খালেদাকেও ডিজিটাল বানিয়ে ছাড়লেন শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকেও ডিজিটাল বানিয়ে ছাড়লেন! খালেদা জিয়ার ভক্তরা এমন কথায় বিরক্ত হলেও দেশের মানুষের একটা অংশ কিন্তু এমন কথা বলছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ‘ভিশন’ শব্দটা আওয়ামের কাছে সবচেয়ে বেশি পৌঁছে দিয়েছে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, এ কথায় কারো দ্বিমত থাকার কথা না।

তবে ভিশন সম্বলিত ঘোষণা এদেশে আওয়ামী লীগই প্রথম দেয়নি বলে অনেকে দাবি করেছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণার পর থেকে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশি বাঙালিদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

অনেকের ধারণা যে, আওয়ামী লীগই এদেশে ভিশন সম্বলিত ঘোষণা প্রথম দিয়েছিল। ফেসবুকে এমন একটা পোস্ট দেয়ার পর ইউরোপে পিএইচডি করে সেখানেই থিতু হওয়া সাংবাদিক মারুফ মল্লিক জানালেন, আওয়ামী লীগ নয়, কম্যুনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি) প্রথম এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছিল। সে রূপকল্প তৈরিতে মারুফ মল্লিক আরও অনেকের সাথে কাজ করেছিলেন বলে জানান।

সিপিবি যদি সর্বপ্রথম বাংলাদেশে প্রথম রূপকল্প-জাতীয় ঘোষণা দিয়েও থাকে, তাতে আওয়ামী লীগের কৃতিত্বের হানি হয় না কিছুতেই। যে কোনো রাজনৈতিক দলেরই রূপকল্প ঘোষণা করে গণমানুষের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করার অধিকার আছে। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী ইশতেহারের পাশাপাশি ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন শেখ হাসিনা। সব ঘোষণা কিংবা প্রতিশ্রুতি হয়তো বাস্তবায়ন করতে পারেননি শেখ হাসিনা। কিন্তু গত আট বছরে অনেক অর্জন আছে বাংলাদেশের। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতি। পদ্মাসেতু ইস্যুতে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া বিশ্বব্যাংক পর্যন্ত গবেষণা রিপোর্ট দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ১২ শতাংশ কমেছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ কনসেপ্ট অনেক পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশে। গ্রাম ও শহরের মধ্যকার মানবীয় যোগাযোগের ব্যবধান কমিয়েছে সরকারের নানা প্রকল্প। অবকাঠামোগত পরিবর্তন যেমন হচ্ছে, আইসিটি খাতের নানা প্রকল্পও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। মানুষের যাপিত জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গতি বেড়েছে। তথ্য, নানা ডকুমেন্ট আদান-প্রদানের গতি বাড়াতে মানুষ অর্থনৈতিক নানা ইস্যুতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। এর প্রভাব পড়ছে মানুষের উপার্জনে। মানুষের উপার্জন বাড়ছে নিয়মিতভাবে।

শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আওয়াম মনে করে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে যে পরিশ্রম করেন, সাধারণ মন্ত্রী-এমপিরা উনাকে অনুসরণ করলে দেশের অবস্থা আরও অনেক ভালো থাকত। মন্ত্রিসভায় গুটিকয়েক মন্ত্রীও পরিশ্রম করছেন সত্যি। তবে অনেকে আছেন খুব অজনপ্রিয়। দু-একজন আছেন যাদের জন্য পুরো সরকারের অনেক অর্জন ম্লান হতে বসেছে। সাম্প্রতিককালের এক জরিপে দেখা গেছে সরকারের চেয়ে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বেশি। এটি যেমন ভালো, আবার ভালোও না। শেখ হাসিনা সারাজীবন থাকবেন না। উনি যখন অবসরে যাবেন, তখন কি আবার আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে? এমন প্রশ্ন আমার না, আওয়ামের।

কিছু বিশেষ শ্রেণির মানুষ অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর সরকারের, বিশেষ করে শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এই অগ্রগতির মধ্যে এদেশে জন্ম নিয়েছে একটি হারামখোর শ্রেণি। আমলাতন্ত্র আর দলীয় যোগসাজশে সৃষ্ট এই হারামখোর শ্রেণি ঘুষ খেয়ে, প্রকল্পের টাকা মেরে, টেন্ডারবাজি করে, বদলি বাণিজ্য করে, সরকারি ব্যাংক ও শেয়ার বাজার লুট করেই শুধু ক্ষান্ত থাকছে না। ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইউরোপের নানা দেশে, যুক্তরাষ্ট্রে এই লোভী শ্রেণি অর্থ পাচার করে দিচ্ছে। অর্থ পাচার করা মানুষের মধ্যে গ্রামের মানুষও আছে। গ্রামের ছোট মুদির দোকানদার থেকে শুরু করে শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তাও আছেন।

যদিও এই অর্থপাচার আওয়ামী লীগ এর একার বিষয় নয়। সব আমল থেকেই হয়ে আসছে এটা। যাই হোক, রাষ্ট্রে, সমাজে অনেক সমস্যা, কষ্ট যেমন আছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতিও হয়েছে বাংলাদেশে, এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের ভিশন ২০২১ রূপকল্প যে পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে সফল হয়ে চলেছে, সেটা বলতেই হবে।

এর মধ্যে খালেদা জিয়া অনেকটা চমক দেখানোর মত ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করলেন। খালেদা জিয়া দুই ঘণ্টা রূপকল্প পাঠ করেছেন, কাউকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেননি, নিজে কষ্ট করে পড়েছেন, অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়েছেন। অনেক নেতিবাচক কথা মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। খালেদা জিয়াও মানুষ, উনার ভুল হতে পারে।

তাছাড়া বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় নেয়, ছন্নছাড়া অবস্থায় আছে দলটি। গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক নানা উপায়ে চেষ্টা করেও প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে পারছে না দলটি। এক্ষেত্রে দেশের নানা ক্ষেত্রে অর্জিত উন্নয়ন, ধর্ম ও প্রগতির মধ্যে সুসমন্বয়, শক্ত প্রশাসনিক অবস্থা ও অবস্থান বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করে ফেলেছে। এর মধ্যে খালেদা জিয়া একটি রূপকল্প ঘোষণা করেছেন। তিনি নিজে যে এই দীর্ঘ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেননি, সেটা বলাই বাহুল্য। বিএনপি আবার দাবি করছে যে, এই রূপকল্প ঘোষণা তাদের নির্বাচনী ইশতেহার এর অংশ না। সব দেখে-শুনে অনেকে বলছেন, খালেদা জিয়ার এই রূপকল্প আদতে শুধু ঘোষণা হয়েই থাকবে। কারণ এখানে অনেক অসঙ্গতি আছে, গোঁজামিল আছে।

আমি বলব, খালেদা জিয়ার এই রূপকল্প অন্তত একটা দিক থকে অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে। হিংসাত্মক রাজনীতির অবসানকল্পে খালেদা জিয়ার এই ঘোষণা দেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনলেও আনতে পারে। ২০১৩-২০১৫ সালে বিএনপি ও জামাতের সম্মিলিত পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসের ভয়াবহস্মৃতি ভুক্তভোগীরা তো বটেই, অন্যান্য মানুষও ভুলবে না। পেট্রলে পোড়া মানবমুখ, দেহগুলো আজও আমাদের আতঙ্কিত করে। রূপকল্প ঘোষণা করে সে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি থেকে প্রকাশ্যে খালেদা জিয়া সরে এসেছেন বলেই মনে হচ্ছে। না হলে এই ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করতেন না। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে নিশ্চয় এই রূপকল্প অর্জনের কাজ করা যাবে না। করতে হলে প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আর রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে ক্ষমতায় যেতে হবে। ক্ষমতায় বৈধভাবে যেতে হলে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। আওয়ামী লীগ নিশ্চয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরি করতে কাজ করবে না।

নির্বাচন ২০১৯ সালের শুরুতে বা তার কিছু আগেও হতে পারে। তাহলে খালেদা জিয়া এবং তার দল কি দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসবে? আরও প্রশ্ন আছে, নির্বাচনে বিএনপি আসতে পারলেও খালেদা জিয়া কি আসতে পারবেন? একাধিক মামলা মোকাবেলা করছেন তিনি। নির্বাচন যখনই হোক, বিএনপি আইনি কারণে নির্বাচনে আসতে বাধ্য। এবারো না আসলে নিবন্ধন বাতিল হবে বিএনপির। সব মিলে বিএনপির ভিশন-২০৩০ নিজে যেমন ধোঁয়াশাপূর্ণ, তেমনি এর বাস্তবায়নও বিএনপির পক্ষে আপাতত অসম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর