নকল ও নিম্নমানের বীজ দেশের কৃষি উৎপাদনকে ঝুঁকিতে ফেলছে

দেশের কৃষি উৎপাদনকে ঝুঁকিতে ফেলছে নকল ও নিম্নমানের বীজ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে যেখানে খাদ্য চাহিদা পূরণে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, সেখানে নকল ও নিম্নমানের বীজে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিবিদদের মতে, কৃষি উৎপাদনে উন্নত জাত ও মানের বীজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু দেশের বাজার নকল ও নিম্নমানের বীজে সয়লাব। এমনকি খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের সরবরাহ করা বীজও নিম্নমানের বলে অভিযোগ উঠেছে। মূলত একশ্রেণির অসাধু মুনাফাখোর বীজ ব্যবসায়ী সারাদেশে বিদেশ থেকে আনা নিম্নমানের বীজ বিক্রি করছে। ওই চক্রটি হাইব্রিড জাতের বীজের মোড়ক নকল করে দেশি জাতের নকল বীজও বিক্রি করছে। আর ওসব নকল ও নিম্নমানের বীজ ব্যবহার করে অনেক কৃষক নিঃস্ব হচ্ছে। হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কৃষকরা জমিতে নিম্নমানের বীজ বপনের পর কাক্সিক্ষত ফলন পাঁচ্ছে না। নিম্নমানের বীজে কৃষকরা প্রতারিত হওয়অর পাশাপাশি দেশের খাদ্য উৎপাদনেও হুমকি সৃষ্টি করছে। কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) দেশে বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের সর্ববৃহৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান। বিএডিসি ও বেসরকারি কোম্পানি, বীজ ডিলার ও এনজিও অনুমোদিত জাতের ভিত্তি, প্রত্যায়িত ও মানঘোষিত শ্রেণির বীজ উৎপাদন করে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করে। বর্তমানে দেশে বছরে সাড়ে ১২ লাখ টন বীজের প্রয়োজন। আর ওই মোট বীজের ৫৩ শতাংশই বেসরকারি খাত সরবরাহ করে। তার মধ্যে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানি ধান বীজের ৪৪ শতাংশ, হাইব্রিড ধানের ৯৭ শতাংশ, ভুট্টার ৯৯ শতাংশ, সবজি বীজের ৮৬ শতাংশ, আলু বীজের ৭৪ শতাংশ, পাট বীজের ৮৩ শতাংশ বীজ সরবরাহ করে। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বীজ কেউ বাজারে বিক্রি করতে চাইলে জেলা বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র লাগে। আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত সাপেক্ষে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে বাজারে বিক্রি করতে আনা বীজের মান যাচাই-বাচাই করা হয়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, জেলা বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে বাজারে নকল ও নিম্নমানের বীজ বিক্রি হচ্ছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) থেকে চলতি বছর শতীকালীন রবি মৌসুমে সরকারের প্রণোদনার যে বীজ সরবরাহ করা হয় তা নিম্নমানের ছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক ওসব বীজ ব্যবহার করে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে পেঁয়াজের নিম্নমানের বীজে ভালো ফলন না হওয়ায় কৃষকরা দিশেহারা। তাছাড়া গতবছর রোপা আমন মৌসুমে মুনাফাখোর বীজ ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় র্স্বণা জাতের ভারতীয় একটি ধান বীজের নামে দেশীয় বিভিন্ন ধান বীজ বিক্রি করে প্রতারণা করেছে। অথচ স্বর্ণা নামে বাংলাদেশে কোনো ধানই নেই। ওই মুনাফাখোর বীজ ব্যবসায়ীরা ভারতীয় ধান বীজ প্যাকেটের আদলে নকল প্যাকেট তৈরি করে বাজার থেকে ধান ক্রয় করে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করে। বিভিন্ন নামকরা কোম্পানির মোড়কে নিম্নমানের ধান বীজ প্যাকেটজাত করে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি হয়। কৃষকরা না জেনে ওসব নকল বীজ কিনে প্রতারিত হয়। তাতে ধানের ফলনে ধস নামে এবং কাক্সিক্ষত খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। আমনের মৌসুমে বপন করা ওসব বীজে সময়ের আগেই গজিয়েছে ধানের শীষ। যা অপরিপক্ব হওয়ায় অধিকাংশই হয়েছে চিটা। ফলন বিপর্যয়ে সর্বনাশ হয় কৃষকের। মূলত সাধারণ কৃষকের সরলতার সুযোগে ‘স্বর্ণ গোটা ও বিআর ১১’ জাতের বীজের কথা বলে খুচরা ডিলাররা বিদেশি জাতের বীজ দিয়েছে। আমনের মৌসুমে বপন করা ওসব বীজে ধানের চেয়ে চিটাই বেশি হয়। যেখানে প্রতি একর জমিতে ৪০ থেকে ৫০ মণ ধান হওয়ার কথা, সেখানে ৮/১০ মণ ধানও হয়নি। সূত্র আরো জানায়, মানসম্মত বীজ ছাড়া কৃষিতে ভালো ফলন সম্ভব নয়। একটি জমিতে ফসল বাড়বে কি কমবে তার মূল বিষয় হলো মানসম্মত বীজ। বীজ উন্নত না করতে পারলে ফলন বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। বীজ ব্যবসাকে শক্তিশালী করার জন্য সিড সার্টিফেকেশন এজেন্সিকে আরো সচেতন হতে হবে। নিম্নমানের নকল বীজ শুধু যে কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাই নয়, নিম্নমানের নকল বীজের কারণে কাক্সিক্ষত ফলনও হচ্ছে না। তাতে হুমকির মুখে পড়ছে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা। নিম্নমানের বীজ পুরো দেশের কৃষি উৎপাদনকেই বিপদে ফেলছে। এদিকে এ প্রসঙ্গে বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ ও উদ্যান) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিএডিসি বীজের চাহিদার জোগান বাড়াতে কাজ করছে এবং পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৭২ হাজার টন বীজ উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা এর আগের বছরের চেয়ে বেশি। এদেশের কৃষকরা অনেক অভিজ্ঞ। তারাও ভালো মানের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারছে। রবি ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় বিনামূল্যে বীজ সহায়তা দেয়। এবার ৬৪ জেলার ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ কৃষক ওই সুবিধা পেয়েছে। বীজ বাবদ এবার ৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। তাছাড়া বোরো ধানের হাইব্রিড (এসএল-৮এইচ) জাতের বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বীজ দেয়া হয়। তার বাইরেও নানাভাবে দেয়া হয় বীজ। ওসব প্রণোদনার বীজই এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকের দুশ্চিন্তার কারণ। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, নিম্নমানের বীজের বিষয়ে এখনো অনেক অভিযোগ আসে। মাঠ থেকে খবর পাওয়া যায় চারা অর্ধেক গজায়নি। এখনো কিছু কোম্পানির প্রতারণার প্রবণতা আছে। অনেক সময়ই কৃষকরা নিম্নমানের বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছে। এতে একদিকে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বীজ কোম্পানিগুলোকে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। নিম্নমানের বীজ বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভালো ফলন ও উৎপাদনশীলতার জন্য মানসম্পন্ন বীজ অপরিহার্য। কাজেই বীজের মানের বিষয়ে কোনো রকম ছাড় দেয়া হবে না। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের মানসম্পন্ন বীজ নিশ্চিত করতে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর