আরমান শেখ নামের একজন মধ্যবয়স্ক লোক হাসপাতালে এলেন। রাত সাড়ে দশটার মতো হবে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন তার বৃদ্ধ মাকে। বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই।
হাসপাতালে আরমানের খুব একটা আসা পড়ে না। গ্রামের ফার্মেসির লোকমান ডাক্তারের টুকটাক ওষুধেই রোগ সেরে যায়। তাই হাসপাতাল পরিবেশে এসে কিছুটা শঙ্কায় পড়লেন তিনি। জরুরি বিভাগের সামনে এসে ভ্যান থেকে তার মাকে নামাচ্ছিলেন।
এমন সময় সবুজ শার্ট পড়া একজন এগিয়ে এলেন। জরুরি বিভাগের সামনেই ছিলেন তিনি। এসেই সালাম দিয়ে বললেন, আমি রতন, জরুরি বিভাগের কর্মচারী। রোগীর কি হয়েছে?
কিছুটা স্তম্ভিত হয়েও নিজেকে সামলে নিলেন আরমান শেখ। বললেন, “আমার আম্মার শ্বাসের ব্যারাম ম্যালা দিনের। আইজকা খুব বাড়ছে। কিছু না বুইজ্যা হাসপাতাল নইয়া আইছি।”
সবুজ শার্ট পড়া রতন কাকে যেন একটা ট্রলি আনতে বললেন, এরপর ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হলো রোগীকে। অক্সিজেন দেওয়া হলো। সাথে একটি ইনজেকশন। একজন নার্স এসে ইসিজি করলেন। অনেক সুস্থ বোধ করতে শুরু করলেন রোগী মিনিট দশেক এর মধ্যেই।
দায়িত্বরত চিকিৎসক আরমান শেখকে বললেন, আপাতত ভয়ের কিছু নেই। তবে আজ রাতটা হাসপাতালে ভর্তি থাকুক রোগী। আমাদের অবজারভেশনে থাকুক। কাল হয়তো ছুটি দিয়ে দেওয়া যাবে।
রোগীকে নিয়ে আরমান শেখ উপজেলা হাসপাতালের দোতলায় উঠলেন। একজন সবুজ শাড়ি পড়া মহিলা এগিয়ে এসে সালাম দিলেন। রোগীকে সাথে নিয়ে চললেন নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে।
এরপর সিস্টার এলেন। প্রয়োজনীয় ঔষধ ও কিছু উপদেশ দিলেন। কোন অসুবিধা বা শরীর বেশী খারাপ লাগলে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে তা জানালেন।
আরমান শেখ হাসপাতাল এর পুরো সিস্টেমটা দেখে রীতিমত ভড়কে গেছেন।
কল্পিত যে দৃশ্যের কথা বলা হলো এখানে তা বাস্তবায়ন করা কী খুব কষ্টের?
সীমিত জনবল নিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব না আমরা জানি। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা মানুষগুলোর জন্য যতোটুকুই আমরা করি না কেন তা যেন তাদের প্রশান্তির কারণ হয়।
স্বাস্থ্যসেবা নিতে রোগী বা রোগীর লোক হয়রানির শিকার হলে যতো উন্নত স্বাস্থ্যসেবাই আমরা দেই না কেন, জনগণ সেই সার্ভিসে কখনোই তৃপ্ত হবে না। সাধারণ মানুষের কাছে কেবল স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দিলেই হবে না, দৃশ্যমান উন্নত ব্যবস্থাপনার ধারণাও তাকে দিতে হবে।
সুনির্দিষ্ট ও অভিযোজনশীল মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাই পারে স্বাস্থ্য সেবার পুনঃব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখতে। এজন্য শুধু চিকিৎসকদের কর্মপরিধি বাড়ালেই চলবে না। প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তুলতে হবে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে থাকা সেবাদানকারী ব্যক্তিকে। শুধুমাত্র চিকিৎসকের সেবা আর কর্মস্থলে উপস্থিতিকেই মুখ্য নিয়ামক ভেবে নেওয়াটা ভুল।
চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলিতে দৃষ্টি দিতে হবে-
এক. একজন রোগী বা রোগীর স্বজন হাসপাতালে ঢোকা মাত্র যেন একটি অভ্যর্থনা পান। প্রতিদিন কর্মচারীদের যে কেউ একজন এই কাজটি করতে পারেন। পালাক্রমে কাজটি ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। যিনি কাজটি করবেন তিনি একটি ইউনিফর্ম পড়বেন। তিনি হাসপাতালের প্রথম ব্যক্তি যার সাথে রোগী বা তার স্বজনের মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে। তাই তার আচরণ ও পেশাগত দক্ষতার উপর হাসপাতালের সামগ্রিক একটি চিত্র ফুটে উঠবে।
দুই. সেবিকাদের সবাই ওয়ার্ডে বা রোগী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে চলবে না। রোগীর লোকের নানা প্রশ্নের জবাব কিংবা তাদের কাউন্সেলিং করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও পরিবেশ রাখতে হবে। একজন রোগীর স্বজনের রোগী নিয়ে উদ্বিগ্নতা থাকবে, প্রশ্ন থাকবে – এটাই স্বাভাবিক। সেবিকা ও সহকারীদের এই বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। চিকিৎসা শুরু করতে কোন কারণে বিলম্ব হলে তার কারণ জানাও রোগীর স্বজনের অধিকার।
তিন. উপজেলা হাসপাতালগুলোর বিভিন্ন স্থানে নির্দেশনামূলক বোর্ড এবং অন্যান্য নির্দেশিকা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। হাসপাতালে ঢুকে একজন রোগী বা তার স্বজন যেন অনায়াসে ধাপে ধাপে বুঝে নিতে পারে তার করণীয় সম্পর্কে।
চার. প্যাথলজি, এক্সরে, ইসিজি বিভাগে কোন পরীক্ষার কতো মূল্য, রিপোর্ট পেতে কতোক্ষণ সময় লাগবে ইত্যাদি বিষয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
পাঁচ. বাংলাদেশে রোগী সংখ্যার তুলনায় হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা কম হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু যে রোগীর ক্ষেত্রে শয্যা সংকট দেখে দেবে, তার স্বজনের জন্য ব্যাপারটি অবশ্যই হয়রানিমূলক এবং এটি হাসপাতাল নিয়ে তাদের মনে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। রোগী ভর্তির সময়েই এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কাউন্সেলিং ও দুঃখ প্রকাশ করা উচিত বলে আমার মনে হয়। ওয়ার্ডের বোর্ডে এ সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপনের সুযোগ থাকা সত্তেও আমরা সেটি জনবলের অভাবে মেইনটেইন করতে পারিনা। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই তথ্য উপস্থাপন জরুরি।
ছয়. হাসপাতাল এর রোগীরা একজন চিকিৎসককে দিনের শুরুতেই কাছে পান। তাই তাদের সকল অভিযোগ রাউন্ডের সময় উত্থাপিত হয়। তারা আশা করেন যে চিকিৎসক তাদের সমস্যার সমাধান করবেন। এক্ষেত্রে একজন সেবিকা/ওয়ার্ড বয়দের কেউ যদি রাউন্ড চলাকালীন একটি রেজিস্টার খাতায় রোগীদের অভিযোগ/চাহিদা গুলো লিপিবদ্ধ করেন এবং পরবর্তীতে ইউএইচএফপিও বরাবর উপস্থাপন করেন তবে সমস্যাগুলো সমাধানের প্রয়াস পাবে।
সাত. হাসপাতাল এর বিদ্যুৎ, পানি, স্যানিটেশন, খাবার, ঔষধ, বিছানার চাদর-বালিশ ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়াদি রোগীদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ সকল বিষয়ে আসা কোন অভিযোগ বা পরামর্শ গ্রহণ এবং দ্রুত নিষ্পত্তি সাধনের জন্য একটি বিশেষ টিম বা সেল থাকা প্রয়োজন। একটি বিশেষ ফান্ড গঠন করে এই টীমকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই সেল এর উদ্দেশ্য হবে উদ্ভূত সমস্যা বা পরিস্থিতি সমাধানে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
আট. হাসপাতাল এ আউটডোর চলাকালীন হাসপাতাল এর বিভিন্ন সেবা কার্যক্রমের বিবিরণসহ অডিও-ভিজুয়াল বুলেটিন এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে হাসপাতালের আগত রোগী কিংবা তাদের স্বজনেরা আরো বেশী করে হাসপাতাল কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারবে এবং হাসপাতালের বিদ্যমান সকল সার্ভিস সম্পর্কে জানতে ও জানাতে পারবে।
নয়. অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থাটি আরো সচল ও সংবেদনশীল করা প্রয়োজন।
আমাদের হাসপাতাল গুলো দিনরাত ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। বছরে ৩৬৫ দিন। স্বাস্থ্যবিভাগের মানুষেরা দুর্যোগে কিংবা উৎসবেও সেবাকার্যক্রমকে অব্যাহত রাখেন তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, সেবা আর আত্নত্যাগ দিয়ে।
অথচ এর পরেও অভিযোগের তীর আমাদের দিকে বার বার ছুটে আসে। আমাদের সামান্য কর্মপন্থা পরিবর্তনই হতে পারে এই সমস্যার সমাধান।
রোগীর জন্য হাসপাতাল এর থেকে আপন আর কেউ হতে পারে না – এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়া অতীব জরুরি।
স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পর্কিত মানুষগুলোর অসামান্য অবদানকে বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।
ডাঃ রাজীব দে সরকার
বিশেষ কর্মকর্তা, কো-অর্ডিনেশন সেল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা।
প্রাক্তন চিকিৎসক, গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রাজবাড়ী
প্রচার ও জনসংযোগ সম্পাদক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, রাজবাড়ী।
আহবায়ক, সুহৃদ সমাবেশ, গোয়ালন্দ উপজেলা।