৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থানে পিছিয়ে পড়া, দুই দফায় আন্দোলন করেও দাবি আদায় করতে না পারা এবং সর্বোপরি শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার আর কারাবরণে হতাশ বিএনপির মোদি সাক্ষাতে স্বস্তির হিমেল হাওয়ার পরশ বইছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘সুন্দর’ বৈঠকের পর দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
তাদের মতে, এই বৈঠক বিএনপিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে দিল। মোদির সঙ্গে খালেদার বৈঠক হবে না- দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর রোববার মোদি-খালেদার বৈঠক, বিশেষ করে ১৫ মিনিটের একান্ত বৈঠককে ‘বড় অর্জন’ হিসেবে দেখছে বিএনপি। এই বৈঠকে না হলে সরকারের পক্ষে বিএনপিকে চেপে রাখা এবং দল মানসিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকত বলেও মনে করে বিএনপি।
বিএনপির অভিযোগ, খালেদা জিয়ার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠক যাতে না হয়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। সেজন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম মাহমুদ আলী বলেছিলেন, মোদির সফরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হবে না। যদিও সেই দিনই দিল্লিতে ভারতের পররাষ্টসচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ছাড়াও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করবেন মোদি। ওই ব্রিফিংয়ের পর থেকেই অনেকটা স্বস্তিতে ছিল বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
রোববার বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ৪টা ৫ মিনিট থেকে ৪টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এই বৈঠক করেন খালেদা জিয়া ও নরেন্দ্র মোদি। বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা জানান, বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী সে বিষয়ে বেশি কথা হয়েছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পূর্বাপর পরিস্থিতি সম্পর্কে মোদিকে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। যদিও মোদি বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের শুরুতে খালেদা জিয়া তার লিখিত একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেন। নরেন্দ্র মোদিও তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অত্যন্ত চমৎকার ও খোলামেলা পরিবেশে দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে চায়। একই সঙ্গে কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার আহ্বান জানায় দলটি। মোদি এসব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।
সোনারগাঁও হোটেলে বিএনপির নেত্রী যখন বৈঠক শেষ করে বের হয়ে আসছিলেন তখন গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সুন্দর’ আলোচনা হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতাদের দাবি, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর খালেদা জিয়াকে অনেক উৎফুল্ল মেজাজে দেখা গেছে। বিশেষ করে, রাতে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি নেত্রীকে প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। অনেক দিন তাকে এ রকম দেখা যায়নি বলেও দাবি তাদের।
এদিকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর খালেদা জিয়া ও নরেন্দ্র মোদির একান্ত বৈঠককে সুদিনের শুরু হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকের গুরুত্ব অনেক। এর মাধ্যমে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। শাসকদলও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে। এটি বিএনপির অর্জন। মোদি সরকার যেকোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের মানুষের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চায় এবং ভবিষ্যতে বিজেপির সঙ্গে বিএনপির গভীর সম্পর্ক তৈরি হতে পারে- একান্ত বৈঠক এটি প্রমাণ করেছে বলে মন্তব্য তাদের।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় প্রতিটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সার্ক পরিমণ্ডলে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন নিয়েও কথা হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটি হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি। বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র না থাকে তা কেবল বাংলাদেশ নয়, সেটি এই সমগ্র এশীয় অঞ্চলের জন্য অস্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। নরেন্দ্র মোদি বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন এবং জানিয়েছেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ওয়াকিবহাল আছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তা করেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ভারতের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্ক ঘটাতে হবে। সেজন্য বড় একটি গণতান্ত্রিক দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে মোদি একটি প্রতিবেশী দেশের গণতন্ত্র উত্তরণে কাজ করবেন বলে বিশ্বাস করি।’