শ্বশুরের দেয়া ফ্ল্যাটে এক শিক্ষকের যৌন লালসার কাহিনী নিয়ে দেশ তোলপাড়। বউ নিয়ে থাকতেন ইস্কাটনের বাসায় আর পান্থপথে দেয়া শ্বশুড়ের ফ্ল্যাটে বানিয়েছিলেন তার যৌন হেরেম। ছাত্রীদের ব্লাকমেইলিং করে যৌন হয়রানি করে এথানে গড়েছিলেন তার যৌন বিকৃতির এক অন্ধকার জগত। তিনি আর কেউ নন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহসানউল্লাহর শিক্ষক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস।
পরিবার জানতো পান্থপথের ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া। পড়া বোঝানো, টিউটোরিয়াল, অ্যাসাইনমেন্ট, গ্রুপ ডিসকাস, থিসিস মূল্যায়ন, চারিত্রিক সনদের নাম করে ছাত্রীদের ডেকে আনতেন ফ্ল্যাটে। এরপর শুরু করতেন যৌন হয়রানি।
রাজি না হলেই পরীক্ষায় ফেল, ড্রপ-আউট, চারিত্রিক সনদ না দেয়াসহ নানা হুমকি। কয়েকজন ছাত্রীকে সেমিস্টার ড্রপ-আউটও করিয়েছেন ফেরদৌস। এসব অভিযোগে গত শনিবার তাকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
৪ এপ্রিল ভোররাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন একজন শিক্ষার্থীর করা নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় কলাবাগান থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে ২ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। তাকে স্থায়ী বহিষ্কারসহ ৪ দফা দাবিতে গত শনিবার থেকে করে আসা টানা আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
অভিযুক্ত ছাত্রীর সহপাঠীরা জানান, গত ২ মার্চ দুপুর আড়াইটায় শিক্ষক ফেরদৌস ওই ছাত্রীকে পান্থপথের বিল্ডিং নং ১৫২/২/জি/১-২, ৪ নং ফ্ল্যাটের যেতে বলেন। থিসিস বোঝানোর নামে একপর্যায়ে ওই ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করেন শিক্ষক ফেরদৌস।
ওই সময় ছাত্রী ধস্তাধস্তি করে সেখানে থেকে চলে আসেন। পরে ওই শিক্ষক একটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে ভিকটিম শিক্ষার্থীর দু’টি নম্বরে অশ্লীল ও আপত্তিকর ভাষায় মেসেজ পাঠান। সেখানে হুমকি দেয়া হয়, এই বিষয়টি অভিভাবক বা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানালে পরিনাম খারাপ হবে।
ওই ছাত্রী পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে বিভাগের সিনিয়র দুই শিক্ষার্থী ও একজন সহপাঠীর কাছে বিষয়টি জানিয়ে পরামর্শ চান। তার শঙ্কা ছিল ফেরদৌস তার খাতায় নম্বর কমিয়ে দেয়াসহ তাকে বহিষ্কার করতে পারেন। পরে সিনিয়রদের পরামর্শে ওই ছাত্রী বিভাগীয় চেয়ারম্যানের কাছে নিজের নাম উল্লেখ না করে পুরো ঘটনা লিখিত আকারে অভিযোগ করেন। চেয়ারম্যান স্বাক্ষরবিহীন এই চিঠিতে ঘটনার বর্ণনা দেখে বিব্রতবোধ করে অভিযোগটি ভিসি’র কাছে নিয়ে যান। ভিসি অভিযুক্ত শিক্ষককে ডেকে এই ঘটনার সম্পর্কে জানতে চান। ভিসি তাকে এ ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করার কথা বললেও কৌশল অবলম্বন করেন ফেরদৌস।
ক্ষণিক এর জবাব না দিয়ে দুইদিন সময় চান। এই দুইদিনে ফেরদৌস সকল ছাত্রীকে ফোন করে অভিযোগ করেছে কী না জানতে চান। ছাত্রীদের হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, অভিযোগকারীর নাম জানতে পারলে আমি তাকে লাল টিসি (অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে পারবেন না) ধরিয়ে দিবো। কোনো ছাত্রী অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার না করায় দুইদিন পর তিনি ভিসি’র কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
উল্টো কয়েকজন ছাত্রীর নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ফেরদৌস বলেন, এই ছাত্রীরা পড়াশুনা করেন না। তাদের পড়াশুনার চাপ দেয়ায় আমার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত এসব অভিযোগ করছে।
তাৎক্ষণিক ভিসি এসব অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ আছে বলে তাকে পদত্যাগ করতে বলেন। তিনি তাতে রাজি হননি। তাকে তদন্ত কমিটির কাছে এই বিষয়ের মুখোমুখি হতে হবে বলে জানান ভিসি। এতে সায় দেন ফেরদৌস।
এরই মধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষক তৃতীয় পক্ষ থেকে জানতে পারেন ইইই ১ম বর্ষ ২য় সেমিস্টারের এক ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে এ খবর পেয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ওই ছাত্রীকে নানাভাবে হুমকি দেয়া শুরু করেন। এই ছাত্রী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কাছে বিষয়টি জানায়। এরপর বুধবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য আসাদুল্লাহ আল সায়েম কলাবাগান থানায় ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। এ মামলাতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রীদের সঙ্গে নানা কায়দায় যৌন হয়রানি করছিলেন। ক্লাসে পড়া বুঝানোর নামে পান্থপথে বাসায় ডাকতেন। এরপর জোরপূর্বক যৌন হয়রানি করতেন। এতে কেউ রাজি না হলে তাকে সেমিস্টারে ফেল, ইনকোর্স ও অ্যাসাইমেন্টে নম্বর কমিয়ে দেয়ার হুমকি দিতেন। তার বড় অস্ত্র ছিল চারিত্রিক সনদপত্র। তার কথায় রাজি না হলেই চারিত্রিক সনদ না দেয়ার হুমকি দিতেন। কারণ তিনি সহযোগী প্রক্টরের দায়িত্ব ছিলেন। অনেকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর না থাকায় এ সুযোগটি নেন ফেরদৌস।
সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের যৌন লালসার শিকার হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থীরা। এসব ঘটনায় অভিভাবকরা তাদের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত।