দুশ্চিন্তায় মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষগণ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অভাবের বোঝা মাথায় নিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন মো. আয়ুব আলী। ৬৬ বছর বয়সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। তার আয়ে চলে সংসারের খরচ। বয়সের ভারে শরীরে ভাঁজ পড়লেও এই শহরে ছুটে এসেছেন পেটের দায়ে। পাঁচ বছর ধরে ফুটপাথে ব্যবসা করে পরিবারের খরচ চালান তিনি। দিন এনে দিন খাওয়ার মতো অবস্থা তার। কখনো ফুটপাথে বসে আবার কখনো রাস্তায় পায়ে হেঁটে বিক্রি করেন জায়নামাজ ও ব্যাগ। বয়সের কারণে বিভিন্ন রোগ ঘিরে ধরলেও থেমে নেই তার ক্লান্ত শরীর।

চোখে-মুখে কষ্টের ছাপ নিয়ে আয়ুব আলী জানান, অভাবের সংসারে আমি একমাত্র উপার্জনকারী। স্ত্রী, চার মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে আমার সংসার। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বাকি সবাই পড়াশোনা করে। পাঁচ বছর ধরে ফুটপাথে ঘুরে ঘুরে এই ব্যবসা করছি। বাড়িতে একটি ঘর ছাড়া কোনো জমিজমা নেই। গ্রামে গিয়ে বসে থাকতে হবে। লকডাউনে চলার মতো কোনো রাস্তা নেই। আমাদের মতো মানুষের অনেক ক্ষতি হবে। ইনকাম বন্ধ হয়ে যাবে। পেটে কোনো ভাত যাবে না। এখনই তো আমাদের পেটে ভাত নেই।
তিনি আরও জানান, ফার্মগেটের ডাবের গলিতে একটি মেসে থাকেন। প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা বিক্রি হয়। এখন তো বিক্রি কমে গেছে। তবুও আশা নিয়ে থাকি। কিছুদিন আগে মেয়ে বিয়ে দিয়ে ৬০ হাজার টাকার মতো দেনা হয়ে আছে। পরিশোধ করি এই ইনকাম দিয়ে। এখন মানুষ আর লোন দিতেও চায় না। বেশির ভাগ সময় আলু আর ডাল দিয়ে খাই। শরীরে অনেক রোগ আছে- গ্যাসের সমস্যা, হার্টের সমস্যা। প্রতিদিন অনেক ওষুধ খেতে হয়। কিছু বলার ভাষা নেই আমার।
শুধু আয়ুব আলী নন, এই শহরে অনেকেই চোখে-মুখে কষ্টের ছাপ নিয়ে তার মতো দুচিন্তায় আছেন। লকডাউনের কথা শুনে কেউ ছুটে গেছেন গ্রামে আবার কেউ অপেক্ষায় আছেন লকডাউন শেষ হওয়ার। তাদের অনেকেরই দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার টাকা নেই বলেও জানিয়েছেন। এদিকে ব্যবসা বন্ধ থাকলে ঢাকায় থাকার খরচও নেই অনেকের।
হবিগঞ্জের ছেলে আশিকুর রহমান ১ লাখ টাকার দেনা মাথায় নিয়ে এসেছেন ঢাকায়। তিনি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আম, পেয়ারা ও আমড়া বিক্রি করেন। তিনি জানান, করোনার এই পরিস্থিতিতে ১ লাখ টাকার দেনা হয়ে আছি। মাসে দশ হাজার টাকা করে দেনা পরিশোধ করতে হয়। প্রতিদিন যে বিক্রি হয় তা দিয়ে সংসার চালাবো নাকি দেনা পরিশোধ করবো। চিন্তায় ঘুমও হয় না। প্রতিদিন নিজের খরচ আছে ৩ শত টাকা। স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। গত চার বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। লকডাউনে বিক্রি করতে না দিলে খুবই কষ্ট হবে। তিনি আরও জানান, দুই ছেলে ঢাকাতে হোটেলে কাজ করতো। মাসে ৫-৬ হাজার টাকা আয় ছিল। এখন তারাও বাড়িতে। বাড়িতে গেলে দেনাদাররা এসে ধরে টাকার জন্য। এই ভয়ে বাড়িতে যাচ্ছি না। সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের উপর যদি দয়া হয়। বাড়িতে  গেলে অনেক খরচ। বাড়িতে কিছু করার নেই। জমিজমা যা ছিল তা আগে বিক্রি করে ব্যবসা করেছিলাম। এখন আর কিছু নেই।
ফার্মগেট মোড়ে ফুটপাথে মাস্ক বিক্রি করেন মো. জুলহাস মিয়া (৩০)। তিনি জানান, আমরা তো আর বিক্রি করতে পারবো না।  এমনিতে ধারদেনা করে খেতে হচ্ছে। তার উপর আবার লকডাউন। ফার্মগেটের মোস্তফা গলিতে থাকি দুই ছেলে, এক মেয়ে ও  স্ত্রীকে নিয়ে। আগে ফুটপাথে গেঞ্জি বিক্রি করতাম। ৩০ হাজার টাকার মতো দেনা আছি। বেচাবিক্রি নেই। ঘর ভাড়া দিতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস সহ ব্ল্যাডে সমস্যা। এদিকে আবার ছেলেটা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অসুস্থ। তার পায়ের রড খোলার জন্যও টাকা নেই। যে টাকা আয় করি তা প্রতিদিনের খাবার খরচে চলে যায়। সরকার লকডাউন দিক কিন্তু আমাদের একটা ব্যবস্থা করুক। আমাদের গরিবের জন্য ভালো হবে।
জামালপুর থেকে এসেছেন মো. সানোয়ার হোসেন। তিনি ফুটপাথে আমড়া, মরিচ, আমলকি বিক্রি করেন। তিনি জানান, রাতেই চলে যাবো। কাল তো গাড়ি পাবো না। বাড়ি যেতে আটশত টাকা গাড়ি ভাড়া লাগবে। ১২ শত টাকা কাছে আছে। এখন দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে যেতে হবে। দুই ছেলে আছে ছোট। বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে হবে। প্রতিদিন ৩-৪ শত টাকা আয় হতো। লকডাউন থাকলে আমাদের পেট চলবে না। গরিব মানুষের আবার শান্তি আছে নাকি। মেসে থাকতে হয়। ইনকাম না থাকলে খাবারের খরচ দিবো কীভাবে। মেসে প্রতিদিনের টাকা প্রতিদিন দিতে হয়। ৩০০ টাকার মতো প্রতিদিনের খরচ আছে। রাতেই ট্রাক বা পিকআপে করে বাড়িতে যাবো।
শাহবাগের মোড়ে শরবত বিক্রেতা আজিম জানান, বিক্রি এখন নেই বললেই চলে। আগে থেকেই খুব শোচনীয় অবস্থা যাচ্ছে। নিজেই চলতে পারছি না, পরিবারের খরচ চালাবো কীভাবে। সব বন্ধ থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।
এদিকে রবিউল হাসান পাঁচ বছর ধরে জুতার ব্যবসা করেন। তিনি জানান, দোকান বন্ধ থাকলে আয় হবে না। না খেয়ে মরতে হবে। দোকান বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে মালিককে ভাড়া দিতে হয়। ভাড়ার টাকা কীভাবে যোগাড় করবো।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর