অসীম সাহার জন্ম ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা শহরের মামাবাড়িতে। তার লেখালেখি-জীবনের শুরু ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ সালে জাতীয় দৈনিকে প্রথম লেখা ছাপা হয়। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪০-এর অধিক। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। কাজ করেছেন চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা ও টিভি-উপস্থাপক হিসেবে। নিজের লেখালেখি, সমকালীন রাজনীতি এবং শিল্প-সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গে তার সঙ্গে বলা কথামালা দৈনিক মানবকণ্ঠের পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন
একুশের বইমেলায় আপনার কি কি গ্রন্থ বের হয়েছে?
অসীম সাহা: এবারের বইমেলায় আমার ৪টি গ্রন্থ বেরিয়েছে। অসীম সাহার প্রেমের কবিতা, অসীম সাহার রাজনৈতিক কবিতা, অসীম সাহার আবৃত্তির কবিতা এবং অসীম সাহার প্রবন্ধসমগ্র।
সর্বশেষ কোন্ বইটি আপনি পড়ছেন কিংবা পড়ে শেষ করেছেন?
অসীম সাহা: এখন আর নির্দিষ্ট করে কোনো একটি বই আমার পড়া হয়ে ওঠে না। আমার বিছানার চারপাশে বই ছড়ানো-ছিটানো আছে। যখন যে বই ভালো লাগে, আমি অল্প অল্প করে পড়ি। আগে প্রচুর গল্প, উপন্যাস পড়তাম, এখন আর সেগুলো তেমন করে পড়া হয়ে ওঠে না। তবে কবিতা, প্রবন্ধ এবং বাংলা অভিধান নিয়মিত পড়ি। লোকসংস্কৃতি আমার প্রিয় বিষয়, তাই সময় পেলেই সে-সংক্রান্ত বই পড়ি।
নতুন প্রজন্মের লেখালেখি মূল্যায়ন করবেন কিভাবে?
অসীম সাহা: এই সময়টা খুব অস্থির একটা সময়। নতুনদের অনেকের সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে তাদের লেখা পড়ি বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্যপাতায়। অনেকের কবিতাই ভালো লাগে। তবে মফস্বলের অনেক ভালো লেখক-কবি আছেন, যাদেরকে আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করছি না। ফলে তারা অচ্ছুতই থেকে যাচ্ছেন। এতে বাংলা সাহিত্যেরই ক্ষতি হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্যপাতাগুলোতে তথাকথিত মফস্বলের কবি-লেখকদের ভালো লেখা ছাপার ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। আমি যখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলাম, তখন প্রতিমাসে একটি করে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান করেছি। মুখগ্রন্থের (ফেইসবুক)-এর মাধ্যমে দেখে অনেক প্রতিভাবান তরুণ কবিকে আমি কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ভালো লেখক, কবিদের খুঁজে বের করার কাজটি সমষ্টিগতভাবে আমাদের করতে হবে। এতে করে বাংলা কবিতা উপকৃত হবে, সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে।
আপনার জীবনের আদর্শ?
অসীম সাহা: অবশ্যই আমার বাবা প্রয়াত অখিল বন্ধু সাহা। বাবা ছিলেন কলেজে দর্শনের অধ্যাপক, ছিলেন দার্শনিক। আদর্শবান ও বিশুদ্ধ জীবনের অধিকারী আমার বাবা সংসার, সন্তান এবং গ্রন্থের বাইরে অন্য কোনো জীবনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। দার্শনিক হিসেবে বাংলা একাডেমি তাঁকে দিয়ে ভারতীয় দর্শনের ওপর ‘ন্যায়দর্শন ও সাংখ্যদর্শন’ নামে একটি বই লিখিয়ে নিয়েছিলেন এবং সেটি প্রকাশও করেছিলেন আশির দশকে। বাবা আমার গর্ব। তাঁর আশীর্বাদ ও আদর্শ আমার জীবনচলার পাথেয়।
সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কিংবা শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা শব্দটি কী করে আমাদের হলো’ প্রভৃতি কবিতাসহ অনেক কবিতা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তেমন কোনো কবিতার জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না-এ-বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
অসীম সাহা: আসলে কোন্ কবিতা জনপ্রিয় হবে, এটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে পাঠক ও সময়ের ওপর। আমার একটি কবিতা আছে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত’। এই কবিতাটি যেভাবে জনপ্রিয় হয়েছে, এর চেয়ে অনেক সিরিয়াস কবিতাও তেমন করে হয়নি! কিংবা জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতাকে পাঠক যেভাবে নিয়েছেন, তার ‘অন্ধকার’ কবিতাকে তেমনভাবে নেননি। আসলে পাঠক দু’ধরনের কবিতা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন-একটি রাজনৈতিক কবিতা আর অন্যটি কামকবিতা। এ পর্যন্ত যতগুলো কবিতা জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা এই দুই ধারার কবিতা।
ছন্দের সঙ্গে কবিদের দ্বন্দ্ব বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
অসীম সাহা: আমি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি উদ্ধৃতি দিয়েই প্রশ্নটির উত্তর দিতে চাই, ‘মিলে সুবিধে হয়নি বলেই অমিলের আশ্রয় নিয়েছেন।’ তুমি তখনই ছন্দকে ভাঙতে পারো কিংবা তাকে অতিক্রম করতে পারো, যখন তুমি ছন্দকে করায়ত্ত করতে পারবে। ছন্দহীন কবিতা হয় না। শুধু অন্ত্যমিল মানে ছন্দ নয়। ছন্দ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ হতে পারে, কিন্তু ছন্দহীন কবিতা বলে কিছু নেই।
মুখগ্রন্থকে (ফেইসবুকে) কেন্দ্র করে এখন অনেকেই কবিতা লিখছে। বাংলা কবিতায় এটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?
অসীম সাহা: মুখগ্রন্থে প্রদত্ত ক’টি ভালো কবিতা প্রকৃত পাঠকরা পড়ছেন? অনেক বাজে কবিতা কিংবা একটি লাইন কবিতা হয়নি, এমন কবিতাও পোস্ট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে শত শত লাইক পড়ছে। অধিকাংশই না পড়ে এই ধরনের লাইক দিয়ে নিজেদের উপস্থিতির জানান দিতে চান। এটা ভালো কথা নয়। মূল কথা হলো মুখগ্রন্থে প্রদত্ত লেখালেখি কবিতার কোনো গুণগত মান তৈরি করতে পারছে না; বরং তা কবিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আপনার কাছে আসার আগে আপনার কবিতা ‘মাথিনের কূপ’ পড়ছিলাম, এটি একটি মিথনির্ভর কবিতা। কবিতায় মিথের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি বিষয়ে আপনার অভিমত?
অসীম সাহা: তোমার এই প্রশ্নের উত্তরে বলব, তিরিশের দশকের পঞ্চকবিদের কবিতায় মিথের ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। খেয়াল করে দেখো জীবনানন্দ দাশের একমাত্র ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কতটা মিথের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে! শামসুর রাহমান ও সৈয়দ শামসুল হকসহ খ্যাতিমান অনেক কবির কবিতায়ও মিথের ব্যবহার দুর্লক্ষ্য নয়।
প্রকৃতপক্ষে বিদেশি মিথ ছাড়াও বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক মিথ রয়েছে, যা কবিদের কবিতার অন্যতম উপাদান হতে পারে। আসলে বাংলাকে ভালোবাসতে হবে, বাংলার ইতিহাস জানতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এখনকার কবিরা পাশ্চাত্য-মিথের ওপর যতটা নির্ভরশীল, ততটা বাঙালি মিথের ওপর নয়। সে-কারণেই তারা বাংলা কবিতার মূল প্রবণতা থেকে সরে যাচ্ছেন। তাদের অনেকেরই জানার পরিধিও এতই কম যে, মিথ কিংবা পুরাণকে অবলম্বন করে তারা লেখার কথা চিন্তাও করতে পারেন না!
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন গড়ে উঠেছে। সাহিত্য সংগঠন বাংলা কবিতার বিকাশে কতটুকু ভূমিকা রাখছে?
অসীম সাহা : সংগঠন কবিকে বিকশিত করে না, ধ্বংস করে বলেই আমি বিশ্বাস করি। একজন কবি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। আমি এদের সম্পর্কে কিছু বলব না। তবে এই জাতীয় অধিকাংশ সংগঠন কবিতার বিকাশে ভূমিকা রাখা তো দূরের কথা বরং কবিতা নিয়ে ব্যবসার কারখানা খুলে বসেছে। এ নিয়ে আমার একটি কবিতা আছে, যার কটি লাইন হচ্ছে এ রকম : ‘সকল ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে কাব্য লেখার ব্যবসা ধরো/বাংলাদেশের বনবাদাড়ের অকবিদের যোগাড় করো।’
অনেক সংগঠনে আপনার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে …
অসীম সাহা: হ্যাঁ, প্রথম দিকে আমি ভেবেছিলাম, সংগঠন হয়তো একটি ভূমিকা রাখতে পারবে। কিন্তু এত কাদা ছোড়াছুড়ি আর এমন ধরনের প্রতারণা ও ভণ্ডামিতে ভরে গেছে এসব সংগঠন যে, তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যারা অনুমতি ছাড়া আমার নাম ব্যবহার করেছেন, আমি জানিয়ে দিয়েছি, এসব নামধারী কাব্যব্যবসায়ী সংগঠন আমার নাম ব্যবহার করলে আমি আইনের আশ্রয় নেব। এখন তারা আর আমার নাম ব্যবহার করছে না বলেই জানি।
নবীন-প্রবীণ কবিদের পুরস্কার প্রদান ও সম্মাননাদানের হিড়িক পড়েছে। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য?
অসীম সাহা: ঐ যে বললাম, কাব্যব্যবসা । কাব্যব্যবসা নামে আমার কবিতার আরেকটি লাইন পড়লেই এর উত্তর পেয়ে যাবে, ‘ক্রেস্ট তুলে দাও, বাঁদর নাচাও, ইচ্ছেমতো পকেট মারো।’
মানবকণ্ঠ: সাম্প্রদায়িক হামলা, জঙ্গিবাদকে সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অসীম সাহা: সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মৌলবাদী হামলা বিশ্বজুড়েই কম-বেশি চলছে। যারা এভাবে মানুষ হত্যা করছে, তারা কি সত্যি মানুষ? আমার একটি কবিতা আছে ‘মানবজন্ম’ নামে। কবিতার লাইনগুলো এমন … আমি তো হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়ে দেখলাম/আমি তো মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে দেখলাম/আমি তো বৌদ্ধর ঘরে জন্ম নিয়ে দেখলাম/আমি তো খ্রিস্টানের ঘরে জন্ম নিয়ে দেখলাম-” কিন্তু আমরা কেউ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারলাম না! আর প্রকৃত মানুষ হতে না পারলে তো এ-ধরনের হামলা কখনই থামবে না।
তরুণদের ভেতরে ভালো মানের লেখার চেয়ে বই প্রকাশে আগ্রহ বেশি-এ ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন?
অসীম সাহা: এক কথায় বলব, এটি অজ্ঞতা আর মূর্খতা। আমি লেখালেখি শুরু করেছি ১৯৬৪ সালে। আমার প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছে ১৯৮২ সালে। এর মধ্য থেকে নিশ্চয়ই তোমার উত্তর পেয়ে গেছো।
তরুণদের উদ্দেশে আপনার কথা?
অসীম সাহা: আমি এটাই বলব, ভালো করে দেশকে জানার চেষ্টা করো, মানুুুুুুুষকে বোঝার চেষ্টা করো। লেখার মান সমৃদ্ধ করো। কোনো প্রকার মোহের কাছে ধরা দিও না। মনে রেখো, চর্চা, পঠন-পাঠন এবং সাধনার কোনো বিকল্প নেই।
কবিতাকে জনপ্রিয় করতে আবৃত্তিশিল্পীর ভূমিকা কতটা?
অসীম সাহা: কবিতাকে আবৃত্তিশিল্পীরাই গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। তবে আবৃত্তিশিল্পীদের সঙ্গে কবিদের একটি যোগাযোগের দূরত্ব আছে। কারণ, প্রথমত আবৃত্তিশিল্পীরা কবিদের সঙ্গে কথা না বলে নিজেদের ইচ্ছেমতো কবিতা আবৃত্তি করছেন। কবিতার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা না বুঝে কবিতা আবৃত্তি করা ঠিক নয়। অথচ অনেকেই তা করছেন। দূরত্বের আরেকটা কারণ, অনেক আবৃত্তিশিল্পী আবৃত্তি করার সময় কবির নাম উল্লেখ করেন না।
এটা অন্যায়। আবার অনেকেই আছেন, যারা কবিতা পড়ে সম্মানী পান, কিন্তু সেখান থেকে কবিদেরকে সম্মানীর কোনো অংশ দেন না! এসব কারণেই আবৃত্তিশিল্পীদের সঙ্গে কবিদের একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এটা দূর করার দায়িত্ব আবৃত্তিশিল্পীদের।মানবকণ্ঠ