গত আট বছরে ১৩শ’ মাদ্রাসায় অবকাঠামো নির্মাণ করতে গড়ে ৭০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। বিপরীতে মাত্র এক চতুর্থাংশ সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে গড়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাত্র বারোটির অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। এর খরচও স্বল্প। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসার প্রতিই সরকারের বেশি আগ্রহ- এমনটা জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা মূল ধারার হলেও গত আট বছরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে মাদ্রাসার শিক্ষার প্রতিই সরকারের আগ্রহ বেশি দেখা গেছে। মাদ্রাসার কারিগরি কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী পূর্বপশ্চিমকে অভিযোগ করেন, ‘ কেবল শিক্ষানীতিতেই কারিগরির কথা বলা হয়েছে। এসবের বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। নইলে আট বছরে মাত্র ১২ টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ হবে কেন? আসলে রাজনৈতিক ফায়দার দিকে বেশি ঝুকছে। সেজন্য মাদ্রাসার উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত। শত শত মাদ্রাসার উন্নয়ন হচ্ছে, ল্যাব স্থাপন হচ্ছে, কিন্তু সারাদেশের প্রায় চার হাজার কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করুণ দশা চলছে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার ধারায় আনতেই মাদ্রাসার উন্নয়ন করছে সরকার। এজন্য ধারাবাহিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৩ নম্বরটি ছিল মাদ্রাসা সংক্রান্ত। ওইসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের তাগাদার অংশ হিসেবে সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি তাগাদাপত্র পাঠানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে। মাদ্রাসা আর টোল শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এ লক্ষে যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি করতে হবে।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে সময়াবদ্ধ কর্ম-পরিকল্পনা জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার থেকে মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন ও কারিকুলাম আধুনিকায়নের জন্য বারবার চাপ আসছে শিক্ষা প্রশাসনের ওপর। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পৃথক মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দও নিয়মিত বাড়ছে। মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যও নিয়মিত ডিও লেটার দিচ্ছেন। এসব কারণে প্রশাসন মাদ্রাসার উন্নয়নে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে যায়। যেটা কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে হয়না বললেই চলে।
সূত্র জানায়, দেশে প্রায় ১৬ হাজার এমপিওভুক্ত ও আংশিক এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা রয়েছে। এসবের কার্যক্রম তদারকি করারও যেন কেউ নেই। অভিযোগ আছে, মাদ্রাসার সুপার ও শিক্ষক-কর্মচারীদের ঢালাওভাবে এমপিওভুক্তি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। অথচ সকল ধরনের মাদ্রাসাকে একটি সুষ্ঠু ধারার মধ্যে আনতে শিক্ষানীতিতে পরামর্শ থাকলেও দেশের প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদ্রাসা এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির পূর্বপশ্চিমকে বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন করে সাধারণ শিক্ষার ধারায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এখন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও বাংলা পড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মাদ্রাসার উন্নয়ন করা গেলেও কওমি মাদ্রাসার ওপর প্রশাসনের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হলেও কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিরা এটা মানেননি। তারা শিক্ষার মূল ধারায় আসতেও নারাজ। তবে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হলে কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য হতো।’
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে থাকা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি) এর প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মো. হানজালা পূর্বপশ্চিমকে জানান, ‘মাদ্রাসার উন্নয়নে এই সরকারই সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। গত আট বছরে সারাদেশে এক হাজার ৩৩২টি মাদ্রাসায় নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন আরও দুই হাজার মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মূল ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে। মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রী ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হতে পারছে। পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করতে পারছে।’এটাই তো বড় অর্জন।