হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা গ্রামের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন। প্রায় দুই যুগ ধরে মাছ চাষ করছেন। ২৫০ বিঘা জমিতে ছোট বড় মিলিয়ে তার পুকুর সংখ্যা ২১টি। প্রতিবছর এসব পুকুর থেকে আয় করেন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। এ বছর সে লাভের আশা করতে পারছেন না তিনি।
এই মাছচাষি বলেন, গত বছরে ৩-৪ কেজি ওজনের রুই বিক্রি করেছি ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এবার কেজিতে নাই হয়ে গেছে ৪০-৫০ টাকা। বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায়। ৫-৬ কেজির গ্রাস কার্প গতবছর এ সময় বিক্রি করেছি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি। এবার ২১০-২২০ টাকা কেজি কিনতে গড়িমসি করছেন পাইকাররা।
তিনি আরও বলেন, ৬-৭ কেজি ওজনের কাতল বিক্রি হয়েছিল সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি, এবার ৩০০-৩২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। ১০ কেজি ওজনের কাতল গতবারে বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকা এবার সেই কাতল ৪০০-৩৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। কেজিতে লোকসান নব্বই থেকে একশ টাকা। এক চালানেই ৫০ হাজার টাকা কম।
আরেক মাছচাষি আইনাল হক বলেন, জাল-দড়ি, বিষ, কামলার দাম সবকিছুই বেশি কিন্তু মাছের দাম কম। ছোট ভাই মাছ ধরতে নেমে উঠে গেল, গাড়ি ফেরত দিল। এভাবে চলতে থাকলে মোটা অংকের লোকসান হবে। আমাদের দেখার কেউ নাই। খাদ্যের দাম বাড়ছে, ওষুধের দাম বাড়ছে কিন্তু মাছের দাম কেন বাড়ছে না বোধগম্য নয়।
একই কথা জানালেন উপজেলার শফিকুল ইসলামসহ আরও অনেক মাছচাষি।
তারা বলছেন, বাজারে চাহিদার চেয়ে যোগান বেশি। পর্যাপ্ত ক্রেতা না থাকায় স্থানীয় বাজারগুলোতেও কাঙ্ক্ষিত দামে বিক্রি হচ্ছে না কার্পজাতীয় মাছ।
একদিকে অক্সিজেন স্বল্পতায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা অন্যদিকে বাড়তি খরচে পুকুরে অতিরিক্ত মাছ মজুদ করতেও পারছেন না চাষিরা। ফলে কম দামেই এসব মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে রাজশাহী। বিগত বছরের তুলনায় চলতি বছরে মাছের দাম কম হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছেন এখানকার মাছচাষিরা। প্রতিকেজি মাছে দাম কমেছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।
রাজশাহী জেলা মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, জেলায় মৎস্য উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ৯ লাখ মানুষ। জেলায় মাছের উৎপাদন ৮২ হাজার ৫৪৫ মেট্রিন টন। মাছের বার্ষিক চাহিদা ৫২ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত ২৮ হাজার ৭৮ মেট্রিক টন বা কখনও তারও বেশি মাছ রফতানি করা হয় রাজশাহী থেকে।
রাজশাহীতে জলাশয়ের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৪২৭টি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৫১৫টিতে। প্রতিবছরই বাড়ছে মাছের উৎপাদন। বিগত তিন বছরের তুলনায় ২০২০ সালে উদ্বৃত্ত মাছের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। এসব জলাশয়ে উৎপাদিত মাছের প্রায় ৮৫ শতাংশ কার্প জাতীয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন প্রায় ১৫০ ট্রাক মাছ রফতানি হয়ে থাকে। রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাসকার্প, ব্লাডকার্প, সিলভার কার্পসহ বিভিন্ন কার্প জাতীয় মাছ ট্রাকে করে কয়েকবার পানি বদলিয়ে কৌশলে পৌঁছানো হয় ঢাকার বিভিন্ন বাজারে। বর্তমানে ঢাকায় মাছের চাহিদা কম থাকায় মার খাচ্ছেন এখানকার চাষিরা।
রাজধানীর নিউমার্কেট কাঁচাবাজার, মিরপুর-১০, মিরপুর-৬ এলাকার মৎস্য আড়তগুলোতে বিক্রি হয় রাজশাহীর মাছ।
রাজধানীর মিরপুর-১০ এলাকায় মাছ বিক্রি করেন মানিক হোসেন। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় আমদানি বেশি। আবার শীতকালে মাছের লেজ-পাখনা পচা রোগ বেশি হয়। ফলে শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাষিরা বেশি পরিমাণে মাছ বিক্রি করতে থাকেন। ফলে বাজারে বেড়ে যায় মাছের আমদানি, কমে যায় দাম।
আবার পুকুর-পুষ্করিণী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে বাজারে মাছের আমদানি বাড়ছেই। আগামীতে মাছের দাম বাড়ার তেমন সম্ভাবনা নেই বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা বলেন, মাছের দাম কমার কারণ মূলত আমদানি বেশি। করোনা ভাইরাসের শুরু থেকেই মাছের দাম কম। আর বর্তমানে ছোট পুকুর, খাল শুকিয়ে গেছে। সেখান থেকে মাছ ধরছেন মাছচাষিরা। ফলে বাজারে আমদানি বাড়ছে। এজন্য হয়তো দাম কমতে পারে। আর শীতকালে মাছের গায়ে ঘাঁ হয়, তাই পুকুর মালিকরা মাছ ধরে বিক্রি করে ফেলেন। কিন্তু রাজশাহীতে এ ধরনের খবর পাওয়া যায়নি। চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।