হাওর বার্তা ডেস্কঃ ছাদের বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন হাজী মোহাম্মদ সোলায়মান।
আবেশী আলোর সাথে ঝুলানো ঘণ্টার
ছোট ছোট ধ্বনি
ইচ্ছের আকাশে কখনো বা নরম হাতের
উষ্ণ পরশ
দ্যাখ দ্যাখ, পাতাগুলো কত ছোট,
কী দারুণ…
গোড়াটা বেশ একটু একটু করে গুঁড়ির আকার পাচ্ছে….
বিভূতি দাসের এই কবিতার মতো করেই বেড়ে ওঠে বনসাই। তারপর মুগ্ধ করে। তাকে ঘিরে কত বিতর্ক আর ভালোবাসা! মোহাম্মদ সোলায়মান কোনো বিতর্কের ভেতরে না গিয়ে জানিয়ে দেন, ‘এটি জীবন্ত শিল্প। আমার আত্মাকে তৃপ্ত করে।’
অবসরের পর
অবসর গ্রহণের পর বন্ধুদের রোগাক্রান্ত ও কর্মবিহীন জীবনযাপন করতে দেখে মোহাম্মদ সোলায়মান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে জীবন তিনি যাপন করবেন না। যে কাজ করে বেশি আনন্দ পাবেন, সেটাই বেছে নেবেন তিনি। বনসাইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি সেটিকেই বেছে নেন অবসরের দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবনের জন্য। ২০০৮ সালে তিনি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পদ থেকে অবসর নেন এবং বনসাইয়ের জগতে ডুব দেন। প্রস্তুতি হিসেবে দেশ-বিদেশে ট্রেনিং নেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বনসাই মেলায় অংশ নেন। ভিয়েতনামের হোচিমিন থেকে হ্যানয় ঘুরে বেড়ান বনসাই দেখতে ও শিখতে।
মোহাম্মদ সোলায়মান এখন ৭৪ বছর বয়সী এক দারুণ মানুষ। নীরোগ, কর্মঠ আর প্রাণচঞ্চল।
বনসাই
মোহাম্মদ সোলায়মানের ছাদে
এখন বনসাইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহ। একটি-দুটি করে সংগ্রহ করেছেন প্রায় ৫০০ গাছ। তাঁর বাড়ির ছাদে আছে ১৫০টির মতো বনসাই।
চীন, জাপান, তাইওয়ান ও ভিয়েতনাম থেকে তিনি গাছ ও গাছের যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেন। তাঁর সংগ্রহ দারুণ সমৃদ্ধ। ফুকেন্টি, চায়নিজ এলম, হানি লুকাস্ট, ল্যান্ডস্কেপ, রাইটিয়া, ডেজার্ট রোজ, অ্যাডানিয়াম, মাইক্রোকার্পাস, চায়নিজ বট বা ফাইকাসসহ ৯-১০ ধরনের বিদেশি গাছের বনসাই
আছে তাঁর কাছে। আছে বট,
পাকুড়, কামিনী, ছাতিম, জাম, তমাল, হিজল, বাবলা, আমপাতা বট, তেঁতুলসহ বিভিন্ন ধরনের
দেশি গাছ। আছে আফ্রিকান বাওবাবগাছ।
জানা গেল, দেশ-বিদেশের জঙ্গল কিংবা নার্সারি থেকে বিভিন্ন গাছের মুথা, অর্থাৎ শিকড় সংগ্রহ করেন মোহাম্মদ সোলায়মান। তারপর ৫-১০ বছর নিয়ম মেনে পরিচর্যা করে সেগুলো ফার্মে নেন। ফরিদপুরের এক নার্সারি থেকে তিনি মাত্র ১৫০ টাকায় প্রথম কিনেছিলেন চায়নিজ বটের বনসাই। ২০০৬ সালে কেনা সেই চায়নিজ বট এখন অনেক পরিণত ও দৃষ্টিনন্দন।
বনসাইময় জীবন
শুরুর দিকে পরিবার থেকে কিছুটা বাধা এলেও পরে সবাই সহায়তা করতে শুরু করেন। ২০১৯ সালে গুলশান ক্যাডেট কলেজ ক্লাবে বনসাই মেলা হয়েছিল। বনসাই মেলায় অংশ নিয়ে ১০ লাখ টাকার বনসাই গাছও বিক্রি করেন মোহাম্মদ সোলায়মান। বনসাই বিক্রির সে টাকায় ভিয়েতনামের আন্তর্জাতিক বনসাই মেলায় অংশ নেন। পরিবারের কয়েক জন সদস্যসহ মোট পাঁচজন গিয়েছিলেন ভিয়েতনাম।
মোহাম্মদ সোলায়মানের জীবন এখন বনসাইময়। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে গাছে পানি ও সার দেন, প্রুনিং করেন। তারপর হাতিরঝিলে দৌড় কিংবা ব্যায়াম করেন। ফিরে নাশতা সেরে আবার ছাদে উঠে গাছের পরিচর্যা করেন। তাই তিনি এখন টেরই পাচ্ছেন না সময় কীভাবে চলে যাচ্ছে। অন্যদের মতো ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো অসুখ নেই তাঁর।
মোহাম্মদ সোলায়মান মনে করেন, অবসরের পর সবুজের সান্নিধ্যে থাকলে মন ও শরীর দুই-ই ভালো থাকে। ঘরে বনসাই রাখলে সৌন্দর্য বাড়ে আর অফুরন্ত অক্সিজেন পাওয়া যায়।
মোহাম্মদ সোলায়মান মনে করেন, বনসাই জীবন্ত শিল্পকর্ম। একটা গাছকে শিল্পের আকার দিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এটি মনের খোরাক মেটায়। পুরোনো গাছ সংগ্রহ করে সেটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ায় তিনি অন্যায় কিছু দেখেন না।
নতুনদের জন্য
‘প্রচুর ধৈর্য থাকতে হবে। নয়তো হবে না।’ নতুনদের প্রতি মোহাম্মদ সোলায়মানের এটাই প্রথম পরামর্শ। তারপর ট্রেনিং নিতে হবে। কীভাবে মাটি বদলাতে হয়, কীভাবে পানি ও সার প্রয়োগ করতে হয়, প্রুনিং ওয়্যারিং করতে হয়—সেগুলো হাতে-কলমে শিখে তারপর বনসাই বানাতে আসতে হবে বলে মনে করেন মোহাম্মদ সোলায়মান।