হাওর বার্তা ডেস্কঃ খাল-বিলের ধারে পরিত্যাক্ত কিংবা অনুর্বর জমিতে ডাল জাতীয় ফসল অড়হর চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে রংপুরসহ আশপাশ এলাকায় চাষ শুরু হয়েছে।
শুধুমাত্র বীজের খরচটুকু দিলে জমির আইলে বাড়তি ফসল হিসেবে অড়হর চাষ করা যায়। অড়হর চাষে খরচ একবারেই নেই বললেই চলে, উর্বর জমিরও প্রয়োজন হয় না। পরিত্যক্ত-অনুর্বর জমিতে অড়হর চাষ করা যায়।
কৃষকরা জানান, অড়হর লাগানোর ১২০ দিনের মধ্যে তা উত্তোলন করা যায়। স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে সারি ও গাছের দূরত্ব থাকবে এক ফুট, মধ্যমেয়াদি জাতে দুই ফুট এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতে তিন ফুট/দুই ফুট দূরত্বে বীজ বোনা যায়। বিঘাপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে উচ্চ ফলনশীল নতুন নতুন বিভিন্ন ফসলের চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওষুধিগুণ সম্পন্ন ও সম্ভাবনাময় ডালজাতীয় ফসল অড়হর আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলে চলতি বছর অড়হর চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৭০ হেক্টর ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ৩৬ হেক্টর। এর মধ্যে রয়েছে রংপুর জেলায় ৩০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ৫ হেক্টর ও লালমনিরহাটে ১ হেক্টর। কম খরচে এর চাষ করলে মাটিতে গাছের পাতা পড়বে, গাছও বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের মতো করে রসদ জোগাড়ের চেষ্টা করবে।
এভাবে ধীরে ধীরে অনুর্বর জমিও অন্য ফসল চাষের উপযোগী হয়ে উঠবে। ডাল জাতীয় ফসল হওয়ায় এটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। অড়হরের মূলে বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন সঞ্চিত হয়, যার ফলে এই জাতীয় শস্য চাষে একদিকে যেমন জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় তেমনই এটি ভূমিক্ষয় রোধ করতেও সক্ষম। এছাড়া গাছ কিছুটা বড় হলে তার থেকে জ্বালানিও মেলে। অড়হর গাছ ফসলের উপকারী পোকার আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। ফলে চাষিদের লাভের পরিমাণ কিছুটা হলেও বাড়ছে।
জানা গেছে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) রংপুরের বদরগঞ্জে অবৈধভাবে দখল হওয়া ভাড়ারদহ বিল উদ্ধারসহ খনন করে বিলের পাড়ে চারদিকে ডালজাতীয় ফসল অড়হর লাগানো হয়েছে। গাছে এখন দোল খাচ্ছে করছে অড়হরের শুটি। বীজের জন্য শুটিগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইআইআরপি প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান বলেন, শুধু ভাড়ারদহ’ই নয়, রংপুর অঞ্চলে খননকৃত খালগুলোর পাড়ে অড়হর লাগানো হয়েছে। এতে একদিকে যেমন অড়হরের গাছের বেড়ায় খালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি শোভাবর্ধনও হচ্ছে।
রাজশাহীতে কৃষিভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছেন শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা হাসান আল শাদী পলাশ। দীর্ঘ ৭ বছর ধরে ১৩ বিঘা আয়তনের আমবাগানে গড়ে তুলেছেন “ড্রিমার্স গার্ডেন” নামে এক ফুল-ফলের রাজ্য। যেখানে ৫০ টাকার টিকিট কেটে ইচ্ছামতো আম-লিচু খাওয়ার সুযোগ পাবেন দর্শনার্থীরা।
ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে তাঁর এই বাগান। নিয়মিত দর্শনার্থীর ভিড় জমেই আছে। রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩০০ আম ও ৩০ টির মতো লিচুগাছ। বাগানের চারদিকে শুধু রঙের ছাড়াছড়ি। ১৬ জাতের ফুলগাছ দিয়ে থরে থরে সাজানো বাগানে রয়েছে শীতপ্রধান দেশের টিউলিপ, গ্লাডিওলাস, পাঁচ ধরনের ইনকা গাঁদা, ছয় রঙের টিউলিপ, পিটুনিয়া, হাইব্রিড নয়নতারা, গেজিনিয়া, মেলোসিয়া, ড্রপ চন্দ্রমল্লিকা, পেনজি ভারবিনা, সালভিয়া ইত্যাদি।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পলাশবাড়ী গ্রামে বাগানটির অবস্থান। যেতে হলে শহর থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে যেতে হবে। প্রায় দেড় যুগ আগের গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া ও লকনা আমগাছ মৌসুম ছাড়া কোন কাজে আসে না ফলে হাসান আল শাদী নতুন চিন্তা করলেন! ভাবলেন, বাগানে আম গাছগুলোর ফাঁকা স্থান কোন কাজে আনা যায় কিনা? সেই চিন্তা থেকেই শুরু করলেন ফুলের চাষ। চলতি মৌসুমে চাষ করেছিলেন টিউলিপ যা দেখতে হাজারো দর্শনার্থী ভিড় জমায় ড্রিমার্স গার্ডেনে।
চাঁপাইনাবগঞ্জ সদরে হাসান আল সাদী নামের এই যুবকের বাড়ি। শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে আইনে স্নাতকোত্তর। কথা বলে জানা যায়, তাঁর এক আত্মীয়ের বাগান এটি। বাগানে গত মৌসুমে ব্যাগিং করেছিলেন আমে। ভালো দামে বিক্রি হওয়ায় লাভবান হয়েছেন। তারপর চিন্তার প্রসার ঘটাতে লাগলেন। ফল হিসেবে গত অক্টোবর মাস থেকে বাগানে শুরু করেছেন ফুলের কারবার।
বাগানজুড়ে এখন ফুলের মেলা। গাছের ডালে ডালে শোভা পাচ্ছে প্যাঁচানো বাহারি বিভিন্ন ফুলের টব। বাগানে দর্শনার্থীদের একান্তে সময় কাটানোর জন্য করা হয়েছে বিভিন্ন কর্নার। চিন্তা করেছেন একটি লাইব্রেরি করার। যাতে নিরিবিলি বসে মনের খোরাক যোগাতে পারেন। এদিকে বাগানের এক কোনে রয়েছে একটি পুকুর। বাগানের পুকুরে ভাসছে ফুলের নৌকা। এরপর আসছে আমের মৌসুম। গাছে পাকা আম দেখার একটা আনন্দ আছে। ইচ্ছেমতো দর্শনার্থীরা পাকা আম পেড়ে খেতে পারবেন, নিতে পারবেন। ইচ্ছামতো আম-লিচু খাওয়ার সুযোগ দিতে চান তিনি। শিশুদের দৌড়ঝাঁপ করার যে শৈশবের চিত্র তা দেখতে চান এই তরুণ উদ্যোক্তা। আর মনের এই আনন্দের জন্যই এতকিছু!
হাসান আল শাদী বলেন, “ আমরা ইট পাথরের দেয়ালে আটকা পড়ছি দিনদিন। আমাদের শিশুরা বইয়ের মলাটে রুদ্ধশ্বাস। হাফছেড়ে বাঁচার জন্য তাদের খেলাধুলা করা প্রয়োজন। আমার এখানে পরিবারসহ লোকজন আসবে, স্বামী-স্ত্রী বসে দুটো সময় কাটাবে এটাই আমি চাই। মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি আনতে চাই। শরীর-মন দুটোই সুস্থ থাক।
পরিকল্পনা জানতে চাইলে হাসান আল সাদী বলেন, তাঁরা চান, ক্রেতারা বাগানে আসবেন, গাছে পাকা আম দেখবেন, নিজ হাতে পাড়বেন, খাবেন, কিনে নিয়ে যাবেন। এখন টমেটো ওষুধ দিয়ে পাকানো হয়। তাঁদের গাছে টমেটো থাকবে। দর্শনার্থীরা আসবেন। নিজ হাতে গাছ থেকে পাকা টমেটো তুলবেন, নিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ‘এভাবে কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করার চেষ্টা করছি, যার মাধ্যমে আমরা এখানে কৃষিভিত্তিক পর্যটন স্বপ্ন দেখছি।’
বাগানে টিউলিপ দেখতে ছুটে এসেছেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী বদরুদ্দোজা। বাগান দেখে অনুভূতি ব্যক্ত করেন তিনি। বদরুদ্দোজা বলেন, “আমি কখনো এতো ফুল একসাথে দেখিনি। আর ৫০ টাকার টিকিট কেটে আমের মৌসুমে আম আর লিচু খাওয়ার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ এই প্রথম। নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ।”
বাগানে ঘুরতে আসেন দুইবোন বিপাশা খাতুন ও তামান্না আক্তার। রাজশাহী কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার বলেন,“কন্দের মাধ্যমে টিউলিপ ফুল বংশবিস্তার করে। ফুলগুলো বিভিন্ন রঙের হয়। বেশ আকর্ষণীয় হওয়ায় প্রতিটি গাছ ও ফুল দামী। এখান থেকে একটা গাছ কিনতে চাইলাম কিন্ত বিক্রি করলেন না। হাজার টাকা দাম পড়তে পারে।”
আমবাগানে নতুন এই চিন্তার প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করেছেন রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোছাঃ উম্মে ছালমা নিজে বাগান পরিদর্শন করে জানান, “রাজশাহীর হাসান আল শাদী পলাশ নামে এক যুবক আমবাগানে টিউলিপ চাষ করেছেন। তিনি কৃষিভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে চান। টিউলিপ শীতপ্রধান দেশের ফুল হলেও ঢাকার সাভার, যশোরের গদখালিসহ বিভিন্ন জায়গায় চাষ হচ্ছে। সরকার থেকে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য কোন সুযোগ-সুবিধা আসলে নিশ্চয় চাষিরা পাবে।