শিশুরা যদি ফুল বৈষম্যের এই পৃথিবী করে কেন ভুল সামিয়া রহমান

‘আমার পুতের বইগো, বইখানোত আমার জাদুর হাত পড়ত না’…। ওদের চোখে-মুখে ছিল প্রচণ্ড আতঙ্ক, ভয়, অসহায় কান্না। কিছু মানুষরূপী পশুর কাছে করুণ আর্তনাদ। কেউ ছিল না ওদের বাঁচানোর, কোথাও কেউ নেই। ছোট ছোট পুতুলের মতো বাচ্চা ওরা। প্রথমে অচেতন, তারপর শ্বাসরোধে হত্যা। পৃথিবীর কিছুই ওরা এখনো দেখেনি। কিন্তু টের পেতে হলো মানুষের হিংস্রতা, চরম নিষ্ঠুরতা। দোষ কি ছিল সাত বছরের মনিরের? আট বছরের ইসমাইল, জাকারিয়া বা তাজেলের? গ্রামের পাশে ফুটবল খেলা দেখতে যাওয়াই কি ছিল ভুল? ছেলের পড়ার বই হাতে নিয়ে মায়ের বিলাপ, দুই চোখজুড়ে পানি, বুকফাটা কান্না, ফ্যালফ্যাল নির্বাক চাহুনি। এতটা বীভৎসতা, এতটা কষ্ট নেওয়ার ক্ষমতা নেই পৃথিবীর কোনো মায়ের। কোনো সান্ত্বনাই কি ফিরিয়ে দেবে মায়ের কাছে তার আদরের সন্তানদের? ঘর থেকে খেলতে বের হওয়া মায়ের চোখের মানিকরা কিছু পশুর নির্দয়তায় এখন গলে যাওয়া বালুচাপা লাশ।

একটি নয়, দুটি নয়, একের পর এক হত্যা, একের পর এক নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন। আমাদের শিশুদের ওপর হিংস্রতা। দোষ কি আমাদের বাচ্চাদের? ওরা দরিদ্র বলে বেঁচে থাকার অধিকার নেই? নাকি পরিবারের ওপর ক্ষোভ, পঞ্চায়েতের সঙ্গে দ্বন্দ্ব? তাই নির্বিকারভাবে গলা টিপে হত্যা? আমাদের হিংসা, কুৎসা, নোংরামিতে ওদের পৃথিবী আমরা কেড়ে নিচ্ছি। এক বুক আশা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে সন্তান জন্ম দিই আমরা। সব ভেঙেচুরে তছনছ করতে পশুরা দ্বিধা করে না। শিশুরা অসহায়, নিজেদের রক্ষা করতে পারে না। তাই তাদের ওপর শক্তির দম্ভ প্রকাশ? বিস্ময়, শোকে আমরা সাধারণ জনগণ শুধু স্তব্ধ হই। প্রতিদিন গণমাধ্যমে শুনি, দেখি, ভুলে যাই। আবার নতুন নতুন হিংস্রতার খবরে নড়েচড়ে বসি। কিন্তু নড়েচড়ে বসাই সার। গত বছর নির্মমভাবে নির্যাতন করে শিশু রাকিব ও চুরির অভিযোগে শিশু রাজনকে হত্যা করা হয়। সারা দেশের আমরা সবাই ঘৃণায় সোচ্চার হয়ে উঠেছিলাম। নিম্নআদালতে দ্রুত এ মামলা দুটির নিষ্পত্তি হয়। রাজন হত্যার দায়ে প্রধান আসামি কামরুলসহ চারজনকে ফাঁসি ও সাতজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং রাকিব হত্যা মামলায় দুজনকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। কিন্তু তারপরও একই ঘটনা ঘটে চলছে আরও শিশুর ওপর। কিন্তু একইভাবে নির্যাতনের ঘটনা দেখতে শুনতে পড়তে গিয়ে আমরা বোধহয় ক্লান্ত। তাই প্রতিবাদ আর জোরালো হয় না। বারবার ঘটছে বলেই আমরা কি বোধশূন্য? সবাই বলছেন আমাদের মূল্যবোধের নাকি বিপর্যয় ঘটেছে। আদৌ কি বিবেক বা মূল্যবোধ আমাদের ছিল বা আছে? মাত্র একটা মোবাইল ফোন অথবা বিশ লাখ টাকা অথবা ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ওদের হাসিমুখের চেয়ে অনেক বড়। তাই পিটিয়ে মাদ্রাসা ছাত্রকে হাসপাতালে পাঠানো হয়, দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে চলে অমানুষিক নির্যাতন। আমরা আবার তার ভিডিও করি। এত ঘৃণা ছিল আমাদের ছয় বছরের প্রণবের জন্য? তাই যে স্কুলটি ছিল তার খেলার জায়গা, পড়াশোনার জায়গা, সেই স্কুলের পেছনেই নাক, চোখ, মুখে রক্তাক্ত অবস্থায় প্রণবের লাশ পড়ে থাকে। বয়স ছয় হোক, বারো হোক আর চৌদ্দ-পনেরোই হোক অথবা টগবগে তরুণ হোক কারোর আর ছাড় নেই। গাছের ডাল দিয়ে কুষ্টিয়ায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হাবিবুরকে বেধড়ক পেটানো হয়। দোষ ছিল তার অনেক! মজা করার জন্য সহপাঠী নাহিদার বই নিয়েছিল। নাহিদা হাবিবুরের ব্যাগ থেকে খাতা নিয়েছিল, সেটা ফেরত না পাওয়ায় হাবিবুরের এই মজা। নাহিদা তার চাচা মোজাম্মেলকে জানালে, গাছের ডাল দিয়ে তিনি হাবিবুরকে মজা করার মজা দেখিয়ে দেন। লালমনিরহাটের চৌদ্দ বছরের আল আমিন সোহাগ তার মাদ্রাসা থেকেই নিখোঁজ হয়। যথারীতি সাধারণ ডায়রি হয়। কিন্তু হাবিবুরের খোঁজ পাওয়া যায় না। নাটোরের বাগাতিপাড়ার মাকুপাড়া গ্রামে দোকানে চুরির অভিযোগে পেছনে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে বাঁশের লাঠি দিয়ে তিনটি শিশুকে বেদম পেটানো হয়। জয়পুরহাটের বারো বছরের সাজ্জাদ হোসেনের দোষ ছিল সে একটি ফাস্টফুড দোকানের কাজ ছেড়ে অন্য হোটেলে চাকরি নিয়েছিল। এত বড় অপরাধ! তাই তার চুল আর ভ্রূ কেটে ফেলতে দ্বিধা করেনি হোটেলের মালিক আবদুল মতিন ও রুবেল। ময়মনসিংহে মোবাইল চুরির অভিযোগে লাঠিপেটা করা হয় শিশু সাদ্দামকে। নির্যাতনের ভিডিও করে সেটা আবার ছড়িয়েও দেওয়া হয়। ফোন চুরির অপবাদেই জাহিদ ও ইমনের ওপর চলে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অমানবিক নির্যাতন।

সেখানেও ধারণ করা হয় ভিডিও চিত্র। কিছুটা অন্ধকার ঘরে দুই কিশোরকে চেপে ধরে আছে কয়েকজন মানুষ নামের অমানুষ। আর কয়েকজন লাঠি দিয়ে তাদের বেধড়ক পেটাচ্ছে। কিশোররা বাঁচার জন্য আর্তচিত্কার করছে। কিন্তু কোনো মানুষ তো সেখানে ছিল না তাদের বাঁচানোর জন্য। নানার বাড়িতে আনন্দে দিন কাটানোর কথা ছিল জাহিদের। কিন্তু সামান্য ফোনের জন্য টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসে, দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে এই বর্বরতা চালানো হয়। ওই দৃশ্য ভিডিওচিত্রে ধারণ করতে তাদের উত্তেজনা হয়তো কম হয়নি। কিন্তু যদি মানুষ হতাম, তাহলে এ ঘটনা দেখার ক্ষমতা কি আমাদের থাকত? মাত্র ক্লাস এইটে পড়ত তারা। এতটাই ঘৃণার যোগ্য আমাদের এই বাচ্চারা? সেনাসদস্য, র্যাবের সদস্য এই ঘটনায় অভিযুক্ত বলেই কি পরবর্তীতে ঘটনার ফলোআপে সব গণমাধ্যমের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা? কে জানে!

শিশু রাজন, রাকিবের মামলার রায় হয়েছে। হবিগঞ্জের বাহুবলের চার শিশুকে হত্যার সঙ্গে জড়িত খুনিদের শনাক্ত করা গেছে। ঘাতকদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও আদায় করা গেছে। কিন্তু হত্যা, বর্বরতা থামছে না। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব মতে, ২০১৫ সালে ১৯৩টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (২৬৭টি বেসরকারি সংস্থার জোট) হিসাব মতে, শুধু ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ২৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ফোরামের তথ্য মতে, ২০১৫ সালের প্রথম সাত মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩০টি শিশু, অপহূত হয়েছে ১২৭ শিশু, অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ শিশুকে। নানারকম আইন, সংগঠন, মোর্চা, প্রতিবাদ থাকা সত্ত্বেও শিশুর ওপর অত্যাচার কিছুতেই কমছে না।

মৃত নানার সঙ্গে তিন কিশোরের সেলফি তোলা নিয়ে আমরা সমালোচনা করি। আবক্ষ নারীমূর্তির স্তনে হাত রেখে ছবি তোলার জন্য তীব্র আক্রমণ করি সেসব কিশোর ও তাদের পরিবারকে। নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলি, শিক্ষার মান কোথায় গিয়েছে বলে প্রশ্ন তুলি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তো আজ মনুষ্যত্বের। অবক্ষয় তো আমাদের হয়েছে। তাই অসহায় শিশু-কিশোরদের বেধড়ক মারা, অত্যাচার ও খুন এখন প্রতিদিনের গণমাধ্যমের সাধারণ সংবাদ। এক পৃথিবীর এক সৃষ্টির মাঝে কি বিশাল বৈষম্য! পৃথিবীর এত ক্ষুদ্রতা, এত দৈন্যের মাঝে কী করে সম্ভব এই শিশুদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা!

খুব মনে পড়ছে আগুন নদীর সেই কবিতাটির কথা…

শীর্ণ কোমর, সরু খড়ি, বাঁধা ফুটো আধুলি!

হাতে, গলায়, পায়ের গিরায় ঝুলছে কবচ মাদুলি,

ঝুলছে বেশ ঝুলুক না!

ধুলা কাদায় খেলুক না।

এটাই ওদের ভাগ্য! কে বলেছে ধুঁকছে!…

নামমাত্র দেহ, চিকন পা, ময়লা নাকে দাঁতে;

দুধের বয়স, খাচ্ছে মাটি, চর্মরোগ ঘা আঁতে!

ছুঁয়ো না হায়! ছোঁয়াচে রোগ

অসম্ভব এসব, কে করবে ভোগ?

তোমার, আমার, সবার ‘শিশু’ সুন্দর স্লোগান!

মুখ ভরা মুখরতা, স্বপ্নমাখা শিশুরাজ্য বেগবান;

হে বিধাতা; শিশুরা যদি ফুল!

বৈষম্যের এই পৃথ্বী কেন করে ভুল!…

আমার জীবন আরও কষ্ট-দুঃখ পাক,

পৃথিবীর সব শিশু ফুলের মতো সুন্দর থাক!!

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নিউজটোয়েন্টিফোর।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর