমি ছেড়ে ভারতে যেতে ভালো লাগছে না। বাবার কবর এখানে। মা ও ছোট ভাই থাকবে এখানে। তবে ভারতবর্ষ বড় দেশ একটা কিছুতো হবেই। এ আশা নিয়ে ভারতে যাচ্ছি।
হাসিঁ-কান্নায়, মিশ্র প্রতিক্রিয়া
মিলন পাটোয়ারী, ছিটমহল থেকে ফিরে জানান, ছিটমহলে এখন অপেক্ষা মহেন্দ্রক্ষণের। মুক্তির আনন্দে সামিল হতে আত্মীয় স্বজনরাও ছুটে আসছে বাড়িতে বাড়িতে। চলছে ভোজ আয়োজনও। সেখানে চলছে হাসিঁ-কান্নার সুর। প্রিয় মানুষকে বিদায় জানাতে বাড়িতে বাড়িতে ভিড় আত্মীয় স্বজনের। কারো চোখের জল করছে ছলছল কারো কারো বুক ভাঙ্গা আর্তনাত। কেউ যাচ্ছে ছেড়ে প্রানের প্রীয় সন্তান ছেড়ে। কেউ যাচ্ছে নারী ছেড়া বাধন ছেড়ে। এপার বাংলার মায়ার বাধঁন ছেড়ে ওপার বাংলা যাওয়ার কান্নার সুর সর্বত্র। ভারতের ভু-খন্ডে জন্ম নিলেও বাংলাদেশের হাওয়া বাতাসে বেড়ে উঠা ছিটমহলবাসীরা আত্মার সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে ভারতে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না অনেকে। ছিটমহল মহল ছেড়ে না যাওয়া ছিটমহলবাসীরাও মেনে নিতে পাচ্ছেনা ওদের যাওয়া। ৬৮ বছর প্রতিক্ষার পর মহেন্দ্রক্ষন ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিট আসচ্ছে সেই ঐতিহাসিক রাত। এই রাত ১২টা পেরিয়ে ১ মিনিট হলেই বাংলাদেশের অভ্যান্তরে ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল পরিনত হচ্ছে বাংলাদেশের ভু-খন্ডে। ছিটমহল বিনিময় হলে ভারত পাবে তাদের অভ্যান্তরে বাংলাদেশী ৫১টি ছিটমহলের ৭ হাজার ১শত ৫১ একর জমি। বাংলাদেশে পাবে তাদের অভ্যান্তরে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের ১৭ হাজার ১শত ৬০ একর জমি। বাংলাদেশ পাবে ৪৪ হাজার মানুষ আর ভারত পাবে সাড়ে ১৪ হাজার মানুষ। জরিপের দিকে ছিটমহল বিনিময়ে বাংলাদেশে হয়েছে লাভ। একই সময় ভারতের অভ্যান্তরে থাকা বাংলাদেশী ৫১টি ছিটমহল পাবে ভারত সরকার। ছিটমহলবাসীরা যারা ভারতে যেতে ফরম পুরন করেছে তারা ১ আগষ্ট থেকে ৩০ নভেম্বর যাবে। হাতিবান্ধার উত্তর গোতামারী ছিটমহলের বালা মনি জানান, আমার স্বামীর ভাই ৫জন ভারতে আছে তাদের সাথে থাকার জন্য ভারতে যাবে। ৩ মেয়ের ২ মেয়ের বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশের নিলফামারী ও কালীগঞ্জ উপজেলায়। এক অবিবাহিত মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ভারতে যাবো।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর