বর্ণের জন্য গ্রন্থের বুকে আঁকুতি

মাহফুজা মুন্না।।

সেদিন হয় প্রেমের জনম
যবে তার তরে মন করে কেমন
কে জানে কবে আসবে সে ক্ষণ
পনের কি পঞ্চাশে
কে বলতে পারে!!

হ্যাঁ তার জীবনেও প্রেম এসেছিল। যখন প্রেম এলো তখন সে বুঝল আগে যাকে প্রেম ভেবেছিল তা স্রেফ ভাল লাগা, পাশাপাশি কাছাকাছি থাকতে থাকতে চলতে চলতে যে মায়া জন্মে তাকেই এতদিন সে প্রেম ভেবেছিল। কি বেকুব ভাবনা ছিল তা টের পেল হঠাৎই।

জীবনে চলার পথে কতনা নারীর সাথে ওঠাবসা হয়েছে। তাদের কারো কারো সাথে হৃদ্যতাও হয়েছে, এখনো আছে বৈকি! কিন্তু না তা প্রেম নয়। প্রেম এসেছিল তার জীবনে হ্যালীর ধুমকেতুর মত কিংবা সুপার মুনের মত, বহু বছর পর কিন্তু কেন? তার উত্তর জানা নেই, সে জানে প্রেম এসেছিল। মহামতি আইনস্টাইন যেমন জানতেন ই=এমসি স্কোয়ার হয় কিন্তু কেন হয় তা জানতেন না। এতো বিজ্ঞান, আজ নয়ত কাল প্রমাণ সাপেক্ষ। হ্যালির ধুমকেতু, সুপার মুন দেখা দিয়ে চলে যায় কিন্তু তার মনে প্রেম স্থায়ী হয়ে রইল।

তার নাম দিলাম গ্রন্থ আর তার প্রেমিকার নাম দিলাম বর্ণ কারণ গ্রন্থের পাতায় পাতায় বর্ণের অবস্থান। বর্ণবিহীণ কি গ্রন্থ হতে পারে!

গ্রন্থের সব আছে, পরিপূর্ণ জীবন তবে কেন এমন প্রেমের সুনামি বয়ে গেল মনের উপর দিয়ে! ভাসিয়ে নিয়ে গেল সব! বর্ণ তো এমনই হয়! প্রেমময় কাব্যময় কবিতায় তাইতো তার অবস্থান।

বর্ণর সাথে দেখা আর দশটা সাধারণ নারীর মতই, সম্মানিত। তবে তার চোখজোড়া কেমন যেন চোখের সামনে ঝুলে রইল, পাখির নীরের মতই। হঠাৎ তার কাছাকাছি আসার সুযোগ ঘটল ঘটনার ঘনঘটায়। তার কণ্ঠ কানে বাজল, সুর সুমধুর। প্রয়োজনীয় কথা হয়। প্রয়োজন পেরিয়ে প্রাঞ্জল কথা, প্রগলভতা, খুনসুটি। গ্রন্থ বুঝতে পারে না সে যে বর্ণর প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কথা হয় ফোনে, কত কথা!! কথার মালা দীর্ঘ হয়। সাহিত্য, সংগীত ,শিল্প ,রাজনীতি, প্রেম সব বিষয়ে, না নিজের প্রেমের কথা হয় না, প্রশ্নই আসে না। বর্ণর কত্ত জ্ঞান। গ্রন্থর লেখালেখির জীবন, বর্ণর সাথে কথা বলতে বলতে কতদুর যাওয়া যায়, এমনটি আগে হয়নিতো!

গ্রন্থর সব কিছু ভাল লাগে এখন, ধুলোঢাকা ঢাকার আকাশ, শিশাভরা বাতাস, রাস্তার জ্যাম সব। জ্যামে বসে রিং করলে কখন ফুরিয়ে যায় সময় বুলেট ট্রেনের বেগে। লেখালেখি চলে তুমুল বেগে, গ্রন্থ বেগবান যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে ফানুস আকাশে, উড়ছে তো উড়ছেই।

গ্রন্থ আর বর্ণর কথা আগায় বানের পানির মত, শাড়িতে নারী যেন বর্ণকেই মানায়। মায়াবী চোখ, প্রায় হাটু সমান চুল যেন ডেলার কেসকেড হেয়ার, শাড়ির রঙ, লিপিস্টিক, ঠোঁট, কথা থমকে যায়, একটু আড়ষ্টতা, ব্যস্ততার কথা বলে বর্ণ ফোন রেখে দেয়। গ্রন্থের বুকে ঢেউ, তিরতির কাঁপুনী, ভালোলাগা ভয় দুইই, বর্ণ মাইন্ড করল না তো! রাতে ঘুমের ঘোরে বর্ণ আর বর্ণ।

পরদিন বর্ণর ফোনে হার্টবিট মিস হওয়ার যোগার। কাঁপাকাঁপা গলায় হ্যালো বলতেই ঝরণার বেগে হাসি।
হ্যালো কি হল! হাসিতে তো শিলাবৃষ্টি হচ্ছে!
আর বলনা, আমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।
গ্রন্থের বুকটা ধ্বক করে উঠল, বলল, কোন সে আমার চিরশত্রু!!!
মানে কি!
কোন মানে নাই, তোমার সাথে দেখা করতে চাই। খুব জরুরি কথা!
ওকে আমার অফিসে চলে এস।
না অফিসে না, একটু বাইরে খেতে চাই আর নিরিবিলি কথা বলতে চাই মুখোমুখি বসে পাখির নীড়ের মত চোখের মেয়ের সাথে।
না তাইলে থাক।
ওকে অফিসেই আসছি

গ্রন্থের ভিতর কোনো ভনিতা নাই, সে সারারাতে মনকে গুছিয়ে নিয়েছে কি বলবে। নিজেকে সে পুরোপুরিই আবিষ্কার করতে পেরেছে, বর্ণকে ভালবেসেছে।

একটু ওয়েল ড্রেসড হয়েই বর্ণর অফিসে যায়, ক্লিন শেইভ করে অ্যাজারো আফটারশেভ মাখে। মনে ভাললাগা ও ভয় দুইই। আউট হয় হবে কিন্তু ছক্কা মারার ব্যাটিং করবে।

অফিসে ঢুকে গ্রন্থ মুগ্ধ হয়ে গেল, বর্ণ যেন জারুল ফুল হয়ে ফুটে আছে। গ্রন্থকে দেখে বর্ণ স্বভাব মতই কলকল করে বলল,
কি ব্যাপার তোমাকে এমন লাগছে কেন?
গ্রন্থ একটু ভড়কে গেল, কেমন লাগছে?
“জামাই জামাই” বলেই খিল খিল হাসিতে ভেঙে পড়ল বর্ণ।
“তা আমাকে তোমার জামাই হিসেবে মানাবে তো!” গ্রন্থ ফস করে বলে ফেলল।
মানে কি! ফাজলামি রাখো তো! আসোতো লাঞ্চ করি, আমি তোমার জন্য বসে আছি, সাদা ভাত আর লাউ শোল, মুখে রুচবে তো।
তুমি বিষ খাওয়ালেও অমৃত মনে হবে, গ্রন্থ ফোড়ন কাটল।

লাঞ্চ শেষে গ্রন্থ খুব ধীরে সুস্থে বর্ণকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। গলা কেঁপে গেল তবু বলতে পারল। বর্ণ খুব চুপ হয়ে গেল যেন ভোরের শান্ত সরোবর। বলল, একটু বাইরে যেতে হবে, তোমাকে ফোনে বলব। দুজনে লিফটে নেমে এল, লিফটে গ্রন্থ বর্ণর হাত আলতো করে ধরে বলল, বর্ণ আমি তোমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছি, আমি নিজেও জানি না কিভাবে হল কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না, শুনতে হয়ত টিন এজারদের মত লাগছে কিন্তু এটাই সত্যি।

অপেক্ষার পথ বড় দীর্ঘ যেন অসীম। সিগারেট বেশি খাওয়া হয়ে যাচ্ছে, ডাক্তারের নিষেধ কিন্তু মন মানছে না। আচ্ছা মন এত ডেস্পারেট কেন, কিচ্ছু মানতে চায় না।

ফোন এল, না উচ্ছল হাসির ঝরনা নয়, বর্ষা শেষের থেমে থেমে পরা তিরতিরে ঝরনা, একটু গম্ভীর যেন গভীর রাতের প্রপাত।

কোনো ভুমিকা না করে স্পষ্ট করে বলল, দ্যাখো আমি বিয়ে করব না, তোমাকে বলে নয়, কাউকেই করব না, তুমি অনেক যোগ্য একজন মানুষ কিন্তু আমি একাকী জীবন কাটিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, একা থাকার স্বাধীনতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এজীবনে আর কাউকে জড়াব না। তুমি আমাকে আর রিকোয়েষ্ট করবে না, এটাই ফাইনাল। ফোন রেখে দিল।

ভুমিকম্প হল কি! গ্রন্থ টলে গেল। ভাঙন ভাঙন হৃদয় ভাঙছে, পাথর খসে খসে পরছে, জলপ্রপাত গতিপথ খুঁজে পেয়েছে, চোখ বেয়ে নামছে। নাহ ভাঙন থামছে না, তরল গরল আজ ঢালতেই হল বুকের ভাঙন ঠেকাতে।

রাত কিভাবে কেটেছে জানা নেই গ্রন্থের, ঘুম ভেঙে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হল। অভ্যাস বশতঃ বর্ণকে ফোন দিল, বর্ণ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলল, খুনসুটি করল, নাহ আজ কোন কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে না, গাড়িতে বসে জ্যাম অসহ্য লাগছে, ব্যর্থ মনে হচ্ছে খুব নিজেকে, অনেক গবেষনার পর থিসিস পেপার সাবমিট করে যদি রিজেক্ট হয় তবে কেমন লাগবে, ঢাবির বোটানির এক স্যারের এমন হয়েছিল। সে তার গবেষনায় অটল ছিল, ফিরে এসেছিল। কিন্তু গ্রন্থর মন ফেরাতে পারছে না।

এরপর গ্রন্থ স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করেছে, পারেনি, মাঝে মাঝে বর্ণর অফিসে হানা দিয়েছে, পাগলামিও করেছে কিছু, নুলো ভিখেরীর মত হাত পেতেছে, বর্ণর ধবধবে সাদা পায়ের প্যাডিকিওর করা মসৃন আঙ্গুলের অঙ্গুরিতে চুমু খতে চেয়েছে একবার, বর্ণকে রানী বানিয়ে আজীবন দাস হয়ে থাকার শপথ করেছে কিন্তু বর্ণর মন গলেনি। বর্ণ কি অহংকারী!!

আজ গ্রন্থর বুক জুড়ে শুন্যতা, ফুলগাছবিহীন বাগান যেন, পাখিরাও আসেনা কলকাকলি করতে। কি যে অসহ্য লাগে মাঝে মাঝে! রাস্তায় জুটিবদ্ধ কাউকে দেখলে দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় ভবঘুরে হয়ে যেতে। কল্পনায় ভেসে যায় মন কখনো কখনো, হাতে কলম উঠতে চায় না, লেখা হয় না কোন প্রেমের কাব্য, যার নিজের প্রেম ব্যর্থ সে কেন প্রেমের কাব্য লিখবে, এটা প্রতারনা নয়!! নিজের সাথেই নিজে কথা কয়।

বসন্তের কোকিলদের প্রেম করার সময় এসেছে, অবিরাম ডেকেই যায় সঙ্গীর খোঁজে, ডাকতে ডাকতে সঙ্গীর মন গলে একসময়, যদি জানা যেতে কি এমন মন্ত্র আছে সে ডাকে তাই না হয় শিখে নিত গ্রন্থ।

মেঘলা দিন যায়, কৃষ্ণচূড়া বিছানো পথ, মনে কত ইচ্ছে ছিল এইপথ দিয়ে বর্ণর হাত ধরে হেটে যাবে, জারুলের ফুল গুঁজে দিবে খোপায়। হোল না হোল না সবার জীবনে প্রেম ধরা দেয় না তবে প্রেম আসে কেন!! এত উত্তর মিলে না।

নির্ঘুম রাত শেষে জানালা দিয়ে তাকালে শুকতারাটা বড় চোখে লাগে, কি অপলক চেয়ে থাকে!! কি দেখে!! অসুখী মানুষের নির্ঘুম মুখ! শুকতারা তুমি আমার কষ্টের সাক্ষী থেকো, গ্রন্থ বিড়বিড় করে।

বর্ণ জানে না একবার ছাঁপা হয়ে গেলে গ্রন্থের বুক থেকে বর্ণ মুছে না, বিবর্ণও হয় না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর