হাওর বার্তা ডেস্কঃ ২০১৮ সালের দিকেও বিভিন্ন সময় নিজের অসহায়ত্ব ও অর্থাভাবের কথা তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিতেন কক্সবাজার ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এইচএম শওকত। ওই বছর মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য উকিলের ফি ছিল না তাই শপিংয়ের কথা বলে মায়ের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নেওয়ার ঘটনা বর্ণনা করে আরেকটি পোস্ট দিয়েছিলেন শওকত। পেকুয়া উপজেলার বারকিয়া ইউনিয়নের দিনমজুর মৃত নন্না মিয়ার ছেলে শওকত কি আলাদিনের চেরাগ হাতে পেলেন? যিনি মাত্র বছর তিনেকের ব্যবধানে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে গেলেন? এমন প্রশ্ন এখন উপজেলা সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
স্থানীয়রাও বলছে, শওকতের সংগ্রহে রয়েছে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি ও একাধিক দামি বাইক। কিনেছেন কোটি টাকার জমি। শূন্য ভিটায় গড়েছেন কোটি টাকার অট্টালিকা, বিলাসবহুল অফিস। সম্প্রতি ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পেকুয়া বাজারে জুবাইদা কনস্ট্রাকশন নামে (মায়ের নামে) একটি রড-সিমেন্টের দোকান খুলেছেন। গত বছর প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা দিয়ে পেকুয়া বাজার ইজারা নিয়েছেন তিনি।
এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায় ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের পাশাপাশি এ বছর পেকুয়া বাজারের পূর্বে জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য এসএম গিয়াস উদ্দিনের বাড়ির পাশে ২ কোটি টাকা মূল্যের একটি জমি ক্রয় করেন। পেকুয়া বাজারের এসডি ডেভেলপারের পেছনে দুই কানি জমি কিনেছেন শওকত, যার মূল্য তিন থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এর আগে স্থানীয় লায়ন মুজিবসহ একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে শওকত কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমি কিনেছেন শওকত।
অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজারের একজন এমপির ছত্রছায়ায় ইয়াবা কারবার, চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন শওকত। এ নিয়ে ছাত্রলীগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগে শওকতকে শত কোটি টাকার মালিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া শওকতের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ার দাবি করে পেকুয়া বাজারের ১২০ জন ব্যবসায়ী পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। শওকতের বেতনভুক্ত কিশোর গ্যাংয়ের ইভটিজিংয়ের কারণে স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ুয়া অনেক ছাত্রী এখন ঘরবন্দি বলেও অভিযোগ আছে।
শওকত জীবিকার তাগিদে এক সময় মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। ২০১৫ সালে দেশে ফিরেই জড়িয়ে পড়েন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতিতে। শুরু করেন চাঁদাবাজি। ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর পেকুয়া থানার একজন পুলিশ অফিসারের মাথা ফাটিয়ে কারাগারে যেতে হয় শওকতকে। পরে চাঁদা তুলে তার জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর গঠিত কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পান শওকত। এরপরই শুরু হয় তার উত্থান। সম্প্রতি স্থানীয়রা শওকতের বিরুদ্ধে পেকুয়ায় সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে আজম, আবু সিদ্দিক, মনছর আলমসহ আরও কয়েকজন শওকতকে ইয়াবা কারবারি বলে দাবি করেছেন। এছাড়া পেকুয়া বাজারের ১২০ জন ব্যবসায়ী শওকতের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ইউএনও বরাবর অভিযোগ করেছেন।
পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি যোগদান করার পর থেকে শওকতের বিরুদ্ধে অনেকেই আমাকে অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি পেকুয়া বাজারের শতাধিক ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির লিখিত অভিযোগ করেছেন। আমি অভিযোগটা তদন্তের জন্য পেকুয়া থানার ওসিকে দিয়েছি।’
দুদক সূত্রে জানা গেছে, শওকতের বিরুদ্ধে মাদকের কারবার, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, নারী পাচারের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ তাদের কাছে জমা পড়েছে। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
পেকুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওসমান সরওয়ার বাপ্পি যুগান্তরকে বলেন, ‘শওকত আমার বাল্য বন্ধু। সে চট্টগ্রামের মহসীন কলেজ শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারেনি। পরে ধারদেনা করে জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়া পাড়ি জমায়। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে ২০১৫ সালে ফিরে এসে একজন প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করে। মাত্র বছর দেড়কের ব্যবধানে শওকত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে।’
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয় শওকতের অনুসারী পেকুয়ার মগনামার সোনালী বাজার এলাকার রমিজের ছেলে দুলাল ও বারবাকিয়া ইউনিয়নের শাহাবুদ্দিনের ছেলে শাহাদাতুল কবিরকে। তার আরও অনেক অনুসারী ইয়াবা ও অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছেন।’
শওকতের ব্যবসায়িক পার্টনার বাঁশখালী উপজেলার সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান যুগান্তরকে বলেন, ‘পেকুয়ায় নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটিতে জিওব্যাগের কাজসহ নির্মাণসামগ্রীর সাপ্লাইয়ের কাজ করতাম। সময় দিতে না পারায় ২০১৯ সালে শওকতকে পার্টনার নিই। তখন আমি তাকে সাড়ে ২৬ লাখ টাকা দিই। পুরো টাকাটাই গায়েব। পরে প্রতারণার মাধ্যমে ওয়ার্ক অর্ডার তার নামে করে নেয়। এখন আমি নিঃস্ব আমার আর কিছুই নেই।’
ইমরান বলেন, ইয়াবা কারবার ছাড়া শওকতের এত টাকা আয়ের কোনো সুযোগ নেই। চট্টগ্রামের দিদারের কাছ থেকে ৫৫ লাখ টাকা, পেকুয়ার এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা, কাউসার নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে। তারা কেউ তেল, কেউ এস্কেভেটর, কেউ ইট-কংকর সরবরাহ করেছেন।’ চট্টগ্রামের বাসিন্দা মোরশেদ নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘শওকতের কাছ থেকে ডাম্পার ও এস্কেভেটর ভাড়া বাবদ আমি ২১ লাখ টাকা পাই। পেকুয়া থানায় জিডি করেছি। কিন্তু সে জিডি নেওয়ার কারণে উলটো পুলিশকে হুমকি দিয়েছে। জেনেছি সে একজন এমপির আশ্রয়ে আছে, তাই বেপরোয়া। আমি টাকা ফেরত চাই। আমার কাছে সব ডকুমেন্ট রয়েছে।’
পেকুয়া থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা নিয়ে আটক অন্তত দুজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শওকতের নাম বলেছেন। কিন্তু একজন এমপির হস্তক্ষেপের কারণে তাকে আসামি করা যায়নি। শওকতের এসব অপকর্মের পক্ষে এমপির অবস্থানের কারণে পুলিশ চাপে রয়েছে।’ তেল সরবরাহ করে ২৭ লাখ টাকা শওকতের কাছ থেকে আদায় করতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পেকুয়া বাজারের আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর কথা অনেকেরই জানা।
এছাড়া এই প্রতিবেদককে বক্তব্য দেওয়ার পর অনেকেই শওকতের হুমকি-ধমকির কারণে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে পেকুয়া থানার ওসি ফারহাদ আলি বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। তাই এত কিছু জানি না।’ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা শওকত বলেন, ‘আমি কোনো মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত নই। আমি একজন জনপ্রিয় নেতা। তবে অল্প সময়ের ব্যবধানে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তার কাছে কোটি কোটি টাকা পাওনা দাবি করা সবাইকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক বলেছেন। কোনো জবরদখলের সঙ্গেও তিনি জড়িত নন দাবি করে এসব বিষয়ে নিউজ করে তাকে কিছু করা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন শওকত। পরে দুজন সাংবাদিককে দিয়ে প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন তিনি।
শওকতের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় এমপি জাফর আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আজম নামের পেকুয়ার একজন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কাউকে শওকতের পক্ষে দখলবাজি করতে বলিনি। বরং পেকুয়ার ওসি ও ইউএনও আমাকে একাধিকবার বিচার দিয়েছেন তার একটি জমির বিষয়ে। যেটি সন্ত্রাসী আজম দখল করতে চায়। এজন্য দুজন এসি ল্যান্ড ও একজন ইউএনওকে বদলি করা হয়েছে।’ ছাত্রলীগ নেতা শওকতের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সরাসরি তাকে জানানোর জন্য ভুক্তভোগীদের অনুরোধ করেছেন এমপি জাফর আলম।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হাসানুজ্জমান বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতা শওকতের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে আমি আগে জানতাম না। এখন খোঁজখবর নেব।