ঢাকার প্রথম জননির্বাচিত মেয়র

বঙ্গভবন এলাকা থেকে হালে আমরা লহমায় চলে যাই দনিয়া এলাকায়। উড়ালসেতুর আশীর্বাদেই যাত্রাবাড়ি মোড়ের চিরচেনা যানজটে এখন আর ঘন্টা পার হয় না আমাদের। সেতুর দৌলতে আমরা গাড়ি হাঁকিয়ে, বাসে চড়ে সাঁই সাঁই করে চলে যাই কখনো নারায়নগঞ্জে, কখনো গুলিস্তানে। আর আমাদের মনে পড়ে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের কথা।

২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর চালু এই উড়ালিয়া সেতুর নাম রাখা হয়েছে ঢাকার সাবেক এই মেয়রের নামে। তিনি ইতিহাস হয়ে আছেন এই কারণে নয়, অন্য এক কারণে। যে কীর্তি তিনি গড়েছেন, তা আর কেউ ভাঙতে পারবে না। তিনিই যে ঢাকার প্রথম জননির্বাচিত মেয়র। এর মহিমা বুঝতে ইতিহাসের আরো পাতা উল্টাতে হবে আমাদের। চলুন উল্টাই। নাজির হোসেন বিরচিত ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ আমাদের সামনে।

তার বিবরণ থেকে জানা যায়, ঢাকার উন্নয়নের তাগিদে প্রথম গড়ে উঠেছিলো ঢাকা কমিটি।
১৮৬৪ সালের ১ আগস্ট ঢাকা পৌরসভা (মিউনিসিপ্যালিটি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ আমলে ঢাকা পৌরসভায় ১৭ জন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে প্রথম তিনজন বাদে বাকি ১৪ জন ছিলেন কমিশনারদের ভোটে নির্বাচিত। পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তখনকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্কিনার। ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকার বলে এ পদে নিয়োগ পেতেন। প্রথম তিন চেয়ারম্যান, স্কিনার, ড. লাইএ্যল ও জে ব্রাডব্যারিকে নিয়োগ দেন ব্রিটিশ বাংলার গভর্নর। একটি কমিটির মাধ্যমে তারা ঢাকার সেবা ও প্রশাসন ব্যবস্থা তদারক করতেন।

প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পরই ঢাকা পৌরসভা আমলাতন্ত্র থেকে মুক্তি লাভ করে। কমিশনারদের মতামতের ভিত্তিতেই পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচন করার ইতিহাস সৃষ্টি হয় ১৮৮৪ সালে। কমিশনাররা মনস্থির করলেন, তাঁরাই তাঁদের নেতা ঠিক করবেন। তাঁরা গোপনে ভোট দিয়ে আরেক কমিশনার আনন্দ চন্দ্র রায়কে প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে সরাসরি জনতার ভোটে নির্বাচিত নন। আবার তার পদটি ছিলো ‘চেয়ারম্যান’।

ঢাকা পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত মুসলমান চেয়ারম্যান ছিলেন খাজা আসগর। তিনি ১৮৯১ সালে নির্বাচিত হন। খাজা আসগর ১৮৭৪ সালে মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার মনোনীত হন। ১৮৭৯ সালে সরকার তাকে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর হতে সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিই চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৭ সালের পৌরসভা অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর হতেই চেয়ারম্যানের সাথে সাথে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতি চালু হয়।

১৯৭৭ সালে একটি নতুন পৌরসভা অর্ডিন্যান্স ঘোষিত হলেও একটি স্বতন্ত্র অর্ডিন্যান্স মোতাবেক ঢাকার জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালে একটি স্বতন্ত্র অর্ডিন্যান্স ঢাকাকে একটি করপোরেশনে পরিণত করে। এর নাম রাখা হয় ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন’।

১৯৮৩ সালের অর্ডিন্যান্স মোতাবেক সরকার নির্ধারিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কাঠামো কিছুদিন অব্যাহত থাকে। কিন্তু ১৯৯০ সালে বিভাগীয় কমিশনারকে পদাধিকার বলে মেয়রের পদ প্রদান করা হয়। ১৯৮৩ সালের ঢাকা সিটি কর্পোরেশন আইন ১৯৯৩ সালে সংশোধন করা হয়।

ঢাকা পৌরসভাকে ঢাকা পৌর করপোরেশনে পরিণত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে। ঢাকা পৌর কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। ঢাকা পৌর কপোরেশন ঢাকা সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয় ১৯৯০ সালে। নতুন আইন অনুযায়ী প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার ১৩০ বছর পর ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রত্যক্ষ সর্বজনীন ভোটে মেয়র ও কমিশনার নির্বাচন হয়। ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ।

মেয়র পদে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ হানিফের অবিস্মরণীয় বিজয় আওয়ামী লীগের জন্য ছিল এক টার্নিং পয়েন্ট। ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মোহাম্মদ হানিফ এক লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির মির্জা আব্বাসকে পরাজিত করে সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
ঢাকার প্রথম জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র হিসেবে মোহাম্মদ হানিফ নিজেই ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন। আবার তিনি ঢাকার ইতিহাস সুরক্ষার দিকেও সুদৃষ্টি দিয়েছিলেন। এখনকার ঢাকা দক্ষিণ সিটির নগর ভবনে গেলে ঢাকার ইতিহাসে সমৃদ্ধ নগর জাদুঘর চোখে পড়ে। এর যাত্রা শুরু হয় মেয়র হানিফের হাত ধরেই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর