হাওর বার্তা ডেস্কঃ আবাদের শুরু থেকে কাটা মাড়াই পর্যন্ত বিঘা প্রতি সর্ব্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা খরচ। আলু-সরিষার চেয়ে কম শ্রম দিয়েই প্রতি বিঘায় আয় কমপক্ষে ১৮ হাজার টাকা। ৪ বিঘায় ভুট্টা আবাদ করে ১৩৪ মণ ফলন পেয়েছি। এখানে সব খরচ বাদে কমপক্ষে ৯০ হাজার টাকা লভ্যাংশ থাকবে।’
কথাগুলো বলছিলেন নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের মিরাট গ্রামের ভুট্টা চাষি মোজাম্মেল হক। আট বছর যাবত এই অর্থকরী ফসল আবাদ করছেন তিনি। তিন বছর আগেও তার কাছে ভুট্টা আবাদ মানে অভিশাপ ছিল। তিন বছরের ব্যবধানে উন্নত বীজের ব্যবহার এবং কৃষি পরামর্শে বাম্পার ফলন পাওয়ায় মোজাম্মেলের কাছে এখন সবচেয়ে প্রিয় ফসল হয়ে দাঁড়িয়েছে ভুট্টা। বর্তমানে প্রতি বছর নিজের জমিতে উৎপাদিত ভুট্টা বিক্রি করে প্রায় ১ লাখ টাকা আয় করছেন তিনি।
শুধু মোজাম্মেলই হকই নয়, ভুট্টার আবাদে ভাগ্যে পরিবর্তন এসেছে নওগাঁর অন্য চাষিদেরও। সম্প্রতি দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে মজুতকৃত ভুট্টা মাড়াইয়ে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রামগুলোতে ভুট্টা মাড়াইয়ের জন্য এসেছেন শত শত নারী-পুরুষ। নারী শ্রমিকরা ভুট্টা থেকে ছাল ছাড়িয়ে গুছিয়ে রাখছেন। পুরুষ শ্রমিকরা সেই ভুট্টা মেশিনে দিয়ে মাড়াই করে বস্তায় ভর্তি করছেন। এরপর তা পাঠানো হচ্ছে ভুট্টা চাষির বাড়িতে অথবা বাজারে।
মুক্তা, সেলিনা, রশিদা, আর্জিনাসহ কয়েকজন নারী শ্রমিক বলেন, ভুট্টার মৌসুম এলেই আমাদের একটা কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঘরে বসে বেকার সময় না কাটিয়ে গ্রামগুলোতে গিয়ে ভুট্টার ছাল ছাড়িয়ে দৈনিক জনপ্রতি ৩০০ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। এছাড়াও দুপুরের খাবার দেন জমির মালিকরা। এতে অনেক হতদরিদ্র পরিবারের নারীদের এই মৌসুমে বড় পরিসরে কর্মসংস্থান হয়।
আত্রাই উপজেলার বৃহত্তর ভুট্টা কেনাবেচার হাট বান্দাইখাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই মাস আগে জেলাজুড়ে একযোগে ভুট্টা মাড়াই শুরু হওয়ায় বাজারে আকস্মিক আমদানি বেড়ে যায়। এতে প্রতি মণ ভুট্টা ৮৫০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা দরে কিনেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ওই মুহূর্তে কাঙিক্ষ দাম না পেয়ে অনেক চাষি উৎপাদিত ভুট্টা মাড়াই না করেই মজুত করতে শুরু করেন। এতে বাজারে ভুট্টার আমদানি কমে যাওয়ায় হু হু করে বাড়তে থাকে দাম। বর্তমানে প্রতি মণ ভুট্টা ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা মণ দরে কিনছেন ব্যবসায়ীরা। দাম বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা এখন মজুতকৃত ভুট্টা মাড়াই করে আবারো বাজারমুখী হয়েছেন।
ভুট্টা চাষি মোজাম্মেল হক বলেন, ৪ বিঘা জমিতে ভুট্টা আবাদের পর থেকে কাটা মাড়াই পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ গুনতে হয়েছে। শুরুতে ৮৫০ টাকা মণ দাম থাকায় ভুট্টা বাড়িতেই মজুত করেছিলাম। এখন ১ হাজার ১০০ টাকা মণ দরে ভুট্টা কিনছেন ব্যবসায়ীরা। এভাবে ভুট্টার দাম বেশি থাকলে চাষিদের মাঝে ভুট্টা চাষের আগ্রহ বাড়তে থাকবে।
রাণীনগর উপজেলার গোনা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক তাজুল ইসলাম বলেন, সরিষা ও পাটের ফলন কম পাওয়ায় পাঁচ বছর যাবত তিন বিঘায় ভুট্টার আবাদ শুরু করেছি। গত বছর সানশাইন জাতের ভুট্টা আবাদ করে ওই জমি থেকে ৮৫ মণ ভুট্টা পেয়েছিলাম। এ বছর পরিচর্যা কম করায় ৬৩ মণ ফলন পেয়েছি। বাড়িতে বসেই উৎপাদিত ভুট্টা প্রায় ৫৪ হাজার টাকায় বিক্রি করে ২০ হাজার টাকা আয় হয়েছে।
আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের শিমলা গ্রামের কৃষক ওমর ফারুক আকাশ বলেন, গত বছর নদীর চরের তিন বিঘায় ভুট্টা আবাদ করে ১১৮ মণ ফলন পেয়েছিলাম। এ বছর ওই জমিতে সানশাইন জাতের ভুট্টা আবাদ করে ১০৩ মণ ফলন পেয়েছি। এর মধ্যে ৩০ মণ ভুট্টা দুই মাস আগে ২৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। দাম আরও বাড়লে অবশিষ্ট ভুট্টা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এখন শুকনা ভুট্টার দাম বাড়তে শুরু করেছে। আরও বাড়লে তারপর ভুট্টাগুলো বিক্রি করবো।
একই উপজেলার বান্দাইখাড়া গ্রামের ভুট্টা ব্যবসায়ী আলম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সোহেল রানা বলেন, ভরা মৌসুমে বাজারে আমদানি বেশি থাকায় দৈনিক ৩০০ মণ করে ভুট্টা কিনতাম। এখন আমদানি কমে যাওয়ায় চাষিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভ্যানযোগে দৈনিক ১০০ মণ করে ভুট্টা কেনা হচ্ছে। বাড়িতে ভুট্টা না পেলে বাজারে গিয়েও কিনতে হয়। বর্তমানে ১ হাজার ১০০ টাকা মণ দরে ভুট্টা কেনার পর তা মিলে এনে শুকিয়ে গুদামে সংরক্ষণ করছি। এসব ভুট্টা দৈনিক বগুড়া ও পাবনার বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়।
মান্দা উপজেলার সতিহাটের ভুট্টা ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন হাট ঘুরে দৈনিক প্রায় ২০০ মণ করে ভুট্টা কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ মৌসুমের শেষ মুহূর্তেও অনেক চাষি ভুট্টা মজুত রেখেছেন। হাটে ভুট্টার আমদানি অনেক কম। নওগাঁ, বগুড়া, জয়পুরহাটসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার ফিড মিলে প্রতিনিয়ত ভুট্টার চাহিদা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ১ হাজার ১০০ টাকা মণ দরে চাষিদের থেকে ভুট্টা কেনার পর তা শুকিয়ে ওইসব ফিড মিলে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে সরবরাহ করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, রবি ও খরিপ মৌসুমে এ বছর নওগাঁয় ৭ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ করা হয়েছিল। যেখানে ৯০ হাজার ৪২০ টন ভুট্টার ফলন পাওয়া গেছে। গত বছর ৭ হাজার ৩১০ হেক্টর জমি থেকে ৮৫ হাজার ৩৭৭ টন ভুট্টা পাওয়া যায়। এর আগের বছর ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ করা হয়েছিল। যেখানে ৭৮ হাজার ২৪০ টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়। এই তিন বছরে সানশাইন, সুপার সাইন, মিরাক্কেল, ডন, ১১১ জাতের ভুট্টা আবাদ করেছেন জেলার চাষিরা। এই হিসেব অনুযায়ী গত ৩ বছরের ব্যবধানে জেলায় ৭০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ কমলেও উৎপাদন বেড়েছে ১২ হাজার ১৮০ টন।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আলুর চেয়ে ভুট্টা বেশি লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এখন ভুট্টা চাষে মনোযোগী হচ্ছেন। চাষিদের ভুট্টা আবাদের শুরু থেকে কাটা মাড়াই পর্যন্ত কৃষি পরামর্শ দেওয়ায় অল্প জমিতেই এখন ভুট্টার বাম্পার ফলন হচ্ছে। তাই আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও গত তিন বছরের ব্যবধানে জেলায় ভুট্টা উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
তিনি আরও বলেন, নওগাঁসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বেশ কিছু ফিড মিল গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রচুর পরিমাণে ভুট্টার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তাই তুলনামূলকভাবে বিগত বছরের তুলনায় বর্তমানে ভুট্টার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। একদিকে নায্যমূল্য অন্যদিকে উন্নত জাতের ব্যবহারে অল্প জমিতেই বাম্পার ফলন পাচ্ছেন চাষিরা। তাই আগামীতে ভুট্টার আবাদে কৃষকদের আগ্রহ আরও বাড়বে।