দখলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিচারপতির বাড়ি সরকারি সম্পত্তি টেন্ডার, বাস লঞ্চ টার্মিনাল, জাতীয় প্রেসক্লাব, রেলের জমি, নদী-নালা খাল-বিল দখল হচ্ছে অবাধে

দখল সংস্কৃতির এক নতুন যুগ চলছে দেশজুড়ে। বিচারপতির বাড়ি, সরকারি সম্পত্তি, টেন্ডার থেকে শুরু করে পেশাজীবীদের ক্লাব-সংগঠনও দখলবাজির ধকল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে প্রভাবশালীরা সর্বত্রই গড়ে তুলেছে দখলবাজির সিন্ডিকেট। তারা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দাপটের সঙ্গে একের পর এক দখল করে নিচ্ছে সবকিছু।

দখল হচ্ছে খাল-বিল, নদী-নালা, ফুটপাথ, দখল হচ্ছে ওভারব্রিজের উপর পথচারী চলাচলের স্থানটুকুও। দখলবাজির বিরামহীন দৌরাত্ম্য একচিলতে জায়গা ফাঁকা রাখার যেন কোনো উপায় নেই। সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে মিল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, জমিজিরাত, বাড়িঘর পর্যন্ত দখল করে নেওয়া হচ্ছে। এসব নিয়ে র‌্যাব-পুলিশ আর প্রশাসনের দফতরে দফতরে অভিযোগের পাহাড় জমে উঠছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ব্যানারে দাপিয়ে বেড়ানো দখলবাজদের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অসহায় হয়ে পড়ছেন। দখলবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। র‌্যাবে অভিযোগ বেশি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মামলা ও অন্যান্য কারণে র‌্যাব এ নিয়ে নাক গলাচ্ছে না।  এদিকে  পুলিশ  দখলকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রেই  উল্টো দখলবাজদের পক্ষেই সক্রিয় ভূমিকায় মাঠে থাকছে। রাজধানীর সর্বত্র ফুটপাত দখল করে সারা বছর বেশুমার বাণিজ্য চললেও ইদানীং দখলবাজরা ব্যস্ততম রাস্তার একাংশ দখল করেও নানারকম স্থাপনা গড়ে তুলছে। ঢাকার গুলশান-বনানী ও উত্তরার অভিজাত এলাকায় দখলবাজদের কৌশল ভিন্ন। সেখানে পাকিস্তানিদের অনেক বাড়িকে ‘বিহারিদের সম্পদ’ দেখিয়ে দফায় দফায় দখল-পাল্টা দখল হয়। পুরান ঢাকায় একজনের জায়গা-জমি, বাড়িতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই অন্যজন দখল করে নিচ্ছে। দখল হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় হল, ভোটকেন্দ্র, টেন্ডারবাক্স, প্রেসক্লাব, বাস-লঞ্চ টার্মিনাল, সরকারি খাসজমি, লেক, রেলের জমি, এমনকি পাহাড় পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসে। গেল এক দশকে দখলে গেছে রাজধানীর অন্তত ১২টি মাঠ ও শিশুপার্ক। রাজধানীর শিশুরা এখন খেলার জায়গা খুঁজে নিচ্ছে কম্পিউটারে, মোবাইলে। ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটারই এখন অবৈধ দখলে। এসব সড়ক দখল করে তা ভাড়া দিয়ে অর্জিত টাকার অংশ পৌঁছে যাচ্ছে ওপর মহলে। অনেক সাবেক নেতা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত দখল করে নেয়। দখলবাজির ধকল থেকে শিল্প-সংস্কৃতি, সামাজিক কর্মকাণ্ডও রক্ষা পাচ্ছে না। একজনের নাট্য সংগঠন, আবৃত্তি পরিষদ পর্যন্ত অন্যজন দখল করে নিচ্ছেন।ফুটপাত-রাস্তার দখলবাজি চলছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। হাজার হাজার ফুটপাত দোকান থেকে দিনভিত্তিক চাঁদা তুলে চাঁদার টাকার সিংহভাগ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে গডফাদারদের কাছে। গডফাদারদের ধার্যকৃত মাসোহারার টাকা যথারীতি পাঠানো হচ্ছে থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতিপরায়ণদের কাছে। রাজধানীর শুধু মতিঝিল-দিলকুশার ফুটপাত দখলবাজির মাধ্যমেই প্রতিমাসে আজাদের গ্রুপ হাতিয়ে নিচ্ছে ১০ কোটি টাকা। বাড্ডা এলাকায় ফুটপাত নেই তাতে কী? ব্যস্ততম প্রগতি সরণির অতিব্যস্ত রাস্তার জায়গা দখল করেই হাটবাজার বসিয়েছে জয়নাল গ্রুপ। রাস্তার একাংশ দখল করে শত শত চৌকি বসিয়ে রেক্সিন-পলিথিনের ছাউনিতে গজিয়ে উঠেছে দোকানপাট। সেখান থেকেই প্রতিমাসে জয়নালের সহযোগীরা চাঁদা তুলছে সাড়ে সাত লক্ষাধিক টাকা। সড়ক ভবন, এলজিইডি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, রাজউক, ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ বিভিন্ন দফতরে টেন্ডার বাক্স দখলে নিয়ে কোটি কোটি টাকার সরকারি কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্রের বেশ কয়েকটি গ্রুপ। এই টাকা লুটপাটের মেশিন খ্যাত ‘টেন্ডার বাক্স’ দখলকে কেন্দ্র করে একাধিক দখলবাজ গ্রুপের সংঘাত-সংঘর্ষ, বন্দুকযুদ্ধে প্রায়ই প্রাণ হারায় নিরীহ লোকজন।দখল-পাল্টা দখলের কবল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোরও যেন রেহাই নেই। পক্ষ-প্রতিপক্ষরা গোটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই জবর দখল করে নেওয়ার নজিরবিহীন কৃতিত্ব দেখিয়ে চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই বারবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাও বিশ্ববিদ্যালয় জবর দখলবাজির মাধ্যমে ব্যাপক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। সাবেক এক রাষ্ট্রপতির পত্নী পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতেও বেপরোয়া দখলবাজ সিন্ডিকেটের কোনোরকম সমস্যা হয়নি। প্রতিটি রাজনৈতিক দল, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো রাজধানীর সবগুলো ওয়ার্ডেই সরকারি জায়গা দখল করে সাংগঠনিক কার্যালয় বানিয়েছে। মহল্লা পর্যায়েও তারা রাস্তা কিংবা সরকারি জায়গা দখলে নিয়ে গড়ে তুলেছে ইউনিট কমিটি। বিরোধপূর্ণ জায়গার উপর দলীয় সাইনবোর্ড লাগিয়েও দখলবাজদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। মহাখালী এলাকায় রেলওয়ে ও সড়ক বিভাগের বড় অংশ দখল করে নামসর্বস্ব কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের ঢাউস আকারের কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি কার্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেই বানিয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। একটি রিয়েল এস্টেটের সাইট অফিসও গড়ে উঠেছে সেখানে। কার্যালয় স্থাপনের নামে সরকারি জায়গায় অঘোষিত মার্কেট বানানোর দায়ে অভিযুক্ত নেতাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি পাল্টা ক্ষুব্ধ হন। ওই নেতা জোর গলায় বলেন, ‘দখলবাজি নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করার মতো কোনো অধিকার আর সাংবাদিকদের নেই। সাংবাদিকরা নিজেদের ক্লাব-সংগঠনের কার্যালয় দখল-বেদখল নিয়েই ব্যস্ত। নিজেরা অপরাধে জড়িয়ে পড়লে অন্যদের অপরাধী বলার অধিকার আর থাকে না’ বলেও মন্তব্য করেন ওই নেতা। দলিলপত্র, দাগ-খতিয়ানের জটিলতায় দাবিদার দুই পক্ষের বিরোধপূর্ণ জমিতে রাতারাতি তৃতীয় পক্ষের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়। সে সাইনবোর্ডে লেখা থাকে- ‘মামলাজনিত বিরোধপূর্ণ এ জায়গাটির বায়না সূত্রে বর্তমান মালিক অমুক… নেতা। যে কোনো ব্যাপারে তার মোবাইল… নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য বলা হলো।’ রাজধানীর ডেমরা, পল্লবী, উত্তরা, দক্ষিণখান, কাফরুল, গুলশান-বনানী এলাকায় প্রভাবশালী অনেক নেতা জবরদখল, লুটপাট, দাঙ্গাহাঙ্গামা পছন্দ করেন না। তাদের চোখ খুঁজে বেড়ায় শুধু বিরোধপূর্ণ জায়গা জমি। কোনো জমি নিয়ে দুই মালিকের কথা কাটাকাটি হলেই প্রভাবশালী নেতাদের চ্যালা চামুণ্ডারা পুরো জায়গাই জবর দখলে নিয়ে নেয়। বিরোধ মিটিয়ে দেওয়ার নামে নেতার বৈঠকখানায় সমঝোতার আসরেই নেতা নিজেই জমিটির একচ্ছত্র মালিক বনে যান। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও একজন আরেকজনের দখলবাজির শিকার হচ্ছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুল কাদেরের কার্যালয় দখল করে নিয়েছে সেখানকার আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলর। রাজধানীর বাইরে সারা দেশে দখল-জবর দখলের চিত্র আরও ভয়াবহ। ধলেশ্বরী নদীর একাংশসহ দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক ইটভাটা। এসব ইটভাটাকে ঘিরে এখন চলছে নদী ভরাট করে দখলের উৎসব। ঢাকার কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার পাথরঘাটা, লতব্দি, রামকৃষ্ণদি, কয়রাখোলা, বালুচর, রাজানগর, আকবরনগর, সিপাহীপাড়া, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, ফতুল্লা, নবীনগর, বক্তাবলী, নরসিংহপুর ও আশপাশের নদীর ২০ কিলোমিটার পাড়জুড়েই গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। এদিকে ঢাকার নবাবগঞ্জে ইছামতি নদীর চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাঁশের বেড়া, টিনের চালি এবং জালের ঘেরাও দিয়ে মাছ চাষ ও বেচাকেনার ব্যক্তিগত খামার বানিয়ে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও শিকারীপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ নদী দখল এবং মাছ বাণিজ্য চালালেও তার বিরুদ্ধে কারও টুঁ-শব্দটি করার উপায় নেই। জবর দখলকারীরা অনেক আগেই মধুপুর বন উজাড় করে ফেলেছে। এখন তারা বনভূমি জবর দখলে মেতে উঠেছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। স্থানীয়রা জানান, এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করলেই বনের ভেতর চমৎকার বাড়ি বানানোর জায়গা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ বন কর্মকর্তা আর প্রভাবশালী বন দস্যুচক্র মিলেমিশে অঘোষিতভাবেই বনভূমি বিক্রির জমজমাট ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। এ ব্যাপারে পিকেএসএফ ও ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিক্সের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু জমি, খাল, নদী, ফুটপাত দখলই নয়, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। কারোরই কিছু হয় না। এমনকি সিভিল সোসাইটির একটা অংশ যারা দখলবিরোধী ক্যাম্পেইন করে, তারাও দখলে অংশ নিচ্ছে। ঢাকার খালগুলো এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেটুকু উন্মুক্ত আছে সেটুকু বাঁচানো জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, দখল প্রতিরোধে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। যারা এটা করছে তারা চিহ্নিত হলেও বিচার হচ্ছে না। দখলবাজ, লুটেরাদের বিচার না করলে দখল বন্ধ হবে না। উল্টো এরা সর্বক্ষেত্রেই পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে অন্যরা আরও উৎসাহিত হয়ে দখল উৎসবে যোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত এ ব্যাপারে বলেন, দখলে সবাই মিলেমিশে অংশ নিচ্ছে। দেখা যায় এক ভাই আওয়ামী লীগ করলে, আরেক ভাই করছে বিএনপি, আরেকজন জামায়াত। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক মিলেমিশে দখল বজায় রেখেছে।  খাসজমি, নদী, খাল সবকিছু দখল করে নিচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে দখল প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, জমি দখল করতে প্রথমে মসজিদ বানানো হচ্ছে, পরে বহুতল ভবন করে উপরে মসজিদ ও নিচে মার্কেট করা হচ্ছে। ফুটপাত দখল হচ্ছে। বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত সরকারি লোকজনের কাছ থেকে এগুলো ভাড়া নিচ্ছে, সরকারি লোকজন পয়সা পাচ্ছে। ফুটপাতে দোকান দিতে ছাত্রলীগ আর পুলিশকে পয়সা দিতে হচ্ছে। আর এ টাকার ভাগ চলে যাচ্ছে ক্ষমতার বিভিন্ন পর্যায়ে।  গরিব-অশিক্ষিত মানুষ এসব দখলে যায় না। শিক্ষিত জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন লোকজনই এগুলো করছে। দখল বন্ধ করতে স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কর্মসংস্থান সাংবিধানিক অধিকার। কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করা অনৈতিক। সবার আগে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এসবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর