সরকার পতনের পর থেকে দখল হওয়া ব্যাংকগুলোতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এছাড়া যেসব বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দলীয় লোকজন ছিল সেগুলোতেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়োগ পাওয়া পর্ষদ সদস্য ও নির্বাহীদের মধ্যেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এসব কারণে ইতোমধ্যে অনেক ব্যাংকে পর্ষদে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দখল-পালটাদখলের চেষ্টার কারণে ব্যাংকের সার্বিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা ধরে রাখাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে সোমবারও ইসলামী ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের কবল থেকে মুক্ত করতে রাজধানীর দিলকুশায় প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছেন ব্যাংকটির পুরোনো কর্মীরা। সকাল থেকে তারা ব্যাংকের সামনে অবস্থান নিয়ে নানা স্লোগান দিয়েছেন। ফলে ২০১৭ সালের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা কেউ প্রবেশ করতে পারেননি। একই সঙ্গে পুরোনো কর্মীরা রোববারের গুলির ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।
এদিকে নতুন নিয়োগ পাওয়া ব্যাংকারদের পাশাপাশি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুনিরুল মওলা, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেকিউএম হাবিবুল্লাহ ও আলতাফ হুসাইন, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিনসহ এস আলমপন্থি হিসেবে পরিচিত অন্য কর্মকর্তারাও ব্যাংকে যাননি।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপের দখলে নেওয়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে সোমবার থেকে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে। কমার্স ব্যাংকের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো; বাকি শেয়ার ছিল বিকল্পধারার সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নানের হাতে। ২০১৭ সালে আবদুল মান্নানের শেয়ার কিনে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। সরকার পতনের পর ব্যাংকে যাচ্ছেন না এমডি। ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অফিসে গেলে তাকে ঘিরে ধরেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা কেউ চাকরি স্থায়ী করার দাবি জানান, আবার কেউ পদোন্নতির দাবিতে নানা স্লোগান দেন। এই সময় কেউ কেউ ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের কবল থেকে মুক্ত করার দাবি জানান। এক পর্যায়ে ডিএমডি পদত্যাগে বাধ্য হন। এ সময় সেনাবাহিনী এসে তাকে ব্যাংক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। ব্যাংকের সামনে সেনাবাহিনী অবস্থান করছে।
এছাড়া সোস্যাাল ব্যাংক, ইউসিবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংকেও অস্থিরতা চলছে। সোমবারও আইএফআইসি ব্যাংকের সামনে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন।
এমন অবস্থায় দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলেছেন, ব্যাংকগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও আমানতকারীদের আস্থা ধরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনই হস্তক্ষেপ করা জরুরি। তা না হলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপ হবে। আমানতাকীদের আস্থায় চিড় ধরতে পারে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলেছে, সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত এখনো স্থিতিশীল। কয়েকটি ব্যাংকে যে বিশৃঙ্খলা চলছে এগুলো আইনশৃঙ্খলাজনিত বিষয়। এ বিষয়ে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। ব্যাংকগুলোকে এখন বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা শেয়ার ধারণের ক্ষেত্রে আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়ে থাকলে সেগুলোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করবে। তদন্তে অনিয়ম পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিয়োগের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক দেখে। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে সব সরকারের আমলেই ব্যাংকগুলোর পর্ষদে পরিবর্তন আসে। কিন্তু এবার হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। যেটা আগে কখনোই হয়নি। এর কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংক দখল করা হয়েছে। ওইসব ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা ঋণের নামে লুটপাট করা হয়েছে। ওই ব্যাংকগুলোতেই এখন অস্থিরতা বেশি।
বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে বড় শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে সব দলের লোকজন রয়েছে। এ কারণে যে দল যখন ক্ষমতায় সে দলের লোকজন তখন পর্ষদে বসেন। তারা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যাংক পরিচালনা করেন। এর আগের সরকারগুলো প্রতি ৫ বছর পরপর পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে ধারাবাহিকভাবে পর্ষদেও দলীয় লোকজনের মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে। বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে ওই দলের লোকজনই ব্যাংকের পর্ষদে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ভালো ব্যাংক তারা দখল করে নিয়ে লুটপাট করেছে। এ কারণে এবার বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে সার্বিক পরিস্থিতি। অনেক ব্যাংকেই এখন এমডি, ডিএমডিরা অফিস করছেন না। এদিকে কয়েকটি ব্যাংকে নতুন পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছেন। আওয়ামী লীগপন্থি পরিচালকদের সরিয়ে বিএনপিপন্থি পরিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি এম নুরুল আমিন বলেন, এমডি ছাড়া ব্যাংক এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। তার শারীরিক অথবা মোবাইল ফোনে বা অনলাইনে উপস্থিত থাকতে হবে। তা না হলে কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে এমন অস্থিরতা আগে কখনো হয়নি। এগুলো বেশিদিন চলতে দিলে ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট হবে। এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান হওয়া উচিত।
সূত্র জানায়, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংকে এমডি না থাকলে কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে। তিনি সর্বোচ্চ তিন মাস চালাতে পারবেন। এর মধ্যে এমডি নিয়োগ না দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে বা এমডি নিয়োগের মেয়াদ বাড়াতে পারে। পর্ষদের ক্ষেত্রে কোনো পরিচালক টানা তিন মাস বিদেশে থাকলে বা কোনো কারণে উপস্থিত থাকতে না পারলে তিনি বিকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে পারেন। এর বেশি সময় উপস্থিত না থাকলে তার পদ শূন্য হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী ব্যাংকের পর্ষদে একজন পরিচালক টানা ৯ বছর থাকতে পারেন। এরপর তিন বছর বিরতি দিয়ে আবার টানা নয় বছর থাকতে পারেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ সুযোগ পাচ্ছেন না অনেক পরিচালকই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ সভার মাধ্যমে পর্ষদের পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।