ধর্ষণ করে ৭২ ঘণ্টা আটকে রাখলেই পুলিশ আর মামলা নেবে না’

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সাক্ষ্য আইন ১৫৫ (৪) ধারা বাতিলের দাবিতে রাজধানীতে মশাল জ্বালিয়ে পদযাত্রা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় ‘শিকল ভাঙা’র এই পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন শ্রেণির-পেশার নারীরা।

‘চরিত্রের প্রশ্নে বিচারহীনতা রাষ্ট্র আর কত দিন’ স্লোগানকে সামনে রেখে রাত সাড়ে ১১টা থেকে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে একে একে জড়ো হতে থাকেন নারীরা। এরপর রাত সাড়ে ১২টার সময় তারা পদযাত্রা শুরু করেন।

পদযাত্রার সময় নারীরা ‘রাজপথে নারীর সাড়া জাগরণ নতুন ধারা’, ‘ঘুম ভাঙানো মাসিপিসি চলো পুরুষতন্ত্র পিষি’, ‘আর কত আজব ইনকিলাব হোক আসল ইনকিলাব’ ‘৭২ ঘণ্টা পার হলে ধর্ষণ ন্যায্য?,’ ‘চরিত্রের প্রশ্নে বিচারহীন, আর কত দিন’, ‘চলন-বলন-পোশাক রাখো, রাষ্ট্র এবার দায় নাও’, ‘পুরুষের ক্ষমতা, ভেঙে হোক সমতা’, ‘পথে-ঘাটে দিনে-রাতে, চলতে চাই নিরাপদে- ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।

পদযাত্রা শুরুর আগে পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, আমাদের পদযাত্রাটি ঠিক ১২টায় শুরু হতো। কিন্তু আমরা পারিনি। এর কারণ হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে আমাদের কিছু সংগঠককে টিএসএসি এলাকায় কতিপয় যুবক একপ্রকার উত্যক্ত করেছে। তারা আমাদের কর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছে এত রাতে তারা বাইরে কী করে। তারপর আমাদের একজন পাল্টা জিজ্ঞাসা করল যে মেয়েরা কী রাতে বাইরে থাকতে পারব না। তখন ওই যুবকরা বলে না, পারবেন না। কারণ আপনারা নারী। আমি মনে করি, আমাদের এই শিকল ভাঙার পদযাত্রা সেই সব পুরুষদের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। যারা বলে যে নারীরা ১২টার পর বাইরে থাকতে পারবে না।

তাপসী বলেন আজকে আমাদের পদযাত্রার একটি সুস্পষ্ট  দাবি রয়েছে যে, চরিত্রের প্রশ্নে বিচারহীনতা রাষ্ট্র আর কত দিন এই ব্যানারে আমরা ইতোমধ্যে সাক্ষ্য আইন ১৫৫ (৪) ধারা বাতিলের দাবিতে কাজ করেছি এবং করে যাচ্ছি। কিন্তু আপনি দেখতে পাবেন যে কোনো কর্মসূচিই করা হোক না কেন, এর কোনো ফলাফল নেই। রেইনট্রি হোটেলের ঘটনায় আদালত বলেছেন যে, তিন দিনের (৭২ ঘণ্টা) বেশি সময় হলে ধর্ষণের মামলা না নিতে। একটা দেশের আইন ব্যবস্থা কতটা জঘন্য হলে একজন বিচারক আদালতে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলতে পারেন।

শাহবাগ জাদুঘরের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু হয়ে সিটি কলেজ, কলাবাগান হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে শেষ হয়। পরে সংসদ ভবনের সামনে প্রতিবাদী সমাবেশে নারীরা তাদের দাবি তুলে ধরেন৷ এ সময় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রেহনুমা ইসালম, শিল্পী কৃষ্ণ কলি ইসলাম, ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা, আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীরা উপস্থিত ছিলেন।

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার পর্যবেক্ষণ দেন। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর কোনো ধর্ষণের মামলা না নেয়।

পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, মামলার দুই ভুক্তভোগী আগে থেকেই সেক্সুয়াল (যৌন) কর্মে অভ্যন্ত। অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এরপর থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায় তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।

দেশব্যাপী তুমুল আলোচিত রেইনট্রি মামলায় পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেন আদালত। এই মামলায় কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারক। আদালত বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ বলেন, ‘আইনের যে ধারা বাতিলের দাবিতে আমরা একত্রিত হয়েছি- তা যে কত জরুরি সে বিষয়টি রেইনট্রি মামলার রায়ে প্রমাণিত হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একবিংশ শতকে এসে একটি স্বাধীন দেশে এ ধরনের রায় হতে পারে না, যেখানে কিনা বিচারক বলেন যে যারা অভিযোগ এনেছেন তাদের যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা আছে। আদালতের বিচার করার কথা, ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট (চারিত্রিক সনদ) দেওয়ার কথা না। এই বিচারক ভেবে বসেছেন তার দায়িত্ব হচ্ছে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেওয়া।’

‘বিচারক পুলিশকে বলছেন- ৭২ ঘণ্টার পরে ধর্ষণ মামলা না নিতে’ উল্লেখ করে অধ্যাপক রেহনুমা প্রশ্ন করেন, ‘তার মানে ধর্ষণ করে ৭২ ঘণ্টা মেয়েকে আটকে রাখলেই পুলিশ আর মামলা নেবে না?’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর