সিলেট ও সুনামগঞ্জে তৃতীয় দফায় ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। সোমবার (১ জুলাই) থেকে বন্যার পানিতে তলিয়েছে জেলার অন্তত: ৪টি উপজেলা। সিলেট মহানগরেরও অনেক জায়গায় নতুন করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে নগরীর মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়ি, তালতলা, জামতলা, কুয়ারপার, শিবগঞ্জ, শাহজালাল উপশহর, হাওয়াপাড়া, যতরপুর, মেন্দিবাগ, তোপখানা, মজুমদারি, চৌকিদেখী, দক্ষিণ সুরমাসহ বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয় অধিবাসীরা।
একইসময় পানি বৃদ্ধির কারনে সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সাথে বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পডেছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে সোমবার দিন ও রাতে অবিরাম বৃষ্টি হয়েছে। একদিকে অবিরাম বৃষ্টি আর অন্যদিকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারনে সিলেট ও সুনামগঞ্জে সবগুলো নদ-নদীর পানি বেড়ে ও নতুন নতুন এলাকা প্লাাবিত হয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) বিকাল পর্যন্ত সিলেটে ৫টি নদীর পানি ৬টি স্থানে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৯৪ মিলিমিটার। আর আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩ মিলিমিটার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ৩ দিন সিলেটে ও উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সোমবার সকাল থেকে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কানাইঘাটে সুরমা ও লোভা নদীর পানি দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা ডাইকের অন্তত ১৮টি স্থান দিয়ে সুরমা ও লোভা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত জনপদ ফের বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। নতুন করে প্লাবিত বাড়ি-ঘরের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যাচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন বাজার তলিয়ে পানি ঢুকেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এতে নতুন করে ক্ষতিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া প্লাবিত হয়েছে কোম্পানীঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা। ফলে তৃতীয় দফা ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষজন।
পাউবো সূত্র জানায়, মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত সিলেটের ৫টি নদীর পানি ৬ পয়েন্টে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর মধ্যে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১১৮ সে.মি., কুশিয়ারার পানি আমলশীদ পয়েন্টে ৭৭ সে.মি, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি ৯৫ সে.মি, শেরপুর পয়েন্টে ১৪সে.মি ও শেওলা পয়েন্টে ২৩ সে.মি এবং সারিগোয়াইন নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সিলেট মহানগর ছাড়া জেলার সব উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জেলার ১ হাজার ৮১টি গ্রামে এপর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ ৫০০ জন মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। এসব উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষ রয়েছেন। বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসন ও প্রত্যেক উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে কন্ট্রোল স্থাপন করে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম গঠন করে বন্যার্ত অসুস্থ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে।
সিলেটে গত ২৭ মে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুই সপ্তাহ ব্যাপী স্থায়ী এ বন্যায় পানিবন্দী ছিলেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রথম বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন থেকে ফের বন্যা হয় সিলেটে। বিশেষ করে ঈদুল আযহার দিন ভোররাত থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিভারী বর্ষণে মহানগরসহ সিলেটের সব উপজেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। পরবর্তী এক সপ্তাহ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ছিলো ভয়াবহ। এরপর পানি নামতে শুরু করে। তবে সে গতি ছিলো খুব ধীর।
দ্বিতীয় দফা বন্যা শেষ হওয়ার আগেই সোমবার থেকে সিলেটে ধাক্কা দিয়েছে তৃতীয় দফা বন্যা। রবিবার (৩০ জুন) দিনভর সিলেটে থেমে থেমে ও উজানে ভারী বৃষ্টির ফলে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নি¤œাঞ্চল পানিতে তুলিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে নতুন করে অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে লোভাছড়াসহ অন্যান্য নদীর পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করেনি। তবে যে কোন সময় বিপদ সীমা অতিক্রম করতে পারে। সিলেট আবহাওয়া অফিস জানায়, গত ২৪ ঘন্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৯৪ মিলিমিটার। আর আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩ মিলিমিটার।
এদিকে বিপদসীমার ৮.৩০ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর ষোলঘর পয়েন্টের পানি। সেই সঙ্গে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার নি¤œাঞ্চলে ফের সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উজানের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত আছে। এ কারণে নদী ও হাওরে পানির প্রবাহ আরও বেড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাহিরপুর উপজেলা। তাহিরপুর উপজেলায় রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরে বেশি পানি উঠেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছে প্রশাসন। জেলার ২০০টি আশ্রয়কেন্দ্রে হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক তিন দিন ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উজানের ঢলে গতকাল আবারও জেলা সদর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আফতাব উদ্দিন জানান, উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর ও শনির হাওরপারের গ্রামগুলো বেশি আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় পাহাড়ি ঢলের প্রবল তোড়ে অনেক রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে লোকজন আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুনামগঞ্জে ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে সুরমা ও যাদুকাটা নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আরও একদিন মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত জানান, শহরে নদী ও হাওর তীরবর্তী এলাকায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় রাস্তাঘাট, দোকানপাট ও বাড়িঘরে পানি আছে। বন্যার আশঙ্কায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় আবারও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা-উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের সবধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।