হাওর বার্তা ডেস্কঃ মো. ফিরোজ মিয়া। বয়স ৬৫ ছুঁই ছুঁই । দারিদ্রতার কষাঘাতে দেহে অনেকটাই যেন বার্ধক্যের ছাপ। পায়ে হেঁটে ছুটে চলছেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। হাতে রয়েছে হাতুড়ি বাটাল আর ছেনি ওইসব জিনিসের সাহায্যে ঠুকে ঠুকে করছেন শিলপাটার ধার দেওয়ার কাজ। এমন এক দৃশ্য দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের তারাগন এলাকায়।
ফিরোজ মিয়া ৪৫ বছর বছর ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিল-পাটার ধারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন । তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের চাপারতলা গ্রামের বাসিন্দা।
এদিকে বর্তমান এই আধুনিক যুগে দিন দিন বাড়ছে প্রযুক্তির চাহিদা ও ব্যবহার। এরইমধ্যে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার পৌঁছে গেছে গ্রামে গঞ্জেও। তবে খাবারকে সুস্বাদু করতে প্রতিটি বাসা বাড়িতে নারীদেরকে মসলা জাতীয় নানা উপকরণ কষ্ট করে তাদের পিঁষতে হয়। আর সেই নিত্য প্রয়োজনীয় রান্নার কাজে ব্যবহৃত সব জায়গায় যেন শিল-পাটার গুরুত্ব আজো কমেনি। বাজারে নানা প্রকার গুড়ামসলা দখল করে রাখলেও নারীদের কাছে শিল-পাটার গুরুত্ব রয়েছে অনেক। আর তিনি এই শিলপাটা ধার ও নকশার কাজ করে দীর্ঘ বছর পার করে দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় গ্রামগঞ্জে পাড়া মহল্লায় সর্বত্র শিল-পাটা ধার কাটার ছন্দময় সুরের সাথে পরিচয় ছিল না এমন মানুষ খুব কমই ছিলেন। লাগবে শিল-পাটা ধার ফেরিওয়ালাদের এই হাঁক ডাক প্রায় সময় কানে আসত।
ফেরিওয়ালারা সাইকেলে অথবা হেঁটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে এ কাজ করত। তাদের হাঁকডাক শুনে যার প্রয়োজন সে বের হয়ে আসতেন ঘর থেকে পাটা ও নোড়াতে ধার কাটানোর জন্য। বিনিময়ে কাজ করে পেতো তারা চুক্তিকৃত মজুরি। তবে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে গেলে ও আজো এর কদর নারীদের কাছে কমেনি।
শিল-পাটা ধার দিতে বাটাল-ছেনি দিয়ে ছোট্ট একটি হাতুড়ির সাহায্যে ঠুকে ঠুকে ধার কাটানো তাদের হাতের নিপুণ কাজে মুগ্ধ করছে ছোটবড় সবাই। পাটা ধার কাটনিওয়ালারা তাদের দক্ষতা আর গৃহস্থের ইচ্ছা অনুযায়ী পাটাতে ধার কেটে কেটে ফুটিয়ে তুলত মাছ, ফুল, লতা ও পাখির ছবি। এরইমধ্যে ফিরোজ মিয়া নামে একজন সংসারের অভাব ঘুচাতে ও জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ হিসেবে বেঁচে নিয়েছেন শিলপাটার ধার দেয়ার কাজে। তিনি প্রায় দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে শিলপাটা ধার দেওয়ার কাজ করছেন। শিলপাটা ধার দেয়ার সময় তিনি চোখে কালো চশমা ব্যবহার করেন। শিলপাটায় মাছসহ বিভিন্ন প্রকার নকশা আঁকার কাজও করে থাকেন।
ফিরোজ মিয়া বলেন, শিলপাটা আকার অনুযায়ী টাকা নির্ধারণ হয়। আকার অনুযায়ী ৫০ থেকে ১০০ টাকা মজুরি নেন তিনি। দৈনিক কাজ করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয় বলে জানায়।
তিনি বলেন, এখন বয়স হওয়ায় বেশি গ্রাম ঘুরতে পারি না। তাই আয়ও অনেক কমে গেছে। তবে গ্রামে এ কাজের চাহিদা রয়েছে। এক একটি পাটায় কাজ করতে ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে। এক জায়গায় বসলে ৪-৫টি কাজ করা যায়।
পৌর শহরের দেবগ্রাম এলাকার গৃহিণী লিপি আক্তার বলেন, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ ও রসুনসহ বিভিন্ন প্রকার মসলা প্রস্তুতের জন্য প্রতিদিনই নারীদের শিলপাটা ব্যবহার করতে হয়। তাই রান্না করতে হলে শিলপাটা ভালো থাকলে খাবারকে সুস্বাদু থাকে অন্য রকম। অনেক দিন ধরে শিলপাটা দিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না। তাই হাতের কাছে পেয়ে কাজটা করে নিলাম। এ জন্য মজুরি হিসাবে ৫০ টাকা দিতে হয়েছে। তারা যদি গ্রামে না আসতো তাহলে শিলপাটা ধার দেওয়া নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করা হতো। তারা আসাতে অতি সহজে বাড়িতে বসে রান্নাঘরের অতি প্রয়োজনীয় শিলপাটাটি ধার দিতে পারছেন বলে জানায়।
গৃহিণী আয়েশা আক্তার বলেন, আধুনিকতার ছোয়ায় এখন রান্না করার সব মসলা পাওয়া গেলেও শিলপাটার প্রয়োজন কমেনি। এখনও তার ঘরে শিলপাটা রয়েছে। দৈনিকই কোনো না কোনোভাবে এর ব্যবহার হচ্ছে। একবার শিল-পাটা ধার দিলে অনেক দিন চলে যায়। তবে আগের থেকে কাজের মজুরি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
মো. আল-আমিন বলেন, যতই আমরা মেশিনে ভাঙা মশলা ব্যবহার করি না কেন হাতে বাটা মশলায় তৈরি খাবার স্বাদই আলাদা। এখন হাতে বাটা মশলার বদলে মেশিনে ভাঙানো গুঁড়া মশলার প্রচলন এসেছে। তারপরও অনেকে হাতে বাটা মশলায় তৈরি খাবার পছন্দ করেন। তাই হাতে বাটা মশলা তৈরির জন্য শিল-পাটা ঘরে রেখেছেন।
ফিরোজ মিয়া বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে শিল-পাটার চাহিদা এখনো আছে । এক সময় গ্রামের অনেক লোকজন এই পেশায় কাজ করতো। গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাজ করা কষ্ট হওয়ায় বর্তমানে অনেকে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। তার বাপ দাদা এই পেশায় কাজ করায় তিনি ছোট বেলা থেকেই আঁকড়ে ধরে আছেন। বহু কষ্টে দিন কাটলেও অন্য পেশা তার যেতে ভালো লাগে না। তাই জীবনের শেষঅব্দি এই পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে চান বলে জানায়।