হাওর বার্তা ডেস্কঃ পৃথিবীতে জীবনের জন্য সূর্যের উষ্ণতা অপরিহার্য। তবে এই সূর্য রশ্মিতে থাকে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি। সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে থাকা ওজোন (O3)স্তর সৌর পরিবারের মানুষের বাসযোগ্য এ গ্রহটিকে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে আবহমান কাল ধরে। পৃথিবী বায়ুমণ্ডল নামে বাতাসের কম্বলে আচ্ছাদিত যাকে বিজ্ঞানীরা কয়েকটি স্তরে ভাগ করেছেন।
রসায়ন বিজ্ঞানের ভাষায়, ওজোন (O3) এর একটি অণু যা তিনটি অক্সিজেন (O) পরমাণু সমন্বয়ে গঠিত। এটি একটি গ্যাসীয় পদার্থ যা বায়ুমণ্ডলের দুইটি স্তরে থাকে। এর মধ্যে ট্রপোস্ফিয়ারের বিদ্যমান ওজোন ‘খারাপ ওজোন’ রূপে পরিচিত যা বায়ুকে দূষিত করে, ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে ও শরীরে বিশেষ করে শ্বাস প্রশ্বাসে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
আর ওজোন স্তর বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত যা ভূপৃষ্ট থেকে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে। পৃথিবীর জন্য ওজোন স্তরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি সূর্যের অতি বেগুনি (ইউভি) রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পৃথিবীর প্রাণী ও উদ্ভিদ জগৎকে রক্ষা করে থাকে। এজন্য এটি ‘ভালো ওজোন’ নামে পরিচিত। ওজোন স্তরের সুরক্ষামূলক আচ্ছাদন ছাড়া পৃথিবীতে জীবনের টিকে থাকা অসম্ভব।
সভ্যতার ক্রম অগ্রযাত্রার সঙ্গে পরিবেশ ও বায়ুমণ্ডলের জন্য ক্ষতিকর নানাবিধ রাসায়নিকের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। শীতলীকরণ যন্ত্রে ক্লোরো-ফ্লোরো-কার্বন (সিএফসি) নামে একটি রাসায়নিক যৌগের ব্যবহার ভালো ওজোনের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ তৈরি করে। প্রবল বাতাসে সিএফসির কণা স্ট্রাটোস্ফিয়ারে পৌঁছে যায়। আর সেখানে থাকা ইউভি রশ্মির সঙ্গে বিক্রিয়া করে সিএফসি-তে থাকা ক্লোরিনকে আলাদা করে দেয়। এ ক্লোরিন ওজোন ধ্বংস করতে জোরালো ভূমিকা পালন করে। এ সব কিছু নানাবিধ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়। এছাড়াও কীটনাশকে ব্যবহৃত রাসায়নিক যেমন মিথাইল ব্রোমাইড, অগ্নিনির্বাপকে ব্যবহৃত হ্যালন ওজোন ধ্বংসকারী রাসায়নিক।
১৯৭৯ সালে বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ মেরুর অ্যান্টার্কটিকার ওজোন স্তরে বৃহৎ গর্তের সন্ধান লাভ করেন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান। উত্তর মেরুর আর্কটিক ওজোন স্তরে ও ছোট গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই রকম নানাবিধ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পুরো পৃথিবী গ্রহ জুড়ে ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকৃতি নিজেকে পুননির্মাণ করতে পারে এবং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। ওজোন স্তরের পুনর্নির্মাণ ও এমন একটি প্রক্রিয়া। এজন্য ওজোন স্তরের জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো ও বন্ধ করা উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের অস্তিত্ব ও স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে জরুরী।
প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ওজোন দিবস উদযাপন করা হয়। ওজোন স্তর ও এর সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ওজোন দিবসের মূল লক্ষ্য। দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘মন্ট্রিল প্রটোকল মেনে ওজোন স্তর রক্ষা করি—নিরাপদ খাদ্য ও প্রতিষেধকের শীতল বিশ্ব গড়ি’।
ওজোন স্তর সুরক্ষার্থে ভিয়েনা কনভেনশনের ৩৬ বছর পূর্ণ হলো। এ ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় মন্ট্রিয়াল প্রোটোকল, বিভিন্ন শিল্প প্রধান দেশের সরকার, বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক উদ্যোগে এ শতাব্দীর মধ্যভাগে ওজোন স্তর ১৯৮০ বা তার পূর্বের অবস্থা পুনর্নির্মিত হবে এমনটি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউনেপ) এর নির্বাহী পরিচালক ইঙ্গার অ্যান্ডারসন। এজন্য মন্ট্রিল প্রোটোকলের সমর্থনে কিগালি সংশোধন জোরালো ভূমিকা রাখবে ওজোন স্তরের জন্য ক্ষতিকর হাইড্রো-ফ্লুরো-কার্বন (এইচএফসি) হ্রাস করতে। পাশাপাশি, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও জলবায়ু-উষ্ণায়নের সম্ভাবনার মূল নিয়ামক গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাসে ও ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করবে কোভিড-১৯মহামারির এই সময়ে এমনটি অঙ্গীকার হোক।
সাউথ এশিয়ান মিটিওরোলজিক্যাল এসোসিয়েশন (সামা) এ বছর প্রথমবারের মতো বিশ্ব ওজোন দিবসটি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশগুলোকে নিয়ে যৌথভাবে উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উপলক্ষ্যে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলীয় ব্যবস্থায় ওজোনের ভূমিকা ও তাৎপর্য নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, জনসাধারণের জন্য সচেতনতামূলক প্রচারণা ও বৈজ্ঞানিক আলোচনা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
সাউথ এশিয়ান মিটিওরোলজিস্টস অ্যাসোসিয়েশন (সামা) আবহাওয়া-জলবায়ু ও সহযোগী প্রায়োগিক বিজ্ঞানের পেশাদারদের একটি অলাভজনক সংঘটন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকদের সুরক্ষা, মঙ্গল ও টেকসই উন্নয়নে আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞানের প্রয়োগ ও প্রসারে ভূমিকা রাখে।
সামা’র একটি তাৎপর্য পূর্ণ উদ্যোগ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সদস্য দেশগুলোর অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য ওজোন বিষয়ে অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতা। কোবিড-১৯ মহামারির এই দুর্যোগ কঠিন সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী এতে অংশ গ্রহণ করেছে। সবাই অংশগ্রহণ শেষে সনদ লাভ করেছে এবং প্রত্যেক দেশ থেকে সেরা দশ জনকে মেধাবী সনদ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
এ মহতী উদ্যোগের যৌথভাবে আয়োজনে ছিল সাউথ এশিয়া মিটিওরোলজিক্যাল এসোসিয়েশন (সামা), ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট, বিজ্ঞান প্রসার ইন্ডিয়া, বিদ্যার্থী বিজ্ঞান মন্থন, ইন্ডিয়ান মিটিওরোলজিকাল সোসাইটি, আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), পরিবেশ ক্লাব (ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), এনভায়রনমেন্ট ওয়াচ: বুয়েট, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
শিক্ষার্থীদের মাঝে বিজ্ঞানমনস্কতা, সচেতনতা, নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরিতে এ ধরনের নিয়মিত উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। সামা’র সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বাংলাদেশ অবস্থিত সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র বন্ধের কারণে খুবই মর্মাহত এবং দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি বড় ক্ষতি মনে করেন। টেকসই উন্নয়নের জন্য দরকার উন্নত, দক্ষ, সক্ষমতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন প্রজন্ম। আর দরকার যথাযথ অবকাঠামো, গবেষণা সুবিধা ও গবেষণা কেন্দ্র ।