যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা বিশ্বের দুটি দেশের একটি হল বাংলাদেশ

বিজয় দিবস প্যারেড ২০১৬; জানান দেবে এক নতুন বাংলাদেশের। আরেকটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমন একটি দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনী যে শত বাঁধা ঠেলে একদিন বিশ্বের বুকে নিজের বীরত্বপূর্ণ অস্তিত্বের জানান দিবে তা বলাই বাহুল্য। আর বাংলাদেশ প্রতিরক্ষাবাহিনী নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে প্রতিবছর বেছে নেয় মাতৃভূমির বিজয় দিবস, ১৬ ডিসেম্বর।

তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে জাতীয় প্যারেড ময়দানে আধুনিক সমরাস্ত্র, দক্ষতা আর কৌশলের অনবদ্য প্রদর্শনী করে জাতিকে বছরের পর বছর এভাবেই আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মানের শক্তিকে বলিয়ান করে চলেছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাবাহিনী।

প্যারেড ময়দানের পাঁচ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন গর্বিত অংশীদার-বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী আর বিমানবাহিনী তাদের স্ব স্ব সক্ষমতার নিদর্শন স্বরূপ সব অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র আর অসম সাহসী সেনাদের সমন্বয়ে তুলে ধরে এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে।

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী শুধু নয়, বিজয় দিবসের প্যারেডে অংশ নেয় দেশের চার হাজার ৪১৩ কিলোমিটার স্থল সীমান্তের পাহারায় নিয়োজিত বিজিবি, উপকূলীয় এলাকার অতন্দ্র প্রহরী কোস্টগার্ড, দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশের অধীনস্থ বিশেষায়িত বাহিনী র‍্যাব, সোয়াট।

এছাড়া অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার আরেক শক্তি বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে মানবতার পাশে দাঁড়িয়ে যারা সবচেয়ে বেশি মানবিক ভূমিকা রাখে সেই ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সও গৌরবের স্বাক্ষর রেখে অংশ নেয় বিজয় দিবস প্যারেডে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের আয়োজনে বিজয় দিবস প্যারেডের অন্যতম আকর্ষণ থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ইউনিট- ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা কন্টিনজেন্ট’। ১৯৭১ সালের মুক্তিবিপ্লবে এই মুক্তিযোদ্ধারাই বাংলাদেশ সেনা, নৌ আর বিমান বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিগবিজয়ী সাহসে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র আমাদের উপহার দিয়েছেন।

শুধু আর্মি, নৌ কিংবা বায়ুসেনা নয়, দেশমাতৃকার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দরকার পড়লে যুদ্ধে অংশ নেয়ার সামর্থ্য রাখে এমন বেসামরিক শক্তির স্বাক্ষর রাখা বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি)ও এদিন বিজয় দিবস প্যারেডে অংশ নিয়ে দেখিয়ে দেয় তাদের দক্ষতাপূর্ণ সামর্থ্য।

প্রতিবছর বিজয়ের দিনে সকাল ১০টায় শুরু হয় বিজয় দিবসের চিত্তাকর্ষক, অনুপ্রেরণাদায়ী প্যারেড। এর আগে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে ছয়টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত ঢাকার পুরাতন বিমান বিন্দর (রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত) জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ৩১ বার তোপধ্বনি করা হয়। সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজের পাশাপাশি ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমভিত্তিক যান্ত্রিক বহর চলমান প্রদর্শনীও হয়ে থাকে ময়দানে।

বাংলাদেশের গর্বিত রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে গৌরবগাঁথার অংশীদার হন।

গেল বছরের মত বিজয় দিবস প্যারেড ২০১৬ তেও নেতৃত্ব দেবার গৌরবময় দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। প্যারেড কমান্ডার মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শুক্রবার গৌরবের উর্দি পড়ে জিপে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদকে সালাম জানিয়ে শুরু করবেন বিজয় দিবস প্যারেড ২০১৬। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে বিজয় দিবস প্যারেডের সাক্ষী হবেন।

দেশের মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কোটি কোটি বাংলাদেশি সকালে টেলিভিশনের পর্দায় বিজয় দিবস প্যারেড অবলোকন করে দেশমাতৃকার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে নতুন করে দেশপ্রেমের চেতনায় জেগে উঠবেন।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বাংলাদেশ সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী ২০১৬ সালে এসে নতুন নতুন সব শক্তিতে বলিয়ান। প্রতিবছর বিজয় দিবস প্যারেডের মাধ্যমেই দেশপ্রেমিক সাহসী জনতা জানতে পারে তিনবাহিনীতে যুক্ত হওয়া নানা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সম্পর্কে।

স্বাধীনতার ৪৫ বছরে এসে থ্রি ডাইমেনশনাল (থ্রিডি) শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া বাংলাদেশের তিন বাহিনী এবার একটু বাড়তি আকর্ষণ আর উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে বিজয় দিবসের সকালে। এবারই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে কার্যকরী যুদ্ধাস্ত্র ‘সাবমেরিন’।

প্রথমবারের মতো কুচকাওয়াজে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যুক্ত হয়েছে সাবমেরিন। সমুদ্রসীমা পাহারা দিতে, প্রয়োজনে অনুপ্রবেশকারী শত্রুকে অব্যর্থ আক্রমণ করতে সাগরে ভাসা জাহাজের পাশাপাশি কাজ করবে সামরিক পরাশক্তি, বন্ধুরাষ্ট্র চীন থেকে সংগ্রহ করা এই সাবমেরিন।

অভিবাদন মঞ্চের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল প্রতিকৃতিকে দেখে দেখে আগাবে বিজয় দিবস প্যারেড’ ২০১৬। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকবেন জাতীয় চার নেতা- শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ, শহীদ ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী এবং শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান।

প্রতিকৃতির সারীতে আরও থাকবে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বাংলাদেশের অভিভাবকদের সাথে প্রতিকৃতিতে আরও আছেন মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠ।

প্যারেড কমান্ডার মেজর জেনারেল মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে অনুসরণ করে ময়দানের দক্ষিণ দিক থেকে দীপ্ত সঙ্গীতের তালে একে একে এগিয়ে যাবেন সম্মিলিত পতাকাবাহী তিনটি দল, বীর মুক্তিযোদ্ধা কন্টিনজেন্ট, সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর স্ব স্ব কন্টিনজেন্টসমূহ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, বাংলাদেশ পুলিশ, বিএনসিসি এবং অন্যান্য অংশগ্রহণকারী বিভাগসমূহ।

প্রতিবারের মত এবারও বিজয় দিবস প্যারেডের অন্যতম আকর্ষণ থাকবে আকাশ ভেদ করে উড়ে চলা বাংলাদেশ বিমান, সেনা, নৌ এবং পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকা ৪৪টি বিমান ও হেলিকপ্টার। ২০০ ফুট দীর্ঘ ও ১২০ ফুট প্রস্থের একটি লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা নিয়ে কুচকাওয়াজে দৃপ্ত ভঙ্গিতে অংশ নেবে কমান্ডোদের দল। ওয়ার ডগ ও সম্মিলিত অশ্বারোহী কন্টিনজেন্ট রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানাবে বিশেষ ভঙ্গিমায়।

ময়দানে উপস্থিত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, তিন বাহিনী প্রধান, সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা মন্ত্রীবর্গ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক-বেসামরিক অতিথি, আর কূটনীতিকদের মুগ্ধ করে উড়ে যাবে অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান মিগ-২৯। যুদ্ধবিমানের অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে দেখে সবার মত মুগ্ধতায় সিক্ত হবেন দেশের আপামর জনসাধারণ। রাষ্ট্রপতিকে ‘ফ্লাইং সেলুট দিয়ে সম্মান জানাবে যুদ্ধবিমান ‘মিগ-২৯’। যুদ্ধবিমানটি লাল-সবুজ ধোঁয়া উড়িয়ে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানাবে। পরোক্ষ অভিবাদনে শিহরিত হবেন দেশের ১৬ কোটি মানুষ।

মিগ-২৯ বিমানের বিভিন্ন কারুকাজে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। বিমানবাহিনীতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চতুর্থ প্রজন্মের এ বিমানটি শব্দের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি গতিসম্পন্ন। এটি শত্রুপক্ষকে বোকা বানিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরতে সক্ষম। লাল-সবুজের রং ছড়িয়ে বিমানটি প্যারেড স্থানের উত্তর দিক দিয়ে ডিসপ্লে শুরু করে। এরপর ইংরেজি আট অক্ষর ধারণ করে বিভিন্ন কারুকাজ দেখায়। এর মধ্যেই কাত হয়ে রাষ্ট্রপতিকে সালাম জানাব মিগ-২৯।

কীভাকে শত্রুকে বোকা বানিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণে করে নিরাপদে ফিরে আসে বিমানটি সেটিও প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরে মিগ-২৯। চতুর্থ জেনারেশনের এই বিমানটির পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন উইং কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক। এটি সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে শত্রুকে ঘায়েল করতে সক্ষম। যুদ্ধের ময়দানে এই বিমানটি অল্প সময়ে দিক পরিবর্তন করে শত্রুকে আক্রমণ করতে পারে। ২৫০টি বোমা বহন করতে সক্ষম বিমানটি।

এছাড়া র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের দুইটি বেল ফোর জিরো সেভেন হেলিকপ্টার, নেভাল অ্যাকাডেমির দুইটি মেরিটাইম প্রেট্রোলিয়াম ফ্লাইট, দুটি মেরিটাইম হেলিকপ্টর রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানিয়ে উড়ে যাবে।

বরাবরের মত বিজয় দিবস প্যারেডের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে জাতীয় পতাকাসহ প্যারাস্যুট জাম্প। নয় হাজার ফুট ওপর থেকে ১৭ জন প্যারাস্যুটার জাম্প দিয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে অবতরণ করবেন। তিনবাহিনীর প্যারাকমান্ডোদের সম্মিলনে গঠিত হয় প্যারাস্যুটারদের দল।

এছাড়া বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ অত্যাধুনিক পদাতিক বাহিনীর সুসজ্জিত প্রদর্শনী, বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানের বাংলার আকাশে জাতীয় পতাকার রঙের দ্যোতনা ছড়িয়ে দেয়ার কাজটিও সবাইকে মুগ্ধ করবে। বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়ের প্রতীক হিসেবে যান্ত্রিক বহরে উঠিয়ে আনা হয়েছে পুরো সমুদ্রের আবহ। এই প্যারেডে উঠে এসছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শৌর্য-বীর্যের অনন্য এক প্রদর্শনী।

প্রদর্শনীতে সবাই দেখবে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ হওয়া আরেকটি যুদ্ধযান, যেটি ১৫৫ কিলোমিটার দূরের শত্রু লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানতে সক্ষম। সেনাবাহিনীতে সর্বশেষ সংযোজিত যুদ্ধযান এটি। এছাড়া সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি কামানের প্রদর্শনী দেখানো হয়েছে। যেগুলো জলে-স্থলে সমান তালে চলতে পারে। অল্প সময়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে পারে।

বিমান বাহিনীর সাবসনিক গ্রাউন্ড মাইন এবং এ ২৪৪ এস টর্পেডো, অটোম্যাট মার্ক-২ এবং সি- সেভেন জিরো ফোর মিসাইল, এসওয়াই-ওয়ান এ এবং এফএম মিসাইল নাইন জিরো, রাডারসহ বেশ কয়েকটি মিসাইল প্রদর্শনীও দেখবে মানুষ।

সেনা বাহিনীর আরেক ধরনের যান রয়েছে, যেটি দিয়ে এক ঘণ্টা ৫৫ মিনিটে ব্রিজ তৈরি করা যায়। কোনো দুর্যোগ বা যুদ্ধকালীন সময়ে স্বল্প সময়ে ব্রিজ তৈরি করতে পারে এই বিশেষ যান। তার প্রদর্শনীও থাকছে কুচকাওয়াজে। সেনাবাহিনীর মিডিয়াম ট্যাংক টি-সিক্স নাইন দ্বিতীয় জিসহ আরও বেশ কয়েকটি ট্যাংক প্রদর্শনী হয় বিজয় দিবসের প্যারেডে।

বিজয় দিবসের দিনে প্যারেড গ্রাউণ্ডে বাংলাদেশ সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর চৌকশ অফিসার এবং জোয়ান মিলে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রদর্শনী করবেন সাত হাজার বাংলাদেশি। আর তাদের উর্দি, তেজস্বী শারীরিক ভাষা এবং সঙ্গীত, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, আকাশ ভেদ করে উড়ে চলা কিংবা নেমে আসার দৃশ্য দেখে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নতুন করে শপথ নেবে ১৬ কোটি বাংলাদেশি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর