করোনা মহামারী রাজধানীতে উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বস্তিবাসী

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করোনা মহামারীতে রাজধানীর বস্তিবাসীদের সুরক্ষায় সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও বস্তিতে কেউ করোনায় আক্রান্ত বা মারাও যায়নি বলে দাবি বাসিন্দাদের। তবে নানা সমম্যায় জর্জরিত বস্তিগুলোতে মানা হয় না কোনো স্বাস্থ্যবিধি। ফলে যে-কোনো সময় বস্তিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই মরণব্যাধি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। তবে আশঙ্কা এসব মানুষ সংক্রমিত হতে শুরু করলে বড় হুমকি তৈরি হবে।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের এক বছর অতিক্রম করে দ্বিতীয় বছরে পড়েছে। কিন্তু কোনো বস্তি করোনা সংক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। অথচ করোনা মহামারীর কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার আশঙ্কা ছিল রাজধানীর ২০টি বস্তি।

জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব ছাড়াও একই রান্নাঘর, টয়লেট, পানির উৎস অনেকে মিলে ব্যবহার, ঠাসাঠাসি করে এক ঘরে পরিবারের সবাই থাকা, খোলা নর্দমা, খোলা বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বস্তিবাসীদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক দুর্বলতা তাদের অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

বিভিন্ন এনজিও’র জরিপে ঢাকায় বিভিন্ন বস্তিতে সব মিলিয়ে সাড়ে ছয় লাখের মতো মানুষ বাস করে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সম্পর্কে হয়তো বুঝতে না পারলেও তাদের জীবনযাত্রার ওপর এর প্রভাব কিন্তু ঠিকই টের পাচ্ছেন। এদের অধিকাংশ মানুষ করোনা সম্পর্কে জানলেও তা প্রতিরোধ ও সচেতনতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না। এরপরও করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত তারা। তবে ঢাকা সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করোনা প্রতিরোধে বস্তিবাসীদের জন্য নেওয়া হবে বিশেষ উদ্যোগ।

ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর, নিম্নআয়ের মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল বস্তি। মানুষে ঠাসা, সব স্থানে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়। ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নেই এখানে। একই সঙ্গে চলছে কাপড় ধোয়া, গোসল, চলছে খোলা আকাশের নিচে রান্না। যত্রতত্র হাঁচি-কাশি দিচ্ছে সবাই, সেই হাত দিয়ে ধরা হচ্ছে শিশুদের।

স্বল্প আয়ের এসব মানুষের কাছে করোনা প্রতিরোধে সাবান, মাস্ক কেনা অনেকটাই বিলাসিতা। যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন এই দুঃসময়ে তাদেরও কাছে না পাওয়ায় করোনা প্রতিরোধে পণ্যসামগ্রী সরবরাহ না করার অভিযোগ রয়েছে তাদের।

সম্প্রতি কড়াইল, চলন্তিকা, ভাসানটেক, বাউনিয়াবাঁধ, আবুলের বস্তি ও লালাসরাইয়ের বস্তি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে-এসব বস্তির বাসিন্দাদের একই কথা, এখানে করোনা আক্রান্ত কেউ নেই। ‘এই বস্তিতে কোনো করোনা রোগী নেই। এটা ধনীদের রোগ’-এই কথাটি শুনতে হয়েছে প্রায় প্রতিটি বস্তি থেকে। বস্তির এত বেশি মানুষ এই কথা বলেছে, মনে হয়েছে এটাই বুঝি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে প্রমাণিত এবং সর্বজনবিদিত সত্য।

কড়াইল বস্তি উন্নয়ন কমিটির বউবাজার ইউনিটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুস সোবহান বলেন, এখানের কেউই করোনায় আতঙ্কিত না। এখানের মানুষ তেমন করে অসুস্থও হচ্ছে না। বস্তিতে বসবাসরত ৪০ বছর বয়সি গৃহকর্মী কামরুন্নাহার মাস্ক ব্যবহার করেন না।

তার মতে, কোনো করোনাভাইরাস নেই। জ্বর কাশি এমনি হয়, হয়ে আর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। করোনাভাইরাস আর লকডাউনের কারণে কাজ হারানো এই নারী বলেন, রাতে কী খাব, সেটা নিয়ে আগে ভাবি। মাস্কের কথা পরে ভাবা যাবে।

কোহিনুর বেগম, ২০ বছর ধরে আছেন রাজধানীর ভাসানটেক বস্তিতে। আধা কাঠা জায়গায় ওপর-নিচ মিলে ২০টি ঘরে বাস করেন প্রায় একশ মানুষ। করোনাসহ বহু দুর্যোগ পার করেছেন এখানে থেকেই। শ্রমিক সাহানারা বেগম পরিবার নিয়ে বসবাস করেন শহরের মহাখালী বস্তিতে। এখনো ছোট্ট একটি ঘরের পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে রান্না ও কাজকর্ম। হাত ভালোভাবে পরিষ্কার না করে শিশুদের মুখে তুলে দিচ্ছেন খাবার। প্রায় একই চিত্র বস্তির অন্য ঘরগুলোতে।

রহিমা বেগম বলেন, বস্তিতে থাকলে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা যায় না। ময়লা আবর্জনা তো সব জায়গায় আছে। একই জায়গায় রান্নার স্থান ও বাথরুম। আমাদের ভয় লাগে কিন্তু কিছু করার নেই।

ভাসানটেকের এক ওষুধের দোকানের স্বত্বাধিকারী কৃষ্ণ দে জানান, তিনি প্রচুর পরিমাণে ফ্লুর ওষুধ বিক্রি করছেন। তবে সেখানকার বাসিন্দাদের কেউই কখনো করোনা পরীক্ষার করানোর জন্য চেষ্টাও করেননি। এই বস্তিতে আমাদের কারো করোনার সংক্রমণ আছে কি না, আমরা জানি না। চলন্তিকা ও অন্যান্য বস্তির বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকানের মালিক ও কর্মচারীরাও একই কথাই জানিয়েছেন।

চলন্তিকা বস্তির বায়তুল নূর জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন জানান, গত বছর লকডাউনের মধ্যে বস্তিতে হঠাৎ একজন বৃদ্ধ মারা যান। তার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়নি। সবাই বলছিল যে তিনি বৃদ্ধ বয়সে মারা গেছেন। তার করোনা পরীক্ষার দরকার নেই।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মী শিপ্রা রানী মৃধা জানান, বস্তিবাসীদের মধ্যে থাকা ভুল তথ্য ও কুসংস্কারই আসল চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়েছে তার কাছে। আমি জ্বরে আক্রান্ত কয়েকজনের নাম সংগ্রহ করেছিলাম যাতে তাদের পরীক্ষাসহ অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য করতে পারি। নাম নিয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই তাদের পরিবারের সদস্যরা আমার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।

তাদের অনুরোধ, আমি যেন জ্বরে আক্রান্তদের কথা কাউকে না জানাই। তাদের ভেতরে ভয় ছিল যে তাদের বহিরাগত মনে করে পুলিশ হয়রানি করবে। কেউ কেউ বলেছিল যে তারা শুনেছেন কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে রোগীদের মেরে ফেলা হয়। তবে বস্তিতে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা হচ্ছে, তাতে যে-কোনো

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, আমরা রাজধানীর বস্তিবাসীদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। সেখানে সংক্রমণের হার বেশি দেখছি না। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ রোগী রয়েছেন। অথচ চলন্তিকা, ভাসানটেক ও বাউনিয়াবাঁধ বস্তিও এই মিরপুরেই অবস্থিত। তারপরও বস্তিবাসীদের মধ্যে এই সংক্রমিত রোগ ছড়িয়ে না পড়া বেশ অবাক করার মতোই। একইভাবে কড়াইল বস্তি অবস্থিত মহাখালীতে। মহাখালীও করোনার উচ্চ সংক্রমণের স্থান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ মনে করেন, অনেকটা কুসংস্কার থেকে বস্তির মানুষ করোনাকে পাত্তা দিচ্ছে না। যদি কারো মধ্যে কোনোভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই বস্তিবাসীদের সচেতনতায় সরকার ও এনজিওগুলোকে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হবে।

বস্তির মানুষরা মারাত্মক করোনা ঝুঁকিতে বিষয়টি স্বীকার করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ।

এ বিষয়ে ডিএনসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান ও ডিএসসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এয়ার কমডোর বদরুল আমিন বলেন, রাজধানীর নিম্নআয়ের মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। তারা সব কিছুতেই অসচেতন। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে অভ্যস্ত নন। তারা যেন করোনার সময়ে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা পান সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর