দেশে প্রথম ইসরায়েলি পদ্ধতিতে আম চাষ, ফলন হবে ৩ গুণ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আম চাষের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে চাষির। গাছের উচ্চতা হবে মানুষের সমান। ফলে পরিচর্যাও করা যাবে সহজে। উচ্চতা কম হওয়ায় গাছে আসা শতভাগ আমেই ফ্রুট ব্যাগিং করা সম্ভব। গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (জিএপি) অনুযায়ী আম চাষাবাদ হওয়ার কারণে এই আম সম্পূর্ণ বিদেশে রপ্তানি উপযোগী। এছাড়াও ইসরায়েলি প্রযুক্তি আলট্রা হাইডেনসিটি (অতিঘন) পদ্ধতিতে আমবাগানের প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করা সম্ভব।

সাধারণত এক বিঘা আম বাগানে কৃষি বিভাগ ১.৩ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। সেখানে আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে বিঘাপ্রতি আমের উৎপাদন হবে ৫ টন করে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম চাষে সফলতা পেয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষি ও রপ্তানিকারক ইসমাইল খান শামীম। তিনি শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক।

জানা গেছে, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন বাগান পরিদর্শন ও ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের কয়েমবাটরের জেইন এগ্রোর  বিভিন্ন বাগান পরিদর্শন করে ইসমাইল খান শামীম তিন বছর আগে শিবগঞ্জের একাডেমি মোড়ে প্রতিষ্ঠা করেন এই বাগান। তিনি ইসরায়েলের আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতি অনুসরণ ও সেচের ক্ষেত্রে দেশীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন চার বিঘার বাগান। সেখানে বারোমাসি কাটিমন জাতের প্রায় ১ হাজার আমগাছ রয়েছে। মাত্র তিন বছরেই এখন তার বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলছে আম। dhakapost

আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে একই পরিমাণ জমিতে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি গাছ রোপন করা যায়। ফলে ফলন হয় অন্তত তিনগুণ বেশি। এই পদ্ধতিতে দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আম উৎপাদন হলেও বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আম চাষ শুরু করেছেন ইসমাইল খান শামীম। ইতোমধ্যে সুইজারল্যান্ড ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে সুইস কন্ট্রাক্ট ও স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি) যৌথভাবে আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে আম চাষের উদ্ভাবনী দিকগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

আমচাষি ইসমাইল খান শামীম  বলেন, ভারতের তামিলনাড়ু ও ফিলিপাইনে কোকাকোলার ম্যাংগো প্রজেক্ট দেখে ইসরায়েলের আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে আমচাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। সেই থেকে তিন বছর আগে এই বাগান শুরু করি। কিন্তু ইসরায়েলের এই প্রযুক্তির একটি অংশ ড্রিপ ইরিগেশন (বিন্দু সেচ) আমি বাদ দিয়েছি। কারণ আমাদের এই এলাকায় এতো বেশি পানির প্রয়োজন হবে না এবং ড্রিপ ইরিগেশনে অনেক বেশি খরচ হবে। যা চার বিঘার একটি আম বাগানে প্রায় লাখ টাকার মতো। তাই ইসরায়েলের আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতির সঙ্গে এখানে শুধুমাত্র সেচের ক্ষেত্রে দেশীয় পদ্ধতি যুক্ত করেছি।

তিনি জানান, বারোমাসি কাটিমন জাতের আম চাষ করেছেন। ফলে আমের মৌসুম থাকবে এমন সময়ে তার গাছে ফলন দেবে। দেশে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বিদেশ থেকে এক শ্রেণির ক্রেতার জন্য আম আমদানি করতে হয়। এই প্রযুক্তির সম্প্রসারণ হলে বিদেশ থেকে আম আমদানির প্রয়োজন হবে না। তার বাগানে বিঘা প্রতি প্রথম বছরে খরচ হয়েছে ৫৮ হাজার টাকা। দ্বিতীয় বছর ২৫ হাজার ও তৃতীয় বছরে বিঘা প্রতি আমগাছের সেচ ও পরিচর্যা করতে ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার টাকা।

ইসমাইল খান শামীম বলেন, বারোমাসি জাতের আম হওয়ায় প্রচলিত দামের তুলনায় ৪-৫ গুণ দামে বিক্রি করা যাবে আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে চাষ করা আম। এই প্রযুক্তির বাগানে উৎপাদন খরচ কম। এই প্রযুক্তির বাগানে ৯৫ শতাংশ প্রিমিয়াম কোয়ালিটির আম পাওয়া যায়। গাছ লাগানোর পাঁচ বছর পর থেকে প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদন হয় ৪-৫ মেট্রিক টন আম। আমাকে দেখে চলতি বছরে শিবগঞ্জের কয়েকজন চাষিও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম বাগান শুরু করেছেন। তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম পরামর্শ দিচ্ছি। dhakapost

তিনি আরও বলেন, আম পাড়ার পরই গাছের ওপর থেকে ৬-১০ ইঞ্চি করে ডাল কেটে ফেলতে হয়। এমনকি এই পদ্ধতিতে ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত ভালো ফলন পাওয়া যায়। আমাদের প্রচলিত ধারণা, আম গাছ লাগানোর কয়েক বছর পর থেকে গাছে ফলন দেবে। কিন্তু ইসরায়েলের এই প্রযুক্তি ব্যবহারে গাছ লাগানোর প্রথম বছর থেকেই আম উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সাড়ে ৬ ফুট পরপর এবং পূর্ব-পশ্চিম বরাবর সাড়ে ৯ ফুট গাছ লাগানোর কারণে বাগানের প্রতি একক জায়গা ব্যবহার করা যায়।

 

 

প্রচলিত পদ্ধতিতে আম চাষে প্রায় ৩০ শতাংশ আম নষ্ট হলেও এই পদ্ধতিতে নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- বাগান পরিচর্যায় লোকবল ও খরচ কম লাগে। এছাড়াও গাছের প্রত্যেকটি ডাল ও আমের প্রতি নজর রাখা যায় ও পরিচর্যা করা সহজ। আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে ল্যাংড়া, আম্রপালি, গৌড়মতি, বারি আম-৪, বারি আম-১১, কাটিমন, হাড়িভাঙ্গা, ব্যানানাসহ বিভিন্ন প্রচলিত জাতের আম চাষ করা যায় বলে জানান এই আমচাষি।

আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. কামরুল ইসলাম আলট্রা হাইডেনসিটি প্রযুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। এ বিষয়ে তিনি  বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম এই পদ্ধতিতে আম চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সেখানে গিয়ে দেখতে পান, অতিঘন মাত্রায় লাগানো হয়েছে আমগাছ। এর ফলাফল ও কার্যকারিতা নিয়ে এরপর থেকেই  গবেষণা শুরু হয়েছে ভারতে। বাংলাদেশেও আমরা এ নিয়ে গবেষণা করে আসছি।

তিনি আরও বলেন, মূল বিষয়টি হলো একটি জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অল্প সময়ে অধিক ফলন নিশ্চিত করায় এই পদ্ধতির লক্ষ্য। ধরুন, প্রচলিত পদ্ধতিতে দুটি গাছ ২০ ফুট দূরত্বে লাগালে ১০ কেজি করে ২০ কেজি ফলন দেবে। এই গাছ দুটির মাঝখানে অনেক ফাঁকা থাকবে। অথচ আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে একই পরিমাণ জায়গায় ৬টি গাছ লাগালে ১০ কেজির বদলে ৮ কেজি করে ফলন দিলে ৪৮ কেজি আম পাওয়া যাবে। অর্থাৎ একই পরিমাণ জায়গায় প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে ২-৩ গুণ বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব।

ড. কামরুল হাসান আরও বলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে আমের পূর্ণ ফলন পেতে ৭-১০ বছর সময় লাগে। অথচ আলট্রা হাইডেনসিটি প্রযুক্তি ব্যবহারে ৩ বছরেই পূর্ণ ফলন পাওয়া যায়। আমরা এখন স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকে বেশি জোর দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে আলট্রা হাইডেনসিটিতে প্রতিটি ফল ব্যাগিং করা যায়। গাছে রোগ-বালাই দমনের কিছু পদ্ধতি রয়েছে যা হাত দিয়ে দমন করতে হয়। এক্ষেত্রে তা করা সম্ভব। যা প্রচলিত পদ্ধতিতে বড় গাছে সম্ভব নয়। বিভিন্ন রোগাক্রান্ত ডালপালা কেটে ফেলা যায় সহজেই। সার্বিক দিক বিবেচনায়, এটি আগামীতে অত্যান্ত কার্যকরী পদ্ধতি হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। 5555

 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) রাজিবুর রহমান  বলেন, আলট্রা হাইডেনসিটি একটি খুবই ভালো প্রযুক্তি। আমরা জানি, একটি গাছের ফলন মাটি ও পানি থেকে খাদ্যগ্রহণ, সূর্যের আলো ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। এছাড়াও যেই গাছের ডোগায় সূর্যের আলো পৌঁছাবো, সেই ডোগাতেই আম ধরবে। আর যেগুলোতে সূর্যের আলো যাবে না, সেখানে আম ধরবে না। যেহেতু চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিবেশ আম চাষের উপযোগী। সেক্ষেত্রে আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে গাছের প্রত্যেকটি ডোগায় সূর্যের আলো পায়। প্রত্যেকটি গাছ প্রয়োজনমতো পানি পায়। নিদিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে পরিচর্যা করা যায় বলে আমের উৎপাদন কয়েকগুণ বেশি হয়।

তিনি আরও বলেন, আমরা চাই সবগুলো আমের বাগান আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে হোক। পুরাতন সব গাছ কেটে নতুনভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম চাষাবাদ শুরু হোক। আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে আম চাষে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের নানা ধরনের পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করা হয়। এছাড়াও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম চাষাবাদ করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ।

উল্লেখ্য, এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয়েছে। প্রায় ৫৫-৬০ লাখ গাছে চলতি মৌসুমে কৃষি বিভাগ জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর জেলায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আড়াই লাখ মেট্রিক টন এবং তার আগের বছর ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর