ড. গোলসান আরা বেগমঃ১৬ ডিসেম্বরের মহান বিজয় বাঙালির অমূল্য অর্জন।এ অর্জন কারো দয়ায় নয়,বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রাপ্ত।১৯৭১ এ ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কতৃক স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়ার পর লড়াকু বীর বাঙালি মহান মুক্তিযোদ্ধে জড়িয়ে পরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে। নয় মাস যুদ্ধ করে ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মার বিনিময়ে, আড়াই লক্ষ মা বোনের শম্ভ্রম হারিয়ে অর্জিত হয় লাল সবুজের অমর স্বাধীনতা। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সর্বভৌম বাঙালির ভুখন্ড বিশ্ব মান চিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।সেই দিন থেকে বাঙালি স্বাধীন, অর্জন করে লাল সবুজের পতাকা। এক সাগর রক্ত পাড়ি দিয়ে পদ্মা মেঘনায় ফিরে আসে নাব্যতা।
টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালে জন্ম নেয়া খোকা নামের ছেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন বাঙালিকে শোষন, বঞ্চনার হাত থেকে মুক্ত করে মর্যাশীল জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্টিত করতে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শ্বেথপত্র হিসেবে ছয় দফা ঘোষণা করেন ১৯৬৬ সালের ৭ জুন। তৎকালিন পাকিস্তানের প্রেডিসেন্ট ও পাক সরকার বুঝতে পারে বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন পূরণে, এটি একটি পরিপত্র।
আয়ুব সরকার প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলে রুখে দাঁড়ায় ছয় দফার বিরুদ্ধে। সঙ্গে যুক্ত হয় ছয় দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বর্ষিয়ান নেতা মৌলানা আবদুল হামিদ খাসন ভাসানি। সাম্রাজ্যবাদীদের অনুচরবর্গ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে শোষণ চালাইয়া যাইতেছে তার সমাধানের কোন পন্থাই উক্ত কর্মসূচিতে নাই বলিয়া তিনি তাহা বাতিল করিয়া দেন (দৈনিক আজাদ,৮/৪/১৯৬৬)।
অপর পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরীর উদ্দেশ্যে উল্কার মত গতিবেগে পূর্ব পাকিস্তানের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যান জনগনের দোড়গোডায়। তিনি ১৯৬৬ সালে ১৮ এপ্রিল খুলনার জনসভা শেষে ঢাকা ফেরার পথে যশোহর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতিরক্ষা আইন ৪৭(৫) ধারা বলে গ্রেফতার করে।
ছয় দফার বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে পাকিসরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগড়তলা ষড়ষন্ত্র মামলা টুকে দেয়।প্রহসনের এই মামালায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির দেয়ার নাটক মঞ্চস্ত করে। পুর্ব বংলার জনগণ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সারা দেশের রাস্তায় নামে। জেলের তালা ভাংবো বঙ্গবন্ধুকে আনবো – এই শ্লোগানে গর্জ ওঠে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলে। আসে উনসত্তরের গণ অভুত্থান।বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রন্জিত করে মুক্তিকামী জনতা। বঙ্গুবন্ধকে নিঃশর্ত ভাবে মুক্তি দিতে কুচক্রি মহল বাধ্য হয়।
সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পর আসে এয়াহিয়া সরকার।সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামীগ বিপুল জনসমর্থন নিয়ে জয় লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব পার্লামেন্ট গঠন করার কথা।কিন্তু না এয়াহিয়া নেপথ্যের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। একাত্তরে ৩ মার্চ পার্লামেন্ট অধিবেশন বসার কথা থাকলেও ১ মার্চ কোন কারণ ছাড়াই এয়াহিয়া সরকার তা বন্ধ করে দেয়। স্বাধীনতাকামী জনগণ রোষাণলে ফেটে পরে। তারা স্বায়ত্ব শাসনের পরিবর্তে স্বাধীনতা চাই এই এক দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে।
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুফিকার আলী ভুট্টু, সামরিক শাসক এয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একে একে বহু গোল টেবিল বা লম্বা টেবিল মিটিং হলেও কোন ফয়সালার পথ বেরিয়ে আসেনি। বরং পূর্ব পাকিস্তানের আনাকানাচে জনরোষ বাড়তে থাকে অগ্নি স্ফূলিঙ্গের মত। ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল এর পর আসে ৭মার্চের কর্মসূচি। ঐতিহাসিক সে জন সভায় সহোরাওয়ার্দি উদ্যানে লাখো সাখো জনতার সামনে শেখ মুজিবুর রহমান চুড়ান্ত কর্মপন্থা তুলে ধরেন। তিনি বলেন– এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।আরো বলেন – রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেবো। এদেশের মানষকে মুক্ত
করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ্।
বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২ টা ২০ মিনিটে বংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণাটি বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়।তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার পর বলেন -এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা,আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।
বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর এই সমস্ত বার্তা সারা দেশে ছড়িয়ে পরার পর, পাকিস্তান বাহিনী ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। পাকিস্তান কারাগারে বন্দি রেখে আবারও ফাঁসিতে ঝুলানো পায়তারা করতে থাকে।
কোন আগাম সর্তক নোটিশ ছাড়াই অপারেশান সার্চ লাইট নামে পাকি সরকার ২৫ মার্চ রাতে ১৯৭১এ অভিযান চালায় পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত জনগণের উপর। বিশেষ করে ঢাকার রাজপথ তলিয়ে যায় অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষের রক্তে। যাকে যেখানে যে অবস্থায় পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে।তারা চেয়েছিলো বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সাধ ধূলিতে মিশিয়ে দিতে। না পকিস্তানের সে আশা পূরণ হয়নি।শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী জনতার সস্ত্রমুক্তিযোদ্ধ।
সুদীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করার পর বাঙালি তার ঠিকানা আবিস্কার করে। অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা,জীবনের ক্ষয়,রক্ত ক্ষরনের পর বাংলাদেশের জন্ম হয় বিশ্ব মানচিত্রে। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন যৌবন বিলিয়ে দিয়েছেন বাঙালির মুক্তির জন্য।বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে শেখ মুজিবুর রহমানকে মূল্যায়ত করতে বাঙালি কৃপণতা করেনি। তিনি বাঙালি জাতির পিতা, বিশ্ববন্ধুর মর্যাদাও স্বমহিমায় অর্জন করেছেন।বঙ্গবন্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ -একই সূতায় গাঁথা অমর কাব্যকথা।পৃথিবী যতদিন থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বহমান ও ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় তত দিন স্মরণ তালিকায় মাইল ফলক হয়ে বেঁচে থাকবে।
লেখকঃ উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য, বাংলাদেশ কৃষকলীগ।