বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুম। বর্তমানে মালয়েশিয়ার কারাগারে আটক আছেন তিনি। একসময় সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর থেকে ঢাকা উত্তর বিএনপির সভাপতি হন; সবশেষ কেন্দ্রীয় বিএনপির ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন তিনি। মাঝে হয়েছেন আলোচিত ইতালির নাগরিক তাবেল্লা সিজার হত্যাসহ অসংখ্য মামলার আসামি। অবশ্য এতোদিন কাইয়ুম পরিবারসহ মালয়েশিয়ায় বসে দল পরিচালনাসহ নানা বিষয়ে কলকাঠি নাড়তে পারতেন নির্বিঘ্নে। তবে সম্প্রতি দেশটিতে আটকের পর কাইয়ুম ইস্যুতে নানান প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
প্রশ্ন আসছে- কোন ভিসায় বছরের পর বছর ধরে দেশটিতে অবস্থান করলেন এম এ কাইয়ুম? নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাইয়ুম কি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছেন? নাকি রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন?
বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকলেও তিনি কীভাবে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তালিকাভুক্ত শরণার্থী হলেন? এক্ষেত্রে তিনি কী প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে? তাকে কি দেশে ফিরিয়ে আনা হবে? প্রতিবেদককে এসব প্রশ্নের বিষয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে।
গত ১২জানুয়ারি অবৈধভাবে দেশটিতে অবস্থানের কারণে অভিবাসন আইনের আওতায় কাইয়ুমকে আটক করে স্থানীয় আমপাং থানায় নেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি আটক অবস্থায়ই আছেন।
কাইয়ুমের স্ত্রী শামীম আরা বেগম জানান, ঘটনার দিন জুম্মার নামাজ শেষ করে তিনি বাসার সামনে অবস্থান করছিলেন। এসময় তাকে আটক করা হয়। এরপর জানানো হয়_অভিবাসন আইনের আওতায় অবৈধভাবে অবস্থানের কারণে তাকে আটক করা হয়েছে। কারণ, তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিল হয়েছে।
এদিকে, ২০১৫ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে অবস্থান করছেন এম এ কাইয়ুম। পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তালিকাভুক্ত শরণার্থী হিসেবে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছিলেন।
মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী জানিয়েছেন, কাইয়ুম দেশে থাকতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশতাধিক মামলা আছে। বিভিন্ন সময় গাড়ি পোড়ানোসহ নানা অভিযোগে মামলাগুলো হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মামলা গুলশানে ইতালি নাগরিক তাবেল্লা সিজার হত্যা মামলায় আসামি হওয়া। ২০১৫ সালের তাবেল্লা হত্যা মামলার কার্যক্রম প্রায় শেষপর্যায়ে। আলোচিত তাবেল্লা সিজার হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এর ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে ঢাকার সাবেক কমিশনার কাইয়ুমের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় অবস্থানকালে বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুম বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে প্রায় অন্য দেশে গেছেন। সেখানে তিনি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন বলেও অভিযোগ আছে। গত নভেম্বরে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
এদিকে মালয়েশিয়ায় আটক বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আদেশ স্থগিত করে দেশটির উচ্চ আদালত। ১৮ জানুয়ারি এই স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। এতেই আপাতত আটকে গেছে তাকে ফেরানোর সুযোগ।
কাইয়ুম এর পক্ষের আইনজীবী সেভান ডোরাইসামি দাবি করেছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই তাকে আটক করা হয়েছে। কাইয়ুম ২০১৫ সাল থেকে সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামের অধীনে বসবাস রয়েছেন এবং ইউএনএইচসিআরের তালিকাভুক্ত একজন শরণার্থী।
সেভান বিবৃতিতে বলেন, মালয়েশিয়ার পুলিশ এবং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) যৌথ অভিযানে এম এ কাইয়ুমকে আমপাং-এ তার বাসভবন থেকে আটক করে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপি নেতা কাইয়ুম কীভাবে এতো দেশটিতে অবস্থান করছিলেন সেটা না জেনে বলা সম্ভব হবে না৷ তবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকলেও তিনি জাতিসংঘের শরনার্থী হিসেবে কীভাবে সেখানে আছেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন।’
মালয়েশিয়া বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার বাদলুর রহমান বাদল প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই তাকে আটক করা হয়েছে। এগুলো হয়রানি ছাড়া কিছু না। পাশাপাশি উনাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেশটির আদালত স্থগিত করেছেন। আর তার কাছে জাতিসংঘের শরনার্থী কার্ড আছে।’ বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিলের প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, এটা কীভাবে সরকার করেছে জানি না। আপনারা খোঁজখবর নেন, জানতে পারবেন।’
এতদিন ধরে কীভাবে, কোন ভিসায় এম এ কাইয়ুম মালয়েশিয়ায় আছেন- জানতে চাইলে নামপ্রকাশ না শর্তে বিএনপির একজন নেতা বলেন, ‘তিনি কোন ভিসায় আছেন তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে তিনি এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন; সেকেন্ড হোম করেছেন। তাই হয়ত কোনো ভাবে রয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘের শরনার্থী কার্ডও তার আছে। তবে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে দেশটিতে থাকেন না। কারণ, এখানে এমন সুযোগ নেই।’
কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়ে দেশটিতে থাকার সুযোগ নেই। হয়ত তিনি সেখানকার কোনো পন্থায় দেশটিতে অবস্থান করছেন।
কে এই বিএনপি নেতা কাইয়ুম?
ঢাকার প্রয়াত মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থাকার সময় কাইয়ুম গুলশান-বাড্ডা এলাকার কমিশনার ছিলেন। দলের প্রয়াত মেয়র আব্দুস সালাম তালুকদারের হাত ধরে তিনি বিএনপিতে এসেছিলেন বলেও শোনা যায়।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে গুলশান-বাড্ডা আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন কাইয়ুম। জানা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানিয়েছিলেন কাইয়ুম। আবাসন ব্যবসা ছাড়াও মালয়েশিয়ায় তার অঢেল অর্থকড়ি আছে। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার ঠিক আগেই কাইয়ুম পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। সেখানে অবস্থান করেই দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন তিনি।
২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ এবং উত্তরের নির্বাহী আংশিক কমিটি অনুমোদন করা হয়। এতে ৬৬ সদস্যবিশিষ্ট ঢাকা মহানগর উত্তরে বিএনপির সভাপতি হন এম এ কাইয়ুম এবং সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান। কমিটি হওয়ার আগে থেকে অদ্যবদি বিদেশেই আছেন তিনি।
অভিযোগ আছে, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জয়ের পর গুলশান, বাড্ডা এলাকায় জমি দখলসহ নানা অভিযোগ ওঠে কাইয়ুমের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০০৪ সালে কমিশনার হওয়ার পর বাড়তে থাকে প্রভাব প্রতিপত্তি। পরে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তোলেন আবাসন প্রতিষ্ঠান স্বদেশ প্রোপার্টিজ।
এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে কাইয়ুমের আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় তার স্ত্রী শামীম আরাকে। শুরুতে কয়েকদিন মাঠ গরম করলেও নির্বাচনের আগ মুহূর্তে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। ‘নাভিদ উল ওয়ারস’ নামে একটি গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান কাইয়ুমপত্নী।