ঢাকা ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসরাইলের হাজার হাজার সেনা মিলেও যে হামাস নেতাকে খুঁজে পায়নি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৭:২১:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ নভেম্বর ২০২৩
  • ৫৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিখোঁজ হয়েছেন। ইসরাইলের হাজার হাজার সৈন্য তার হদিস বের করতে ড্রোন, বৈদ্যুতিক আড়ি পাতার যন্ত্র এবং গোপন তথ্যদাতাদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এতো কিছুর পরও তার কোন খোঁজ না পাওয়া খুব অবাক হওয়ার মতোই।

সিনওয়ার, যাকে দেখলেই তুষার-শুভ্র চুল এবং কুচকুচে-কালো ভ্রু চোখে পড়বে- তিনি গাজায় হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা এবং ইসরাইলের অন্যতম মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি।

অক্টোবরের শুরুতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ার হামাসের কমান্ডার ছিলেন এবং তার সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে।

আইডিএফ-এর চিফ অফ স্টাফ হারজি হালেভি বলেছেন, এই জঘন্য হামলার সিদ্ধান্ত ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিয়েছিলেন। অতএব তিনি এবং তার অধীনে যারা আছে তাদের বিপদ আসন্ন।

এর মধ্যে রয়েছেন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডের নেতা মোহাম্মদ দেইফ। যিনি এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছেন।

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) সিনিয়র পলিসি ফেলো হিউ লোভাট ধারণা করছেন যে, ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনার পেছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন দেইফ। কারণ এটি একটি সামরিক অভিযান ছিল।

কিন্তু সিনওয়ার সম্ভবত সেই গ্রুপের অংশ ছিলেন যারা এই হামলার পরিকল্পনা করেছে এবং তা বাস্তবায়নে প্রভাব রেখেছে।

ইসরাইলের ধারণা সিনওয়ার মাটির নীচে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। গাজার মাটির নীচে সুড়ঙ্গের কোথাও তিনি তার দেহরক্ষীদের সঙোগ গা ঢাকা দিয়ে আছেন।

ফোনের সিগনাল ধরে তার অবস্থান শনাক্ত হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না।

৬১ বছর বয়সী সিনওয়ার মূলত আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত। তিনি গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

তার বাবা-মা এসেছিলেন আশকেলন থেকে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের তাদের পৈতৃক ভিটা থেকে বিতাড়িত করা হয়।

ওই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘আল-নাকবা’ (বিপর্যয়) বলে অভিহিত করে। ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুত হওয়া এই মানুষগুলো পরে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।

তিনি খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল ফর বয়েজে পড়াশোনা করেন। তারপর গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির ফেলো এহুদ ইয়ারি, যিনি চারবার কারাগারে সিনওয়ারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি বলেন, সেই সময়ে, খান ইউনিস ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থনের ঘাঁটি।

ইয়ারি বলেছেন, শরণার্থী শিবিরে দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা যেসব তরুণ মসজিদে যেতেন, তাদের ওপর ইসলামপন্থী দলটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, যা পরবর্তীতে হামাস প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের প্রভাব রাখে।

সিনওয়ারকে ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো ইসলামী কার্যকলাপের জন্য গ্রেফতার করেছিল ইসরাইল। তখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর।

তারপর ১৯৮৫ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এই সময়েই তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থা অর্জন করেছিলেন।

তেল আবিবের ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কোবি মাইকেল বলেছেন, আহমেদ ইয়াসিন এবং ইয়াহিয়া সিনওয়ার দুজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতার সাথে এই সম্পর্কের কারণে সিনওয়ার পরবর্তীতে ওই আন্দোলনের মধ্যে গভীর প্রভাব তৈরি করেন।

১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুই বছর পর, তিনি গোষ্ঠীটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা আল-মাজদ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৫।

১৯৮৮ সালে, সিনওয়ার দুই ইসরাইলি সেনাকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।

একই বছর তাকে গ্রেফতার করা হয়, ১২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যার জন্য ইসরাইল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং চার দফায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

সিনওয়ার তার যৌবনের একটি বড় অংশ – ২২ বছরেরও বেশি সময় – অর্থাৎ ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইসরাইলি কারাগারে কাটিয়েছেন।

কারাগারে থাকার এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আবার কিছু সময় সম্পূর্ণ নির্জন কারাবাস ছিল, যা তাকে আরও উগ্রপন্থী করে তোলে বলে মনে করা হয়।

তিনি বন্দীদের মধ্যে একজন নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। কারা কর্তৃপক্ষের সাথে তিনি বন্দিদের পক্ষে আলোচনা করতেন এবং বন্দীদের শৃঙ্খলভাবে চলার ওপর চাপ দিতেন।

কারাগারে থাকাকালীন সিনওয়ারের চরিত্রকে মূল্যায়ন করেছিল ইসরাইল সরকার।

তারা তার চরিত্রকে ‘নিষ্ঠুর, কর্তৃত্বপূর্ণ, প্রভাবশালী এবং অস্বাভাবিক সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন, ধূর্ত এবং কৌশলী, অল্পতেই সন্তুষ্ট… কারাগারের ভিতরে অন্যান্য বন্দীদের মধ্যেও কথা গোপন রাখতে পারা… নিজের চারপাশে মানুষকে ভিড় করানোর ক্ষমতা’ এমন নানাভাবে ব্যাখ্যা করেন।

সিনওয়ারের সঙ্গে বার বার দেখা হওয়ার ভিত্তিতে তার সম্পর্কে ইয়ারির মূল্যায়ন হল, সে সময় সিনওয়ার একজন সাইকোপ্যাথ ছিলেন।

তবে সিনওয়ারের বিষয়ে বলতে গিয়ে ‘সিনওয়ার একজন সাইকোপ্যাথ’ শুধু এই মন্তব্য করাটা ভুল হবে কারণ তাহলে এই অদ্ভুত, জটিল ব্যক্তির অনেককিছু এড়িয়ে যাওয়া হবে।

ইয়ারির মতে, তিনি হলেন অত্যন্ত ধূর্ত, বুদ্ধিমান – একজন ব্যক্তি যিনি তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের সুইচ নিজের ইচ্ছেমত চালু এবং বন্ধ করতে পারতেন।

এ কথায় তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে কাউকে আকর্ষণ করার দুর্বার ক্ষমতা রয়েছে এবং তিনি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

বন্দী থাকাকালীন সিনওয়ার হিব্রুতে সাবলীল হয়ে উঠেছিলেন, ইসরাইলি সংবাদপত্র পড়তেন। ইয়ারি বলেন, সিনওয়ার সবসময় তার সঙ্গে হিব্রু ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করতেন, যদিও ইয়ারি আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

সিনওয়ারকে ২০১১ সালে একটি চুক্তির অংশ হিসাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। একজন ইসরাইলি জিম্মি, আইডিএফ সেনা গিলাদ শালিতের বিনিময়ে এক হাজার ২৭ ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলি আরব বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।

শালিতকে অপহরণের পর পাঁচ বছর ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল – তার বিনিময়ে মুক্তি দেয়া অন্য বন্দিদের মধ্যে সিনওয়ার এবং তার ভাইও ছিলেন।

সিনওয়ারের ভাই ছিলেন হামাসের একজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার। এরপর থেকে সিনওয়ার আরও ইসরাইলি সেনাদের অপহরণের আহ্বান জানায়।

ততোদিনে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় তাদের দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়েছে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ পার্টিকে উৎখাত করে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে হামাস।

ফাতাহ পার্টির অনেক সদস্যকে উঁচু ভবনের ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।

যখন সিনওয়ার গাজায় ফিরে আসেন, তখন তাকে অবিলম্বে নেতা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এর মূল কারণ ছিল হামাসের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি বেশ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।

যিনি ইসরাইলের কারাগারে তার জীবনের এতটা বছর উৎসর্গ করেছেন।

২০১৩ সালে, তিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৭ সালে তিনি হামাসের প্রধানের ভূমিকায় আসেন।

সিনওয়ারের ছোট ভাই মোহাম্মদও হামাসে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন।

২০১৪ সালে হামাস তাকে মৃত ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকটি ইসরাইলি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন বলে দাবি করা হয়।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে, তিনি এখনও জীবিত থাকতে পারেন।

গাজার নীচে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকা হামাসের সামরিক শাখায় তিনি সক্রিয় থাকতে পারেন। এমনকি ৭ অক্টোবরের হামলায় তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।

২০১৫ সালে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে সিনওয়ারকে ‘বিশেষভাবে মনোনীত বিশ্ব সন্ত্রাসী’ হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করে।

২০২১ সালের মে মাসে ইসরাইলি বিমান গাজা উপত্যকায় তার বাড়ি এবং অফিস লক্ষ্য করে হামলা চালায়।

২০২২ সালের এপ্রিলে, এক টেলিভিশন ভাষণে, তিনি মানুষদের যে কোন উপায়ে ইসরাইলের ওপর আক্রমণ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন।

বিশ্লেষকরা তাকে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সঙ্গে তার সশস্ত্র শাখা, ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডকে যুক্ত করার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

এই ব্রিগেড গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল।

সূত্র: বিবিসি বাংলা 

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ইসরাইলের হাজার হাজার সেনা মিলেও যে হামাস নেতাকে খুঁজে পায়নি

আপডেট টাইম : ০৭:২১:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ নভেম্বর ২০২৩

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিখোঁজ হয়েছেন। ইসরাইলের হাজার হাজার সৈন্য তার হদিস বের করতে ড্রোন, বৈদ্যুতিক আড়ি পাতার যন্ত্র এবং গোপন তথ্যদাতাদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এতো কিছুর পরও তার কোন খোঁজ না পাওয়া খুব অবাক হওয়ার মতোই।

সিনওয়ার, যাকে দেখলেই তুষার-শুভ্র চুল এবং কুচকুচে-কালো ভ্রু চোখে পড়বে- তিনি গাজায় হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা এবং ইসরাইলের অন্যতম মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি।

অক্টোবরের শুরুতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ার হামাসের কমান্ডার ছিলেন এবং তার সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে।

আইডিএফ-এর চিফ অফ স্টাফ হারজি হালেভি বলেছেন, এই জঘন্য হামলার সিদ্ধান্ত ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিয়েছিলেন। অতএব তিনি এবং তার অধীনে যারা আছে তাদের বিপদ আসন্ন।

এর মধ্যে রয়েছেন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডের নেতা মোহাম্মদ দেইফ। যিনি এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছেন।

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) সিনিয়র পলিসি ফেলো হিউ লোভাট ধারণা করছেন যে, ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনার পেছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন দেইফ। কারণ এটি একটি সামরিক অভিযান ছিল।

কিন্তু সিনওয়ার সম্ভবত সেই গ্রুপের অংশ ছিলেন যারা এই হামলার পরিকল্পনা করেছে এবং তা বাস্তবায়নে প্রভাব রেখেছে।

ইসরাইলের ধারণা সিনওয়ার মাটির নীচে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। গাজার মাটির নীচে সুড়ঙ্গের কোথাও তিনি তার দেহরক্ষীদের সঙোগ গা ঢাকা দিয়ে আছেন।

ফোনের সিগনাল ধরে তার অবস্থান শনাক্ত হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না।

৬১ বছর বয়সী সিনওয়ার মূলত আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত। তিনি গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

তার বাবা-মা এসেছিলেন আশকেলন থেকে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের তাদের পৈতৃক ভিটা থেকে বিতাড়িত করা হয়।

ওই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘আল-নাকবা’ (বিপর্যয়) বলে অভিহিত করে। ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুত হওয়া এই মানুষগুলো পরে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।

তিনি খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল ফর বয়েজে পড়াশোনা করেন। তারপর গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির ফেলো এহুদ ইয়ারি, যিনি চারবার কারাগারে সিনওয়ারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি বলেন, সেই সময়ে, খান ইউনিস ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থনের ঘাঁটি।

ইয়ারি বলেছেন, শরণার্থী শিবিরে দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা যেসব তরুণ মসজিদে যেতেন, তাদের ওপর ইসলামপন্থী দলটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, যা পরবর্তীতে হামাস প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের প্রভাব রাখে।

সিনওয়ারকে ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো ইসলামী কার্যকলাপের জন্য গ্রেফতার করেছিল ইসরাইল। তখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর।

তারপর ১৯৮৫ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এই সময়েই তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থা অর্জন করেছিলেন।

তেল আবিবের ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কোবি মাইকেল বলেছেন, আহমেদ ইয়াসিন এবং ইয়াহিয়া সিনওয়ার দুজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতার সাথে এই সম্পর্কের কারণে সিনওয়ার পরবর্তীতে ওই আন্দোলনের মধ্যে গভীর প্রভাব তৈরি করেন।

১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুই বছর পর, তিনি গোষ্ঠীটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা আল-মাজদ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৫।

১৯৮৮ সালে, সিনওয়ার দুই ইসরাইলি সেনাকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।

একই বছর তাকে গ্রেফতার করা হয়, ১২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যার জন্য ইসরাইল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং চার দফায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

সিনওয়ার তার যৌবনের একটি বড় অংশ – ২২ বছরেরও বেশি সময় – অর্থাৎ ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইসরাইলি কারাগারে কাটিয়েছেন।

কারাগারে থাকার এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আবার কিছু সময় সম্পূর্ণ নির্জন কারাবাস ছিল, যা তাকে আরও উগ্রপন্থী করে তোলে বলে মনে করা হয়।

তিনি বন্দীদের মধ্যে একজন নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। কারা কর্তৃপক্ষের সাথে তিনি বন্দিদের পক্ষে আলোচনা করতেন এবং বন্দীদের শৃঙ্খলভাবে চলার ওপর চাপ দিতেন।

কারাগারে থাকাকালীন সিনওয়ারের চরিত্রকে মূল্যায়ন করেছিল ইসরাইল সরকার।

তারা তার চরিত্রকে ‘নিষ্ঠুর, কর্তৃত্বপূর্ণ, প্রভাবশালী এবং অস্বাভাবিক সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন, ধূর্ত এবং কৌশলী, অল্পতেই সন্তুষ্ট… কারাগারের ভিতরে অন্যান্য বন্দীদের মধ্যেও কথা গোপন রাখতে পারা… নিজের চারপাশে মানুষকে ভিড় করানোর ক্ষমতা’ এমন নানাভাবে ব্যাখ্যা করেন।

সিনওয়ারের সঙ্গে বার বার দেখা হওয়ার ভিত্তিতে তার সম্পর্কে ইয়ারির মূল্যায়ন হল, সে সময় সিনওয়ার একজন সাইকোপ্যাথ ছিলেন।

তবে সিনওয়ারের বিষয়ে বলতে গিয়ে ‘সিনওয়ার একজন সাইকোপ্যাথ’ শুধু এই মন্তব্য করাটা ভুল হবে কারণ তাহলে এই অদ্ভুত, জটিল ব্যক্তির অনেককিছু এড়িয়ে যাওয়া হবে।

ইয়ারির মতে, তিনি হলেন অত্যন্ত ধূর্ত, বুদ্ধিমান – একজন ব্যক্তি যিনি তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের সুইচ নিজের ইচ্ছেমত চালু এবং বন্ধ করতে পারতেন।

এ কথায় তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে কাউকে আকর্ষণ করার দুর্বার ক্ষমতা রয়েছে এবং তিনি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

বন্দী থাকাকালীন সিনওয়ার হিব্রুতে সাবলীল হয়ে উঠেছিলেন, ইসরাইলি সংবাদপত্র পড়তেন। ইয়ারি বলেন, সিনওয়ার সবসময় তার সঙ্গে হিব্রু ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করতেন, যদিও ইয়ারি আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

সিনওয়ারকে ২০১১ সালে একটি চুক্তির অংশ হিসাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। একজন ইসরাইলি জিম্মি, আইডিএফ সেনা গিলাদ শালিতের বিনিময়ে এক হাজার ২৭ ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলি আরব বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।

শালিতকে অপহরণের পর পাঁচ বছর ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল – তার বিনিময়ে মুক্তি দেয়া অন্য বন্দিদের মধ্যে সিনওয়ার এবং তার ভাইও ছিলেন।

সিনওয়ারের ভাই ছিলেন হামাসের একজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার। এরপর থেকে সিনওয়ার আরও ইসরাইলি সেনাদের অপহরণের আহ্বান জানায়।

ততোদিনে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় তাদের দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়েছে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ পার্টিকে উৎখাত করে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে হামাস।

ফাতাহ পার্টির অনেক সদস্যকে উঁচু ভবনের ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।

যখন সিনওয়ার গাজায় ফিরে আসেন, তখন তাকে অবিলম্বে নেতা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এর মূল কারণ ছিল হামাসের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি বেশ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।

যিনি ইসরাইলের কারাগারে তার জীবনের এতটা বছর উৎসর্গ করেছেন।

২০১৩ সালে, তিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৭ সালে তিনি হামাসের প্রধানের ভূমিকায় আসেন।

সিনওয়ারের ছোট ভাই মোহাম্মদও হামাসে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন।

২০১৪ সালে হামাস তাকে মৃত ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকটি ইসরাইলি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন বলে দাবি করা হয়।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে, তিনি এখনও জীবিত থাকতে পারেন।

গাজার নীচে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকা হামাসের সামরিক শাখায় তিনি সক্রিয় থাকতে পারেন। এমনকি ৭ অক্টোবরের হামলায় তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।

২০১৫ সালে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে সিনওয়ারকে ‘বিশেষভাবে মনোনীত বিশ্ব সন্ত্রাসী’ হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করে।

২০২১ সালের মে মাসে ইসরাইলি বিমান গাজা উপত্যকায় তার বাড়ি এবং অফিস লক্ষ্য করে হামলা চালায়।

২০২২ সালের এপ্রিলে, এক টেলিভিশন ভাষণে, তিনি মানুষদের যে কোন উপায়ে ইসরাইলের ওপর আক্রমণ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন।

বিশ্লেষকরা তাকে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সঙ্গে তার সশস্ত্র শাখা, ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডকে যুক্ত করার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

এই ব্রিগেড গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল।

সূত্র: বিবিসি বাংলা