মৌনীরা এবং রিশা

উদাহরণ টি আমার জীবন থেকে নিয়েই শুরু করি। ডাক্তারের প্রত্যাশিত তারিখ এর তিন দিন আগেই আগস্টের ১ তারিখ রাত ১২ টার পর (অর্থাৎ যা বাংলাদেশে ২ তারিখ ) হুট করে আমার লেবার পেইন শুরু হয়ে গেল। কল দিলাম অ্যাম্বুলেন্সকে, চলে আসলো ১৫ মিনিটের মধ্যে। আবরাজ কে দেখলাম এক নজর, তখন সে ঘুমে, আবার যদি ফিরে আসা না হয় আমার, সে মাত্র নতুন নতুন হাঁটা শিখেছে।

পরনে যা ছিল তা পরেই বের হয়ে গেলাম একা প্যারামেডিক এর সাথে, উনি বুঝলেন যে আমার সাথে কেউ যাওয়ার নেই, আমি একাই যাবো। আমি উঠে শুয়ে পড়লাম অ্যাম্বুলেন্সে। প্যারামেডিক আমার ব্লাড প্রেশার চেক করলেন, আঙ্গুলে হার্টবিট মনিটর করার মেশিন লাগালেন আর পেট থেকে আমার বাচ্চার হার্টবিট ঠিক আছে কিনা চেক করলেন। তারপর বসলেন আমার মেডিকেল হিস্ট্রি লেখার জন্য।

আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছি । আমার দুই-হাত উনার হাত দিয়ে চাপ দিয়ে ধরে তিনি আশ্বস্ত করে বললেন ‘you will be fine, we will get you there (hospital) .’ এমনভাবে বললেন যেন তিনি আত্মার আত্মীয় আমার, যার মধ্যে আমি শুধু পেলাম ভদ্রতা আর শালীনতা, এর বাইরে কিছুই না। একবারও জিজ্ঞেস করেননি, তুমি একা কেন বা কারণ বা কোনো ধরনের অপ্রীতিকর প্রশ্ন, একবারও মনে হয়নি লোকটি আমার শরীর অযথা বাজে ভাবে স্পর্শ করছে বা নোংরা ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে ।

যাই হোক, হাসপাতালে পৌঁছালাম, প্যারামেডিক আমাকে নার্সের কাছে বুঝিয়ে চলে গেলেন। ততক্ষণে আমার লেবার পেইন ঘন ঘন হতে লাগলো । আমি ব্যথায় কয়েক বার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম আবার ক্লান্তির চোটে ঘুমিয়েও হয়তো পড়েছিলাম, ঐ টাকে অজ্ঞান বলা চলবে না, কারণ নার্স ডাকলে আমি চোখ খুলছি আর খুলেই দেখছি তিনিও আমার হাত ধরে আছেন, আর পরম মমতায় মাথায় তার হাত বুলাচ্ছেন।

প্রায় চার ঘণ্টা এইভাবে ব্যথায় চিৎকার আর কাতরানোর পর সূর্যোদয় এর সময় মৌনীরা দুনিয়াতে আসলো। আমি বলবো, আমি ভাগ্যবতী যে ৫/৬ ঘণ্টা লেবার পেইন এ ছিলাম আমি, অনেক মায়েদের আরও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, অনেকের অনেক জটিলতা থাকে। এমনকি জীবনও চলে যেতে পারে। যা হোক, মৌনীরা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরের সেকেন্ড থেকে ২/৩ ঘণ্টা আমার কোন হুশ ছিল না। মানে আমি ক্লান্তির চোটে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছি, অনেকক্ষণ পরে উঠে ফোন দিলাম সবাইকে। সবাই অবাক, বলে হাসপাতালে গেলে কখন আর বাচ্চা হলো কখন?

একটি মা, এই ভাবেই অথবা এর চেয়ে বেশি কষ্ট করে একটি সন্তান পৃথিবীতে আনেন। সেই মায়ের ১২/১৩ বছরের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে এমন মেয়ে যদি বখাটে ছেলের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়, সেই মা কে কি দিয়ে বুঝ দিবো আমরা? রিশার কি দোষ ছিল? আর কত রিশা আর তনু খুন হওয়ার পর বিচার শুরু হবে? কে নেবে এই হত্যার দায়?

গত ২৪ আগস্ট রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে কাকরাইল ফুটওভার ব্রিজে স্টার্ন মল্লিকা মার্কেটের বৈশাখী টেইলার্সের কার্টিং মাস্টার ওবায়দুল খান রিশাকে ছুরিকাঘাত করেন। রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিশা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। রিশার খুনিকে বখাটে বলা হচ্ছে।

আসলে বখাটে কি যারা নিম্ন শ্রেণির, অশিক্ষিত/ অল্প শিক্ষিত লোকদেরই বলবো- যারা মেয়েদের হর-হামেশা উত্যক্ত করে আসছে রাস্তায়, পার্কে, বৈশাখী মেলায় ? নাকি আমি নিজেই যখন ১১/১২ বয়স তখন নিজের ভাইয়ের সামনে বসে থাকা ডাক্তারটি যখন চেক-আপ এর নাম বলে অশালীনভাবে আমার বক্ষে চাপ দিচ্ছিল সেই ডাক্তারটিকে কি বলবো? নাকি চার বছর বয়স থেকে ঘটে যাওয়া কাজের মেয়ে, নিজের কাজিনদের বলবো? কিভাবে অথবা কোন স্তরে তাদের সংজ্ঞা আমরা নির্ধারণ করবো? কবে আমরা সভ্য জাতি হবো যেখানে কোনো ধরনের অসুস্থতা থাকবে না বিপরীত লিঙ্গের প্রতি। আর কোনো রিশাকে এভাবে জীবন দিতে হবে না?

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর