ঢাকা ০৭:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিখ্যাত সাহাবীদের রাসূল প্রেম

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৩০:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ২২ বার

আল্লাহকে পেতে হলে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সা.) ভালোবাসতে হবে। এটাই প্রধান শর্ত। রাসূল খুশি হলে আল্লাহ খুশি। রাসূল অখুশি হলে আল্লাহ অখুশি। তাই রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত রাখা ঈমানের অঙ্গ। রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া কেউ মুমিন বলেই গণ্য হবে না।

প্রেম-ভালোবাসা-আসক্তি যথেষ্ট আপেক্ষিক বিষয়। কোন কিছুকে দেখা, জানা, বোঝা ও উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে বিষয়টি। উপলব্ধি যত সুন্দর হবে ভালোবাসাও তত গভীর।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি ভালোবাসা তাদেরই বেশি, যারা তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর সাহাবীগণ ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁকে অতি নিকট থেকে নিরীক্ষণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁদের। তাই সাহাবীরা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.-এর শান, মান ও মর্যাদা।

সে জন্য সর্বোতভাবেই তারা রাসূল সা. এর সাহচর্য লাভের জন্য উদগ্রীব থাকতেন। পরিপূর্ণভাবে রাসূলুল্লাহ সা.-এর অনুসরণের জন্য এবং নিজ জীবনের বিনিময়ে হলেও রাসূলুল্লাহ সা.-এর ভালোবাসা অর্জনের জন্য কখনো পিছপা হতেন না। বরং সেটাকে তারা পরম সুযোগ ও সৌভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন।

আমাদের হৃদয়েও যেন এ বিশ্বাস গ্রথিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি ভালোবাসাই আমাদের ঈমান। এ বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় ও মজবুত করার অভিপ্রায়ে এ প্রবন্ধে নিবেদন করছি ঐতিহাসিক কয়েকটি ঘটনা। যাতে রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি সাহাবীদের ভক্তি, গভীর ভালোবাসা, সম্মান ও আনুগত্যের পরিচয় পাওয়া যাবে।

এক. রাসূলুল্লাহ সা.-এর অতি ঘনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন হযরত আলী রা.। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রেমে মুগ্ধ ও আত্মহারা। রাসূলকে সাহায্যের অভিপ্রায়ে তিনি একাধিক বার নিজ জীবনকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছিলেন।

হিজরতের সময় অধিকাংশ মুসলমান মক্কা ছেড়ে মদীনা চলে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখনও আল্লাহর হুকুমের প্রতীক্ষায় আছেন। এদিকে মক্কার ইসলামবিরোধী কুরাইশরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাসূল সা. কে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেবে।

আল্লাহপাক জিব্রাঈল মারফত এ খবর রাসূল সা. কে জানিয়ে দেন। তিনি মদীনায় হিজরতের অনুমতি লাভ করলেন। তাঁর হিজরতের সংবাদ যদি কাফেররা জানতে পারে তবে তারা তাঁর পিছু নিবে। তাই কাফেরদের যাতে সন্দেহ না হয় সে জন্য রাসূল সা.-এর বিছানায় কারো রাত্রিযাপন করা প্রয়োজন। যাতে সে সময়ের মধ্যে তিনি শত্রুর নাগালের বাইরে চলে যেতে পারেন।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর বিছানায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ঘুমানোর দুঃসাহসিক কাজটি করেছিলেন হযরত আলী রা.। রাসূলুল্লাহ সা. যে চাদরটি গায়ে দিয়ে ঘুমাতেন সেই সবুজ রংয়ের চাদরটি গায়ে জড়িয়ে হযরত আলী রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর বিছানায় শুয়ে থাকেন।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর ঘরের দরজার কাছেই ছিল তলোয়ার শানিত শত্রু  কুরাইশ যুবকদের ভয়ঙ্কর পাহারা দল। তারা সশস্ত্র অবস্থায় সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। রাসূলুল্লাহ সা. ঘর থেকে বের হওয়ার সময় এক মুঠি মাটি কুরাইশ যুবকদের উদ্দেশে ছুড়ে দেন। ফলে আল্লাহতায়ালা অপেক্ষমাণ কুরাইশ দলের দৃষ্টিশক্তি আচ্ছন্ন করে দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ সা. কে দেখতে পেল না। তারা যেন দেখছিল যে, তিনি নিজ বিছানায় ঘুমিয়ে আছেন।

নবীজীর জীবন রক্ষার তাগিদে নিজ জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন হযরত আলী রা. তিনি জানতেন যে, নবীজীর বিছানায় ঘুমানোর সময় যে কোন মুহূর্তে তার জীবননাশ হতে পারে। তা সত্ত্বেও তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছিলেন যেন রাসূল সা. নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে পারেন। রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি অতিশয় ভালোবাসা ও মহব্বত থাকার কারণেই হযরত আলী রা.-এর পক্ষে এমন দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়েছিল।

দুই. খন্দকের যুদ্ধে সালা পর্বতের এক উপত্যকায় রাসূলুল্লাহ সা.-এর জন্য একটি তাঁবু নির্মাণ করা হয়। এক হিম ঠাণ্ডা রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. একাকী শুয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁবুর মধ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন কে? উত্তর পেলেন সাদ আবী ওয়াক্কাসের পুত্র। কি জন্য এসেছো?

সাদ বললেন সাদের হাজার জীবন অপেক্ষা আল্লাহর রাসূল হচ্ছেন তার প্রিয়তম। এ অন্ধকার হিম ঠাণ্ডা রাতে আপনার ব্যাপারে আমার ভয় হলো। তাই পাহারার জন্য হাজির হয়েছি। রাসূল সা.-এর জীবন ও ভালোবাসার তুলনায় কনকনে ঠাণ্ডা ও নিজ জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন সাহাবী সাদ রা.।

তিন. হিজরী তৃতীয় সনে মক্কার মুশরিকদের সাথে সংঘটিত হয় ওহুদের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয়ের দ্বার প্রান্তে পৌঁছেও তীরন্দাজ বাহিনীর ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এ সময় মুষ্টিমেয় কয়েকজন সৈনিক রাসূলুল্লাহ সা. কে ঘিরে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। হযরত আম্মার বিন ইয়াযিদ শহীদ হন। কাতাদা বিন নুমানের চোখে কাফেরদের নিক্ষিপ্ত তীর লাগলে চক্ষুকোটর থেকে মণিটি বের হয়ে তাঁর গণ্ডের ওপর ঝুলতে থাকে।

হযরত আবু দাজানা রাসূলুল্লাহ সা.-এর দিকে মুখ করে তাঁর পুরো দেহটি ঢাল বানিয়ে নেন। রাসূলুল্লাহ শরীরে কোন আঘাত যেন না লাগে। এ অবস্থায় সাহাবী আবু দাজানা আহত এবং রক্তাপ্লুত হয়েছেন। তখন মুসলমানদের মধ্যে হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তীর ছুড়েছিলেন। আর হযরত তালহা ইবনে উবায়দুল­াহ রা.-এর হাতে তলোয়ার ও অন্য হাতে বর্শা নিয়ে কাফেরদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে আনছারদের বারোজন এবং মুজাহিদদের মধ্যে হযরত তালহা রা. ছাড়া আর সকলে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। রাসূল সা. পাহাড়ের একটি চূড়ায় উঠলেন। এমন সময় একদল শত্রু সৈন্য তাঁকে ঘিরে ফেললো।

রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করলেন, কে আছো? যে হামলাকারীদের আমার কাছে থেকে হটিয়ে দিতে পার? হযরত তালহা এগিয়ে এলেন। রাসূল সা. তাঁকে বারণ করেন। তখন আনছারীদের একজন এগিয়ে আসলেন। তিনি কাফেরদের সাথে লড়াই করে শহীদ হলেন। আরও একজন আনছারী এগিয়ে আসলেন রাসূল সা.-এর জীবন রক্ষা করতে। তিনিও শহীদ হলেন। এভাবে একে একে সকল আনছার রাসূল সা.-এর প্রাণ রক্ষার্থে অবলীলায় শাহাদাত বরণ করলেন।

অবশেষে হযরত তালহা রা. এগিয়ে আসলেন। তিনি আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। তা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সা. আহত হলেন। তাঁর পবিত্র দান্দান মোবারক শহীদ হলো তিনি রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় হযরত তালহা রা. একবার মুশরিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের একটু দূরে তাড়িয়ে দেন। আবার রাসূল সা.-এর দিকে ছুটে এসে তাঁকে কাঁধে করে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে থাকেন।

একস্থানে রাসূল সা. কে রেখে আবার নতুন করে হামলা চালান। এভাবে সেদিন তিনি মুশরিকদের প্রতিহত করেন। রাসূল সা.এর প্রতি তার ভালোবাসা জয়ী হয়। হযরত আবু বকর রা. বলেন, এ সময় আমি ও আবু উবাইদা রাসূল সা. থেকে দূরে সরে পড়েছিলাম, কিছুক্ষণ পর আমরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে ফিরে সেবার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি বললেন, আমাকে ছাড় তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখ। আমরা তাকিয়ে দেখি তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞান হয়ে আছেন। তাঁর একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায়। আর সারা দেহে তরবারী ও তীর বর্শার সত্তরটির বেশি আঘাত।

এই ছিল রাসূল প্রেমের চিহ্ন। নিজ শরীর জখমের পর জখম হয়েছে তারপরও রাসূল সা. কে রক্ষা করছে তাঁরা- এটাকে শুধু ভালোবাসা বললে ভুল হবে। বরং ভালোবাসার চেয়েও অনেক বড় কিছু।

রাসূল সা.-এর প্রতি সাহাবীদের এ ভালোবাসা কে অন্যকোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের কোন উপায় নেই। শুধু আল্লাহকে পাওয়ার আকাঙ্খায় তাদের এ ব্যাকুলতা। পবিত্র কুরআনের বাণীই তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছে এ পথে চলতে।

তারা পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং রাসূল সা.-এর সান্নিধ্যে এসে এমন কিছু ঐশ্বরিকভাব অনুভব করেছিলেন যা তাদের হৃদয়কে রাসূল প্রেমে ভরিয়ে দিয়েছিল।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বিখ্যাত সাহাবীদের রাসূল প্রেম

আপডেট টাইম : ০৬:৩০:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আল্লাহকে পেতে হলে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সা.) ভালোবাসতে হবে। এটাই প্রধান শর্ত। রাসূল খুশি হলে আল্লাহ খুশি। রাসূল অখুশি হলে আল্লাহ অখুশি। তাই রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত রাখা ঈমানের অঙ্গ। রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া কেউ মুমিন বলেই গণ্য হবে না।

প্রেম-ভালোবাসা-আসক্তি যথেষ্ট আপেক্ষিক বিষয়। কোন কিছুকে দেখা, জানা, বোঝা ও উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে বিষয়টি। উপলব্ধি যত সুন্দর হবে ভালোবাসাও তত গভীর।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি ভালোবাসা তাদেরই বেশি, যারা তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর সাহাবীগণ ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁকে অতি নিকট থেকে নিরীক্ষণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁদের। তাই সাহাবীরা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.-এর শান, মান ও মর্যাদা।

সে জন্য সর্বোতভাবেই তারা রাসূল সা. এর সাহচর্য লাভের জন্য উদগ্রীব থাকতেন। পরিপূর্ণভাবে রাসূলুল্লাহ সা.-এর অনুসরণের জন্য এবং নিজ জীবনের বিনিময়ে হলেও রাসূলুল্লাহ সা.-এর ভালোবাসা অর্জনের জন্য কখনো পিছপা হতেন না। বরং সেটাকে তারা পরম সুযোগ ও সৌভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন।

আমাদের হৃদয়েও যেন এ বিশ্বাস গ্রথিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি ভালোবাসাই আমাদের ঈমান। এ বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় ও মজবুত করার অভিপ্রায়ে এ প্রবন্ধে নিবেদন করছি ঐতিহাসিক কয়েকটি ঘটনা। যাতে রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি সাহাবীদের ভক্তি, গভীর ভালোবাসা, সম্মান ও আনুগত্যের পরিচয় পাওয়া যাবে।

এক. রাসূলুল্লাহ সা.-এর অতি ঘনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন হযরত আলী রা.। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রেমে মুগ্ধ ও আত্মহারা। রাসূলকে সাহায্যের অভিপ্রায়ে তিনি একাধিক বার নিজ জীবনকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছিলেন।

হিজরতের সময় অধিকাংশ মুসলমান মক্কা ছেড়ে মদীনা চলে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখনও আল্লাহর হুকুমের প্রতীক্ষায় আছেন। এদিকে মক্কার ইসলামবিরোধী কুরাইশরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাসূল সা. কে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেবে।

আল্লাহপাক জিব্রাঈল মারফত এ খবর রাসূল সা. কে জানিয়ে দেন। তিনি মদীনায় হিজরতের অনুমতি লাভ করলেন। তাঁর হিজরতের সংবাদ যদি কাফেররা জানতে পারে তবে তারা তাঁর পিছু নিবে। তাই কাফেরদের যাতে সন্দেহ না হয় সে জন্য রাসূল সা.-এর বিছানায় কারো রাত্রিযাপন করা প্রয়োজন। যাতে সে সময়ের মধ্যে তিনি শত্রুর নাগালের বাইরে চলে যেতে পারেন।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর বিছানায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ঘুমানোর দুঃসাহসিক কাজটি করেছিলেন হযরত আলী রা.। রাসূলুল্লাহ সা. যে চাদরটি গায়ে দিয়ে ঘুমাতেন সেই সবুজ রংয়ের চাদরটি গায়ে জড়িয়ে হযরত আলী রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর বিছানায় শুয়ে থাকেন।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর ঘরের দরজার কাছেই ছিল তলোয়ার শানিত শত্রু  কুরাইশ যুবকদের ভয়ঙ্কর পাহারা দল। তারা সশস্ত্র অবস্থায় সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। রাসূলুল্লাহ সা. ঘর থেকে বের হওয়ার সময় এক মুঠি মাটি কুরাইশ যুবকদের উদ্দেশে ছুড়ে দেন। ফলে আল্লাহতায়ালা অপেক্ষমাণ কুরাইশ দলের দৃষ্টিশক্তি আচ্ছন্ন করে দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ সা. কে দেখতে পেল না। তারা যেন দেখছিল যে, তিনি নিজ বিছানায় ঘুমিয়ে আছেন।

নবীজীর জীবন রক্ষার তাগিদে নিজ জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন হযরত আলী রা. তিনি জানতেন যে, নবীজীর বিছানায় ঘুমানোর সময় যে কোন মুহূর্তে তার জীবননাশ হতে পারে। তা সত্ত্বেও তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছিলেন যেন রাসূল সা. নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে পারেন। রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি অতিশয় ভালোবাসা ও মহব্বত থাকার কারণেই হযরত আলী রা.-এর পক্ষে এমন দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়েছিল।

দুই. খন্দকের যুদ্ধে সালা পর্বতের এক উপত্যকায় রাসূলুল্লাহ সা.-এর জন্য একটি তাঁবু নির্মাণ করা হয়। এক হিম ঠাণ্ডা রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. একাকী শুয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁবুর মধ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন কে? উত্তর পেলেন সাদ আবী ওয়াক্কাসের পুত্র। কি জন্য এসেছো?

সাদ বললেন সাদের হাজার জীবন অপেক্ষা আল্লাহর রাসূল হচ্ছেন তার প্রিয়তম। এ অন্ধকার হিম ঠাণ্ডা রাতে আপনার ব্যাপারে আমার ভয় হলো। তাই পাহারার জন্য হাজির হয়েছি। রাসূল সা.-এর জীবন ও ভালোবাসার তুলনায় কনকনে ঠাণ্ডা ও নিজ জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন সাহাবী সাদ রা.।

তিন. হিজরী তৃতীয় সনে মক্কার মুশরিকদের সাথে সংঘটিত হয় ওহুদের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয়ের দ্বার প্রান্তে পৌঁছেও তীরন্দাজ বাহিনীর ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এ সময় মুষ্টিমেয় কয়েকজন সৈনিক রাসূলুল্লাহ সা. কে ঘিরে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। হযরত আম্মার বিন ইয়াযিদ শহীদ হন। কাতাদা বিন নুমানের চোখে কাফেরদের নিক্ষিপ্ত তীর লাগলে চক্ষুকোটর থেকে মণিটি বের হয়ে তাঁর গণ্ডের ওপর ঝুলতে থাকে।

হযরত আবু দাজানা রাসূলুল্লাহ সা.-এর দিকে মুখ করে তাঁর পুরো দেহটি ঢাল বানিয়ে নেন। রাসূলুল্লাহ শরীরে কোন আঘাত যেন না লাগে। এ অবস্থায় সাহাবী আবু দাজানা আহত এবং রক্তাপ্লুত হয়েছেন। তখন মুসলমানদের মধ্যে হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তীর ছুড়েছিলেন। আর হযরত তালহা ইবনে উবায়দুল­াহ রা.-এর হাতে তলোয়ার ও অন্য হাতে বর্শা নিয়ে কাফেরদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে আনছারদের বারোজন এবং মুজাহিদদের মধ্যে হযরত তালহা রা. ছাড়া আর সকলে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। রাসূল সা. পাহাড়ের একটি চূড়ায় উঠলেন। এমন সময় একদল শত্রু সৈন্য তাঁকে ঘিরে ফেললো।

রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করলেন, কে আছো? যে হামলাকারীদের আমার কাছে থেকে হটিয়ে দিতে পার? হযরত তালহা এগিয়ে এলেন। রাসূল সা. তাঁকে বারণ করেন। তখন আনছারীদের একজন এগিয়ে আসলেন। তিনি কাফেরদের সাথে লড়াই করে শহীদ হলেন। আরও একজন আনছারী এগিয়ে আসলেন রাসূল সা.-এর জীবন রক্ষা করতে। তিনিও শহীদ হলেন। এভাবে একে একে সকল আনছার রাসূল সা.-এর প্রাণ রক্ষার্থে অবলীলায় শাহাদাত বরণ করলেন।

অবশেষে হযরত তালহা রা. এগিয়ে আসলেন। তিনি আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। তা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সা. আহত হলেন। তাঁর পবিত্র দান্দান মোবারক শহীদ হলো তিনি রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় হযরত তালহা রা. একবার মুশরিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের একটু দূরে তাড়িয়ে দেন। আবার রাসূল সা.-এর দিকে ছুটে এসে তাঁকে কাঁধে করে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে থাকেন।

একস্থানে রাসূল সা. কে রেখে আবার নতুন করে হামলা চালান। এভাবে সেদিন তিনি মুশরিকদের প্রতিহত করেন। রাসূল সা.এর প্রতি তার ভালোবাসা জয়ী হয়। হযরত আবু বকর রা. বলেন, এ সময় আমি ও আবু উবাইদা রাসূল সা. থেকে দূরে সরে পড়েছিলাম, কিছুক্ষণ পর আমরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে ফিরে সেবার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি বললেন, আমাকে ছাড় তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখ। আমরা তাকিয়ে দেখি তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞান হয়ে আছেন। তাঁর একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায়। আর সারা দেহে তরবারী ও তীর বর্শার সত্তরটির বেশি আঘাত।

এই ছিল রাসূল প্রেমের চিহ্ন। নিজ শরীর জখমের পর জখম হয়েছে তারপরও রাসূল সা. কে রক্ষা করছে তাঁরা- এটাকে শুধু ভালোবাসা বললে ভুল হবে। বরং ভালোবাসার চেয়েও অনেক বড় কিছু।

রাসূল সা.-এর প্রতি সাহাবীদের এ ভালোবাসা কে অন্যকোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের কোন উপায় নেই। শুধু আল্লাহকে পাওয়ার আকাঙ্খায় তাদের এ ব্যাকুলতা। পবিত্র কুরআনের বাণীই তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছে এ পথে চলতে।

তারা পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং রাসূল সা.-এর সান্নিধ্যে এসে এমন কিছু ঐশ্বরিকভাব অনুভব করেছিলেন যা তাদের হৃদয়কে রাসূল প্রেমে ভরিয়ে দিয়েছিল।