হাওর বার্তা ডেস্কঃ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের একের পর এক মন্তব্যে বিব্রত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা এই মন্ত্রীর কথাবার্তায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছেন, আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণ করছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা শুক্রবার যুগান্তরকে বলেছেন, আব্দুল মোমেন ‘লাগামহীন’ মন্তব্য করে এক বছর ধরে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। তাকে যে কোনো সময় গণভবনে তলব করা হতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের কারণে বারবার বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাকে সম্প্রতি সতর্ক করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে বসবাস করছে’ মন্তব্যের কারণে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাকে সতর্ক করা হয় বলে কয়েকদিন আগে স্বীকার করেন আব্দুল মোমেন। তা সত্ত্বেও বিরামহীনভাবে বলে যাচ্ছেন তিনি।
এবার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দলের হাইকমান্ডে নালিশ করবেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা।
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য শুক্রবার দেশের জাতীয় দৈনিকগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে।
এর পরই শুরু হয়েছে সমালোচনা। প্রতিপক্ষ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই।
ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ দেশের অনেক স্বার্থ ভারতের কাছে জলাঞ্জলি দিয়েছে এমন মন্তব্য হরহামেশা করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৃহস্পতিবারের এই মন্তব্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আরও সুযোগ করে দিল বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা।
বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হয়।
আমি দেশটিতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। আজকে অনেকের বক্তব্যে সেটাই এসেছে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’
এর আগে বেহেশতে বসবাসের কথা বলে চরম সমালোচনার সৃষ্টি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই মন্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই আবার তিনি সমালোচনার জন্ম দিলেন। যা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একটি বড় অস্ত্র হিসেবে লুফে নিয়েছে।
অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যকে ব্যক্তিগত অভিমত বলে মন্তব্য করেছেন।
ওবায়দুল কাদের শুক্রবার রাজধানীর পলাশী মোড়ে জন্মাষ্টমীর এক অনুষ্ঠানে বলেন, যিনি এ কথা বলেছেন, এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। এটা আমাদের সরকারেরও বক্তব্য নয়, দলেরও বক্তব্য নয়।
আমি এটা পরিষ্কার করে সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেন, এ ধরনের (ক্ষমতায় টিকে থাকতে) কোনো অনুরোধ আওয়ামী লীগ করে না, কখনো করেনি। শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকেও কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
আমাদের ক্ষমতার উৎস বাংলাদেশের জনগণ। বাইরের কেউ আমাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পারবে না। আল্লাহর ইচ্ছা আর জনগণের সমর্থনেই আওয়ামী লীগ টিকে আছে। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে বৈরিতা চাই না। ২১ বছর বৈরিতা করে আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ভারত আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজমান।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে বহুদিনের সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। কয়েকটি সমস্যার অগ্রগতি আসবে। সেপ্টেম্বরে আরও কিছু বিষয়ে সমাধান হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে অহেতুক মন্তব্য না করার পরামর্শ দেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, এতে করে ভারতও লজ্জা পায়, কীভাবে আপনি এ কথা বলেন। বন্ধু আছি, সম্পর্কটা ভালো আছে, অহেতুক কথা বলে এটা নষ্ট করবেন না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘ক্ষমতায় টিকে থাকা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তা আমাদের দলের নয়, সরকারেরও নয়। এটা তার ব্যক্তিগত মত। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কথার দায়-দায়িত্ব সরকার ও দল নেবে না।’
তিনি বলেন, ভারত আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বলীয়ান। কোনো বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়।
তবে ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করে বলেন, এ সম্পর্কে ইতোমধ্যে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন।
নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বহির্বিশ্বের কাছে একটি দেশের মুখপাত্র। তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়।
কিন্তু আমাদের দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষণে ক্ষণে যে ধরনের কথাবার্তা বলছেন, তাতে বিদেশে দূরে থাক এখন দেশেই তার মুখ বন্ধ রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন যুগান্তরকে বলেন, রাজনীতিবিদরা অবশ্যই কথা বলবেন। তবে কী বলা উচিত, কী বলা উচিত নয় তা দায়িত্ববান ব্যক্তির বোঝা উচিত।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনতে দেশটিকে অনুরোধ জানানোর কথা সাংবাদিকদের বলে দলের মধ্যেই সমালোচনার সূত্রপাত করেন আব্দুল মোমেন।
পরে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা তার এই বক্তব্য খণ্ডন করেন। তারা বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানানোর বিষয়টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের সিদ্ধান্ত নয়। এটা পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের ব্যক্তিগত মত হতে পারে।
জুনে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, মন্দির ভাঙচুর এবং পূজামণ্ডপে হামলা নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা হয় বলে মন্তব্য করেন।
তার এই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও পূজা পরিষদ। তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে। এরপর সিলেটে আরেক বেফাঁস মন্তব্য করে তিনি চরম সমালোচনার মধ্যে পড়েন।
তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সরকার যখন চরম সমালোচনার মুখে তখন এই মন্ত্রী দাবি করেন বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে বসবাস করছে।