গোল্ড আনোয়ারের’ টাকার খনি রূপালী ব্যাংক

ফেনীর এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়াই ১৫১ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে ৬০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। বাকি ঋণের মধ্যে ৭৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই। এর কোনো নথিও এখন পাওয়া যাচ্ছে না।

ফেনীর মাত্র ৩৩ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ীর নাম আনোয়ার হোসেন। তবে এখন নিজের নাম লেখেন আনোয়ার চৌধুরী। ফেনী শহরে তাঁর দুটি সোনার দোকান আছে। এই ব্যবসাতেই দেড় শ কোটি টাকার বেশি অর্থায়ন করেছে রূপালী ব্যাংক। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ পাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন এখন তাঁকে ডাকে ‘গোল্ড আনোয়ার’ বলে।

আনোয়ার হোসেনকে নিয়মনীতি ছাড়া বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত থেকেছেন ব্যাংকটির একদম শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে ব্যাংকের মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন উচ্চপর্যায়ের নির্দেশের কথা। আর পর্ষদের সদস্যরা বলছেন, দায়ী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে টাকা নিয়ে গেছে, এটা তো অকল্পনীয় ব্যাপার। নিশ্চয়ই ওপরের কারও যোগসাজশ আছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে শাখা পর্যন্ত দুর্নীতি হয়েছে। পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা—পুরো ব্যবস্থাটা এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনের ঘটনা কারও পক্ষে একা ঘটানো সম্ভব নয়। ক্ষমতাধরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েই এসব ঘটনা ঘটেছে।

আনোয়ার হোসেন নিজেও এখন স্বীকার করেছেন যে তাঁর ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। ২১ নভেম্বর ফেনীতে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বসে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি অন্যায়ভাবে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছি এটা সত্য।’ তিনি সব অর্থ ফেরত দেবেন এবং দিচ্ছেন বলে জানান। রূপালী ব্যাংক জানিয়েছে, ৫০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে।

আনোয়ার হোসেনকে সব ধরনের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া শুরু হয় মূলত ২০১৪ সাল থেকে। এ সময় হল-মার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে ব্যাংকিং মহলে ছিল তোলপাড়। আর এরই মধ্যে রূপালী ব্যাংক কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনেই উদার হস্তে অর্থায়নসুবিধা দিয়েছে আনোয়ার হোসেন বা আনোয়ার চৌধুরীকে।

রূপালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নথিতে দেখা যাচ্ছে, ঋণের পুরোটাই স্বর্ণ ব্যবসার নামে নেওয়া হলেও এ দিয়ে কেনা হয়েছে জমি। এখন ফেনীতেই তাঁর প্রায় দেড় হাজার শতক জমির মালিকানা রয়েছে।

আনোয়ার হোসেনকে ঋণ দেওয়ার সময় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন এম ফরিদ উদ্দিন। গত ৬ জুলাই তিনি অবসরে গেছেন। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সাবেক সিনিয়র সচিব মনজুর হোসেন। আর এই ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বলে সবচেয়ে বেশি এসেছে সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কাজী নেয়ামত উল্লাহর নাম। তাঁর বাড়িও ফেনীতে। ঋণ অনুমোদনের সময় তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ ঋণ বিশেষজ্ঞের দায়িত্বে ছিলেন। আর এখন চুক্তির ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালন বিভাগের প্রধান। অথচ তাঁর বিরুদ্ধেই অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ভঙ্গের অভিযোগ এখন সবচেয়ে বেশি। ওই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে জমি কেনাবেচাও করেছেন নেয়ামত উল্লাহ।

রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি এম ফরিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাখা অফিসের ঋণ প্রস্তাব কুমিল্লা মহাব্যবস্থাপকের মাধ্যমে প্রধান কার্যালয়ে এসেছে, পরিচালনা পর্ষদ তা অনুমোদন করেছে। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে নেয়ামত উল্লাহর কারণে গ্রাহক অতিরিক্ত সুবিধা পেয়েছেন।’

ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কেই রূপালী ব্যাংকের ইসলামপুর রোড শাখা। ব্যবস্থাপকের কক্ষ, ভল্ট, ক্যাশ কাউন্টারসহ সব মিলিয়ে শাখার আয়তন ১ হাজার ৪০০ বর্গফুট। ব্যবসায়িক ঋণগ্রহীতা হাতে গোনা মাত্র পাঁচজন। এই শাখার মোট ঋণ ১৫২ কোটি টাকা, যার মধ্যে আনোয়ার হোসেনই নিয়েছেন ১৫১ কোটি টাকা। তবে এখন আর এসব ঋণের কোনো নথিপত্র ওই শাখায় নেই। ফেনী জোনাল কার্যালয় থেকেও আনোয়ার হোসেনকে দেওয়া ঋণের নথিপত্র উধাও হয়ে গেছে।

২০ ও ২১ নভেম্বর ফেনী শহরের কয়েকটি ব্যাংক ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এবং রূপালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নথি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

২১ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের মহিপাল শাখায় গিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালের বিভিন্ন সময়ে আনোয়ার হোসেনের মালিকানাধীন নিউ রূপসী জুয়েলার্সকে ২৪ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণ নিয়ে ফেনী শহরে ৬৭৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনেন গ্রাহক। ২০১৫ সালে রূপালী ব্যাংকের ইসলামপুর রোড শাখা থেকে ঋণ নিয়ে সোনালী ব্যাংকের ওই ঋণ পরিশোধ করেন আনোয়ার হোসেন।

সোনালী ব্যাংক ছেড়ে ২০১২ সালে রূপালী ব্যাংকের ফেনী করপোরেট শাখা থেকে নিউ রূপসী জুয়েলার্সের নামে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেন আনোয়ার হোসেন। ২০১৪ সালে তাঁকে আরও ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দেয় ইসলামপুর রোড শাখা। এখান থেকে ঋণ নিয়ে ফেনী করপোরেট শাখার ঋণ পরিশোধ করা হয়। পরে ঋণের সীমা বাড়িয়ে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা করা হয়। এ ঋণ নেওয়ার পরই ফেনীর বিভিন্ন মৌজায় আনোয়ার হোসেন ৫৮ শতাংশ জমি কেনেন। পরে এসব জমি দেখিয়ে ঋণ বাড়িয়ে ১৮ কোটি টাকা করা হয়। এরপর ফেনীর বিভিন্ন মৌজায় ১ হাজার ২৫৮ শতক জমি কেনেন তিনি।

এসব জমিই পরে দেড় শ কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে মেসার্স দেশ জুয়েলার্স নামে নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণের আবেদন করেন আনোয়ার হোসেন। চলতি বছরের ২৪ মার্চ নতুন এই প্রতিষ্ঠানের নামে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ৬০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। শাখার ঋণ আবেদন জোনাল অফিসের মাধ্যমে প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। রূপালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তা অনুমোদনও করা হয়।

রূপালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুর হোসেন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই ঋণ প্রস্তাব পর্ষদে নিয়ে আসে। প্রস্তাবের বাইরে আমাদের কিছু জানা সম্ভব হয় না। ভুল হয়ে থাকলে তাদের দোষ হবে।’

২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে রূপালী ব্যাংকের পরিচালক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ। তিনি আওয়ামী লীগের আগের কমিটির কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক ছিলেন। পর্ষদের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই সদস্য গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্ষদে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এমনভাবে উপস্থাপন করেছিল, মনে হয় ৫০০ কোটি টাকা দেওয়া দরকার। আমরা যাচাই-বাছাই করে ৬০ কোটি টাকা দিয়েছি।’

তবে আনোয়ার হোসেনের নতুন প্রতিষ্ঠান দেশ জুয়েলার্স উদ্বোধন হয় চলতি ২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল। আর ঋণ অনুমোদন হয় ২৪ মার্চ। এই ঋণ অনুমোদনের জন্য আবেদনপত্রে তিন বছরের ব্যবসায়িক নথিপত্রও উপস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে শাখা থেকে ৬০ কোটি টাকা ঋণ উত্তোলন করা হয়।

ওই সময়ের ফেনী জোনাল কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক কাজী মহিবুর রহমান বর্তমানে নোয়াখালী জোনাল অফিসে কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা হয়েছে সব ওপরের নির্দেশেই হয়েছে।’

ইসলামপুর রোড শাখায় গিয়ে জানা গেল, ৬০ কোটি টাকা পাওয়ার পর এখান থেকে নতুন করে আরও ৮০ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। এরপর অনুমোদন ছাড়াই কয়েক দফায় ৭৩ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দেয় ব্যাংক। এসব ঋণের বিপরীতে শাখা, জোনাল অফিস ও প্রধান কার্যালয়—কোথাও কোনো নথিপত্র নেই। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আনোয়ার হোসেনের কাছে গেছে ১৫১ কোটি টাকা।

ওই সময়ের শাখা ব্যবস্থাপক এরশাদ উল্লাহ বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জোনাল কার্যালয়ের কাজী মহিবুর রহমান ও মো. সোলায়মানের নির্দেশে আমি অনুমোদন ছাড়াই ঋণ বিতরণ করেছি। বিভিন্ন সময়ে ঋণ প্রস্তাব পাঠানোর এক সপ্তাহের মধ্যে অনুমোদন হয়ে এসেছে। গ্রাহক নিজেই ঢাকায় গিয়ে অনুমোদন করে এনেছেন। ভাবছিলাম এটাও হয়ে যাবে, তাই আমিও দিয়ে দিয়েছি।’

এরশাদ উল্লাহ আরও বলেন, ‘আমি ছোট শাখা ব্যবস্থাপক ছিলাম, এত ক্ষমতা তো আমার নেই। সবকিছুই ওপর মহলের নির্দেশে হয়েছে। কিছু রাজনৈতিক ব্যাপারও আছে।’

ইসলামপুর শাখার ব্যবস্থাপক এরশাদ উল্লাহ সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর দায়িত্ব নিয়েছেন গোপালচন্দ্র নাথ। ২০ নভেম্বর নিজ কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনুমোদন ছাড়া যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার কোনো নথিপত্র শাখায় নেই।’

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দুজনই ফেনীর বাসিন্দা হওয়ায় ব্যাংকটির সাবেক ডিএমডি কাজী নেয়ামত উল্লাহর সঙ্গে গ্রাহক আনোয়ার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা ছিল। ফেনীর স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, নিজের ভাইয়ের জমি আনোয়ার হোসেনের কাছ উচ্চ দামে বিক্রিও করেছেন নেয়ামত উল্লাহ।

নেয়ামত উল্লাহ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, গ্রাহকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকলেও অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর সঙ্গে পারিবারিক জমিও কেনাবেচা হয়নি।

তবে আনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো চোর-ডাকাত না। ব্যবসা করি, এটা নিয়েই থাকতে চাই। নেয়ামত উল্লাহর ভাইয়ের জমি কিনেছি এটা সত্য। আরও অনেকের জমি কেনা হয়েছে, ওনার ভাইয়ের জমিও ছিল এর মধ্যে।’

আনোয়ার হোসেনের প্রতি রূপালী ব্যাংকের উদার হস্ত বন্ধ হয়েছে মূলত গত জুলাই মাসে নতুন এমডি আসার পর। ব্যাংকটির নতুন এমডি আতাউর রহমান প্রধান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তার কোনো নথিপত্র নেই। এ ঘটনায় দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত চলছে, যাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, সবাইকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। অতিরিক্ত নেওয়া অর্থের প্রায় ৫০ কোটি টাকা আদায় করা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা রূপালী ব্যাংকেরও পর্যবেক্ষক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটি আমি শুনেছি। তারা অর্থ আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যাংকের লোকেরাই জড়িত বলে শুনেছি।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর