১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিকাল। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী অস্ত্র সমর্পণ করে ফেলেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন তখন এক বাস্তবতা। এই খবর পৌঁছে গেছে পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ওই সময়টায় প্রচারের কথা ছিল বিপ্লবী গানের। কিন্তু এই সময় যে আনন্দের। লাখো মানুষের প্রাণ গেলেও একটি দেশ পাওয়ার উল্লাসের। এই সময় অন্য কোনো গান চলে?
কী করা যায়? এই ভেবে তাৎক্ষণিক রচনা করা হলো একটি গান। সেটিই হয়ে গেলো কালজয়ী এক রচনা। বিজয় নিশান উড়ছে ঐ, খুশির হাওয়ায় ওই উড়ছে…
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মুক্তিকামী জনতাকে উজ্জ্বীবিত রাখতে অসাধারণ ভূমিকা রাখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পাশাপাশি প্রেরণাদায়ক গান, কথামালা আর খবর প্রচারে নয় মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে এই বেতারের কর্মীরা। ওই সময় যেসব দেশাত্মবোধক গান রচনা হয়েছে সেগুলো হয়ে গেছে কালজয়ী। এখনও বিজয়ের উৎসবে চলে এসব গানই।
তবে এসব গানের ভিড়ে একটু আলাদা রয়ে থাকবে সব সময় ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ গানটি। কারণ, প্রথমকে হারানোর যে কোনো উপায় থাকে না। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এই রচনাটি। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রীক যে কোনো অনুষ্ঠানেই এটি এখনও গাওয়া হয়।
১৬ ডিসেম্বর সকালে শহীদুল হক খান গানটি লিখেন। এতে তাৎক্ষণিক সুর দেন সুজেয় শ্যাম। আর কোরাসে গাওয়া গানটি লিড দেন শিল্পী অজিত রায়।
গানটি কোন প্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল, জানতে কথা বলে স্বাধনী বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী তিমির নন্দীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সেদিন অন্য একটি গানের রিহার্সেল করছিলাম আমরা সবাই মিলে। হঠাৎ তাজউদ্দীন ও এইচ এম কামরুজ্জামান সাহেব আসলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। তারা বলেন আজকে দেশ স্বাধীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিজয়কে সামনে রেখে একটি গান লেখ। তখন গীতিকার শহীদুল হক খান এই গানটি রচনা করেন, আর গানটিতে সুর করেন সুজেয় শ্যাম। কিছুক্ষণ রিহার্সেল দেওয়ার পর আমরা গানটি রেকর্ডিং করি। অজিত রায় লিড দিয়েছিলেন গানটিতে। আমরা সকলে মিলে গানটি কোরাস গাইলাম।’
অন্য সব গানের চেয়ে এই গানটি অন্য রকম আরও একটি দিক থেকে। গীতিকার গানটি একবারে রচনা করেননি। তিনি এক বা দুই লাইন করে রচনা করেছেন। আর সুরকারও তাৎক্ষণিকভাবে এত সুরারোপ করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী তিমির নন্দী বলেন, গানটি রেকর্ড করে যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন গানটি শুনতে পাচ্ছিলাম ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’। সেদিন বিকেলেই সোহরাওর্দী উদ্যানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে আত্মসর্মপণ করেছিলন জেনারেল নিয়াজী। সেই বিজয়কে সামনে রেখেই এই গানটি লেখা হয়েছিল। এই গানটিই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ গান।
পুরো গানটা এমন
বিজয় নিশান উড়ছে ঐ
খুশির হাওয়ায় ঐ উড়ছে
উড়ছে… উড়ছে… উড়ছে…
বাংলার ঘরে ঘরে,
মুক্তির আলোয় ঝরছে…
মুক্তির আলোয় ঝরছে…
মুক্তির আলোয় ঝরছে।
আজ জীবনের জয়োল্লাসে
জমছে শিশির দুর্বাঘাসে
জয়োল্লাসে, জয়োল্লাসে
পাশে নেই আমাদের মহান নেতা
হাসির মাঝে আজ জাগে ব্যাথা
সাত কোটি প্রাণ দিকে দিকে ওই
দ্বীপ্ত মশাল জ্বেলে চলছে, দ্বীপ্ত মশাল জ্বেলে চলছে
বাংলার ঘরে ঘরে, বাংলার ঘরে ঘরে
মুক্তির আলোয় ঝরছে…
মুক্তির আলোয় ঝরছে…
মুক্তির আলোয় ঝরছে।
অন্ধকারার আঁধার থেকে
ছিনিয়ে আনবো বঙ্গবন্ধুকে
বঙ্গবন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুকে
উচ্ছ্বল বন্যার কলগ্রাসে
শত্রুরা নিশ্চল হয়েছে
কোটি কোটি প্রাণ দিকে দিকে ওই
বন্ধ কারার দ্বার খুলছে, বন্ধ কারার দ্বার খুলছে
বাংলার ঘরে ঘরে
মুক্তির আলোয় ঝরছে,
মুক্তির আলোয় ঝরছে,
মুক্তির আলোয় ঝরছে।