ঢাকা ১২:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশকে টার্গেট করে সক্রিয় স্বর্ণ চোরাচালানিরা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ১০ বার

স্বর্ণ পাচারের নিরাপদ ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র। আকাশপথ, সমুদ্রপথ ও স্থলপথ গলিয়ে সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে চোরাইপথে প্রতিদিনই দেশে আসছে স্বর্ণ। এরপর সীমান্তের চোরাইপথে সেই স্বর্ণ পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতে। অরক্ষিত তিন পথে (আকাশ, সমুদ্র ও স্থল) প্রতিদিন চোরাচালানের মাধ্যমে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও বার বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, গত ৫ বছরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই জব্দ করা হয় ২ হাজার ২৩৩ কেজি স্বর্ণ। আর গত ১০ বছরে চোরাই পথে দেশে আসা স্বর্ণের ৯০ শতাংশই বিভিন্ন জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে গেছে। সম্প্রতি বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বর্ণ পাচার ও চোরাচালানে জড়িতদের কেউ কারবারি, কেউ পৃষ্ঠপোষক, কেউ বাহক। চোরাই স্বর্ণ বহনের সময় কালেভদ্রে কিছু বাহককে গ্রেপ্তার করা গেলেও বরাবরই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে চোরাচালান চক্রের গডফাদাররা। ফলে অধিক লাভের আশায় চাহিদা অনুযায়ী স্বর্ণালংকার তৈরির চেয়ে চোরাচালানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে অধিকাংশ স্বর্ণ ব্যবসায়ী। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের তালিকা ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

জানা গেছে, ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে সম্প্রতি স্বর্ণ চোরাচালান করছে চক্রের সদস্যরা। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রবাসীদের। ব্যাগেজ রুলস ব্যবহার করে এক শ্রেণির যাত্রী ভ্রমণের নামে নিয়মিতই বিদেশ থেকে স্বর্ণ নিয়ে আসেন। অন্য চক্রের সদস্যরা ট্যাক্স দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ দেশে এনে তুলে দিচ্ছে চোরাচালান চক্রের হাতে। পরে চক্রের হোতারা সেই স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে পাচার করে দিচ্ছে। ব্যাগেজ রুলসের এই অপব্যবহার ঠেকাতে এতে পরিবর্তন আনছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব চক্রের শতাধিক নারী-পুরুষের তালিকা নিয়ে তদন্তে নেমেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ ও গোয়েন্দারা। ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার ঠেকাতে গত বছর রুলস সংশোধন করা হয়। এবার এতে আরও পরিবর্তন আনতে কাজ শুরু করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা কাস্টম হাউজ সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরেই জব্দ করা হয়েছে ২ হাজার ২৩৩ দশমিক ২৭৯ কেজি চোরাই স্বর্ণ। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে খালাসকৃত ১১ হাজার ৩৪৬ কেজি ৬৭১ গ্রাম স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে জব্দ স্বর্ণের পরিমাণ ৫০৭ কেজি ৮৩৮ গ্রাম; ২০২১-২২ অর্থবছরে খালাস করা ৩১ হাজার ৩৮১ গ্রাম স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে জব্দ করা স্বর্ণের পরিমাণ ৬৯৭ কেজি ৬৬৯ গ্রাম; ২০২২-২৩ অর্থবছরে খলাসকৃত ৪৩ হাজার ২০ কেজি স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে জব্দ স্বর্ণের পরিমাণ ৫৫৭ কেজি ৬৪৩ গ্রাম; ২০২৩-২৪ অর্থবছর খালাস ১৭ হাজার ৮৯৪ কেজি ৩৭৫ গ্রাম স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে জব্দ স্বর্ণের পরিমাণ ৪১৭ কেজি ৪৩৫ গ্রাম এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (অক্টোবর পর্যন্ত) খালাসকৃত ১ হাজার ২৬০ কেজি স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে ৫৫ কেজি ৬৯৪ গ্রাম চোরাই স্বর্ণ জব্দ করা হয় এই বিমানবন্দরে।

কাস্টমস সূত্র বলছে, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বৈধভাবে আনা এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দেশে নেই। কোনো না কোনোভাবে দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। চলমান ব্যাগেজ রুলসে একজন যাত্রী কতবার স্বর্ণ আনতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করা নেই। এবার ব্যাগেজ রুলস সংশোধন করে একজন যাত্রী বছরে কতবার স্বর্ণ আনতে পারবেন, তা বেঁধে দেওয়া হবে। একজন বছরে ৩ বারের বেশি স্বর্ণ আনতে পারবেন না। এ জন্য একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হচ্ছে, যেখানে এই স্বর্ণ আনা যাত্রীদের তথ্য থাকবে। এতে বছরে তিনবারের বেশি কোনো যাত্রী স্বর্ণ আনলে তার বিদেশ যাওয়াও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

শাহজালাল বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্র জানায়, যারা নিয়মিতভাবে বিদেশ গিয়ে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় স্বর্ণ এনেছেন, এ রকম যাত্রীদের তালিকা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকশ ব্যক্তিকে, যারা নিয়মিত দুবাই বা সৌদি আরব গিয়ে স্বর্ণ এনে দেশে চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেন। বর্তমান ব্যাগেজ রুলসে একজন ব্যক্তি একটি করে স্বর্ণের বার আনার বিধান রয়েছে। তাতে একটি বারের ১১৬/১১৭ গ্রাম ওজনের বারে ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। এভাবে একজন যাত্রী যতবার ইচ্ছা স্বর্ণ আনতে পারেন। এ জন্য চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিয়মিত দুবাই, সৌদি ও মালয়েশিয়ায় গিয়ে স্বর্ণের বার আনছেন। কিছু চোরাকারবারি আড়ালে থেকে যাত্রীদের টাকা দিয়ে স্বর্ণ আনাচ্ছেন।

ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার মোবারা খানম বলেন, ব্যাগেজ রুলসে পরিবর্তন আনার কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে একটি সফটওয়ার ডেভেলপ করা হয়েছে। স্বর্ণ চোরাচালান ঠেকাতে সোর্সের সহায়তা নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের পেছনে কিছু অর্থ ব্যয় করতে হয়; এটাকে বলে সোর্সমানি। কিন্তু আমাদের কাছে বর্তমানে সোর্সমানির সংকট রয়েছে। এই বিষয়ে আমরা এনবিআরকে অবহিত করেছি। যে যে দেশ থেকে স্বর্ণ আসে, সেই দেশের বিমানযাত্রীদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। যেসব যাত্রী ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করেন, তাদের একটি বড় অংশ স্বর্ণ পাচারে জড়িত। সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর যাতায়াতকারী এ ধরনের শতাধিক যাত্রীর তালিকা ইমিগ্রেশন পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। তারাও এদের বিষয়ে তদন্তে নেমেছেন।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সূত্র জানায়, বাংলাদেশ মূলত আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালান চক্রের ট্রানজিট রুট। স্বর্ণ চোরাচালান ও পাচারকারীদের চক্র ছড়িয়ে আছে দেশে-বিদেশে। সীমান্ত এলাকায়ও আছে পাচারকেন্দ্রিক চক্রের সদস্যরা। দেশে বৈধ-অবৈধ সোনা প্রবেশের মূল পথ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিছু আসে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। আকাশপথ, সমুদ্রপথ ও স্থলপথে দেশে প্রতিদিন চোরাচালানের মাধ্যমে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও বার প্রবেশ করছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ছে, তার চেয়ে পাচার হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি। বিমানবন্দর থেকে অবৈধ স্বর্ণের চালান বের করতে অর্থের বিনিময়ে সহযোগিতা করেন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) স্বর্ণ চোরাচালানের মাফিয়ার তালিকায় আছে শফিকুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন শফি। নব্বইয়ের দশকে ফেরি করে গামছা বিক্রি করতেন তিনি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষে হত্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে তিনি সখ্য গড়ে তোলেন। এই সখ্য কাজে লাগিয়ে তিনি একপর্যায়ে গড়ে তোলেন স্বর্ণ চোরাচালানের নেটওয়ার্ক। শফির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনের একটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আছে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের নামও। শফির অন্যতম সহযোগী মনির। ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তার বাসা থেকে বিপুল স্বর্ণ উদ্ধারের মামলায় অভিযোগ ‘প্রমাণিত না হওয়ায়’ সম্প্রতি তিনি খালাস পেয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আছে চট্টগ্রামের আবু আহমেদের নাম। তিনি চট্টগ্রামে সোনা চোরাচালানের গডফাদার। তার ৭২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে সিআইডি। সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট এ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে আদালতে।

এদিকে গত শনিবার চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরাত দুবাই ফেরত এক অভিনেত্রীসহ দুই যাত্রীর কাছ থেকে ৭৩৩ গ্রাম স্বর্ণালংকার জব্দ করে এনএসআই চট্টগ্রাম বিমানবন্দর টিম ও শুল্ক গোয়েন্দার কর্মকর্তারা। আটক ব্যক্তিরা হলেনÑ ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা নাট্যাভিনেত্রী অনামিকা জুথী ও চট্টগ্রামের রাউজানের মোহাম্মদ রায়হান ইকবাল।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বাংলাদেশকে টার্গেট করে সক্রিয় স্বর্ণ চোরাচালানিরা

আপডেট টাইম : ১১:৪৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

স্বর্ণ পাচারের নিরাপদ ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র। আকাশপথ, সমুদ্রপথ ও স্থলপথ গলিয়ে সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে চোরাইপথে প্রতিদিনই দেশে আসছে স্বর্ণ। এরপর সীমান্তের চোরাইপথে সেই স্বর্ণ পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতে। অরক্ষিত তিন পথে (আকাশ, সমুদ্র ও স্থল) প্রতিদিন চোরাচালানের মাধ্যমে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও বার বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, গত ৫ বছরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই জব্দ করা হয় ২ হাজার ২৩৩ কেজি স্বর্ণ। আর গত ১০ বছরে চোরাই পথে দেশে আসা স্বর্ণের ৯০ শতাংশই বিভিন্ন জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে গেছে। সম্প্রতি বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বর্ণ পাচার ও চোরাচালানে জড়িতদের কেউ কারবারি, কেউ পৃষ্ঠপোষক, কেউ বাহক। চোরাই স্বর্ণ বহনের সময় কালেভদ্রে কিছু বাহককে গ্রেপ্তার করা গেলেও বরাবরই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে চোরাচালান চক্রের গডফাদাররা। ফলে অধিক লাভের আশায় চাহিদা অনুযায়ী স্বর্ণালংকার তৈরির চেয়ে চোরাচালানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে অধিকাংশ স্বর্ণ ব্যবসায়ী। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের তালিকা ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

জানা গেছে, ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে সম্প্রতি স্বর্ণ চোরাচালান করছে চক্রের সদস্যরা। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রবাসীদের। ব্যাগেজ রুলস ব্যবহার করে এক শ্রেণির যাত্রী ভ্রমণের নামে নিয়মিতই বিদেশ থেকে স্বর্ণ নিয়ে আসেন। অন্য চক্রের সদস্যরা ট্যাক্স দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ দেশে এনে তুলে দিচ্ছে চোরাচালান চক্রের হাতে। পরে চক্রের হোতারা সেই স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে পাচার করে দিচ্ছে। ব্যাগেজ রুলসের এই অপব্যবহার ঠেকাতে এতে পরিবর্তন আনছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব চক্রের শতাধিক নারী-পুরুষের তালিকা নিয়ে তদন্তে নেমেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ ও গোয়েন্দারা। ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার ঠেকাতে গত বছর রুলস সংশোধন করা হয়। এবার এতে আরও পরিবর্তন আনতে কাজ শুরু করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা কাস্টম হাউজ সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরেই জব্দ করা হয়েছে ২ হাজার ২৩৩ দশমিক ২৭৯ কেজি চোরাই স্বর্ণ। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে খালাসকৃত ১১ হাজার ৩৪৬ কেজি ৬৭১ গ্রাম স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে জব্দ স্বর্ণের পরিমাণ ৫০৭ কেজি ৮৩৮ গ্রাম; ২০২১-২২ অর্থবছরে খালাস করা ৩১ হাজার ৩৮১ গ্রাম স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে জব্দ করা স্বর্ণের পরিমাণ ৬৯৭ কেজি ৬৬৯ গ্রাম; ২০২২-২৩ অর্থবছরে খলাসকৃত ৪৩ হাজার ২০ কেজি স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে জব্দ স্বর্ণের পরিমাণ ৫৫৭ কেজি ৬৪৩ গ্রাম; ২০২৩-২৪ অর্থবছর খালাস ১৭ হাজার ৮৯৪ কেজি ৩৭৫ গ্রাম স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে জব্দ স্বর্ণের পরিমাণ ৪১৭ কেজি ৪৩৫ গ্রাম এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (অক্টোবর পর্যন্ত) খালাসকৃত ১ হাজার ২৬০ কেজি স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারের মধ্যে ৫৫ কেজি ৬৯৪ গ্রাম চোরাই স্বর্ণ জব্দ করা হয় এই বিমানবন্দরে।

কাস্টমস সূত্র বলছে, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বৈধভাবে আনা এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দেশে নেই। কোনো না কোনোভাবে দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। চলমান ব্যাগেজ রুলসে একজন যাত্রী কতবার স্বর্ণ আনতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করা নেই। এবার ব্যাগেজ রুলস সংশোধন করে একজন যাত্রী বছরে কতবার স্বর্ণ আনতে পারবেন, তা বেঁধে দেওয়া হবে। একজন বছরে ৩ বারের বেশি স্বর্ণ আনতে পারবেন না। এ জন্য একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হচ্ছে, যেখানে এই স্বর্ণ আনা যাত্রীদের তথ্য থাকবে। এতে বছরে তিনবারের বেশি কোনো যাত্রী স্বর্ণ আনলে তার বিদেশ যাওয়াও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

শাহজালাল বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্র জানায়, যারা নিয়মিতভাবে বিদেশ গিয়ে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় স্বর্ণ এনেছেন, এ রকম যাত্রীদের তালিকা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকশ ব্যক্তিকে, যারা নিয়মিত দুবাই বা সৌদি আরব গিয়ে স্বর্ণ এনে দেশে চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেন। বর্তমান ব্যাগেজ রুলসে একজন ব্যক্তি একটি করে স্বর্ণের বার আনার বিধান রয়েছে। তাতে একটি বারের ১১৬/১১৭ গ্রাম ওজনের বারে ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। এভাবে একজন যাত্রী যতবার ইচ্ছা স্বর্ণ আনতে পারেন। এ জন্য চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিয়মিত দুবাই, সৌদি ও মালয়েশিয়ায় গিয়ে স্বর্ণের বার আনছেন। কিছু চোরাকারবারি আড়ালে থেকে যাত্রীদের টাকা দিয়ে স্বর্ণ আনাচ্ছেন।

ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার মোবারা খানম বলেন, ব্যাগেজ রুলসে পরিবর্তন আনার কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে একটি সফটওয়ার ডেভেলপ করা হয়েছে। স্বর্ণ চোরাচালান ঠেকাতে সোর্সের সহায়তা নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের পেছনে কিছু অর্থ ব্যয় করতে হয়; এটাকে বলে সোর্সমানি। কিন্তু আমাদের কাছে বর্তমানে সোর্সমানির সংকট রয়েছে। এই বিষয়ে আমরা এনবিআরকে অবহিত করেছি। যে যে দেশ থেকে স্বর্ণ আসে, সেই দেশের বিমানযাত্রীদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। যেসব যাত্রী ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করেন, তাদের একটি বড় অংশ স্বর্ণ পাচারে জড়িত। সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর যাতায়াতকারী এ ধরনের শতাধিক যাত্রীর তালিকা ইমিগ্রেশন পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। তারাও এদের বিষয়ে তদন্তে নেমেছেন।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সূত্র জানায়, বাংলাদেশ মূলত আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালান চক্রের ট্রানজিট রুট। স্বর্ণ চোরাচালান ও পাচারকারীদের চক্র ছড়িয়ে আছে দেশে-বিদেশে। সীমান্ত এলাকায়ও আছে পাচারকেন্দ্রিক চক্রের সদস্যরা। দেশে বৈধ-অবৈধ সোনা প্রবেশের মূল পথ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিছু আসে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। আকাশপথ, সমুদ্রপথ ও স্থলপথে দেশে প্রতিদিন চোরাচালানের মাধ্যমে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও বার প্রবেশ করছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ছে, তার চেয়ে পাচার হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি। বিমানবন্দর থেকে অবৈধ স্বর্ণের চালান বের করতে অর্থের বিনিময়ে সহযোগিতা করেন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) স্বর্ণ চোরাচালানের মাফিয়ার তালিকায় আছে শফিকুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন শফি। নব্বইয়ের দশকে ফেরি করে গামছা বিক্রি করতেন তিনি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষে হত্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে তিনি সখ্য গড়ে তোলেন। এই সখ্য কাজে লাগিয়ে তিনি একপর্যায়ে গড়ে তোলেন স্বর্ণ চোরাচালানের নেটওয়ার্ক। শফির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনের একটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আছে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের নামও। শফির অন্যতম সহযোগী মনির। ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তার বাসা থেকে বিপুল স্বর্ণ উদ্ধারের মামলায় অভিযোগ ‘প্রমাণিত না হওয়ায়’ সম্প্রতি তিনি খালাস পেয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আছে চট্টগ্রামের আবু আহমেদের নাম। তিনি চট্টগ্রামে সোনা চোরাচালানের গডফাদার। তার ৭২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে সিআইডি। সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট এ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে আদালতে।

এদিকে গত শনিবার চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরাত দুবাই ফেরত এক অভিনেত্রীসহ দুই যাত্রীর কাছ থেকে ৭৩৩ গ্রাম স্বর্ণালংকার জব্দ করে এনএসআই চট্টগ্রাম বিমানবন্দর টিম ও শুল্ক গোয়েন্দার কর্মকর্তারা। আটক ব্যক্তিরা হলেনÑ ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা নাট্যাভিনেত্রী অনামিকা জুথী ও চট্টগ্রামের রাউজানের মোহাম্মদ রায়হান ইকবাল।