পাখি আর হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে মনখোলা সবুজ প্রকৃতির হাতছানি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাখি আর পর্যটকের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠছে হাকালুকি আর বাইক্কা বিল। স্ব স্ব্ব গুণে পরিচিতি খ্যাত হাওর হাকালুকি আর হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে মনখোলা সবুজ প্রকৃতির হাতছানি। দৃষ্টিজুড়ে মনখোলা নৈসর্গিক প্রকৃতি। নানা প্রজাতির উদ্ভিদ, জলজ আর উভয়চর প্রাণীর আবাসস্থলের জন্য যেমন হাকালুকি, তেমনি দেশীয় নানা জাতের মাছ ও পাখির অভয়ারণ্যের জন্য বাইক্কা বিল। শীত আর গ্রীষ্ম দু’মৌসুমে এই দুটি স্থানের প্রকৃতির দু’ধরনের রুপ সৌন্দর্য। প্রকৃতির এমন উজাড় করা রুপ মাধুর্য আকৃষ্ট করে যে কাউকে।

Image result for পাখি  বিল ছবি

সারা বছরই পর্যটকদের মুগ্ধ করে হাওর দুটি। বর্ষায় দু’চোখ জুড়ে থৈ থৈ পানি। বিশাল জলরাশির মধ্যখানে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে জেগে ওঠা সবুজ পত্র পল্লবের হিজল, করচ আর কতকি নয়ন কাড়া সবুজ জলজ বনের রাজ্য।

আর শীত মৌসুমে দু’ চোখ জুড়ে শুধু সবুজ ঘাসের মাঠ। তখন পুরো হাওর জুড়ে গরু মহিষের বাতান। আর হাওরের বিলে খাদ্যের সন্ধানে অবাধ বিচরণ নানা জাতের দেশী ও অতিথি পাখির। তাই ওই সময়ে সকাল সন্ধ্যায় পাখি দেখতে স্থান দুটিতে সমাগম ঘটে পাখি প্রেমীদের।

হাকালুকি হাওর: স্থানীয়ভাবে প্রবাদ আছে হাওর মানে হাকালুকি আর সব কুয়া (কুপ),ব্যাটা (পুরুষ) মানে মান মনসুর আর সব পুয়া (ছেলে)। প্রকৃতির এই বিশাল দুনিয়ায় কি নেই। নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ,পাখি, শাপলা-শালুক, ঝিনুক, শত প্রজাতির জলজ প্রাণী আর হিজল, কড়চ, বরুন, আড়ং, মূর্তা, কলুমসহ সবুজের ঢেউ জাগানিয়া মনকাড়া পরিবেশ। বর্ষা মৌসুমে থৈ থৈ পানি আর শীত মৌসুমে পাখির খেলা বিমোহিত রূপ মাধুর্যে কাছে টানে প্রকৃতিপ্রেমীদের।

Related image

এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির সীমানা মৌলভীবাজার জেলা ছাড়িয়ে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত। ৫টি উপজেলা (কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ) জুড়ে ২৩৮টি বিল নিয়ে এ হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪ শত হেক্টর। নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে থাকা হাকালুকি এখন কোনরকম তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। প্রতিবছরের মত এবারো অতিথি পাখিরা আসছে উত্তর গোর্লাধের শীত প্রধান দেশ থেকে। একটু উম, উষ্ণতা আর খাবারের নিশ্চয়তায়। পুরো শীত মৌসুম এরা দাপিয়ে বেড়ায় হাকালুকি হাওরের এ বিল থেকে ও বিলে। আর বসন্তের শুরুতেই তাদের অস্থায়ী নিবাস গুটিয়ে নিজ নিজ দেশের আপন নীড়ের উদ্দেশ্যে উড়াল দেবে। এ কয়দিনের জন্য ওরা হাওর পাড়ের হিজল,করচ, বরুণ,আড়াং গাছেই গড়ে তুলে তাদের অস্থায়ী নিবাস। প্রত্যুষে কিংবা গোধুলি লগ্নে পাখিদের ওড়াওড়ি, ডুবসাতার, জলখেলি, খুনসুটি, রোদে পালক পোহানু আর খাবার নিয়ে ঝগড়া কিংবা খাবার সংগ্রহের মনোহর দৃশ্য এখন হাকালুকির কয়েকটি বিলে।

Related image

হাকালুকি হাওর পাড়ের বাসিন্ধারা জানালেন, ইতিমধ্যেই ছোট ছোট দলে হাওরের পিংলা, চাতলা, চৌকিয়া, হাওরখাল, মালাম, গৌড়কুড়ী, নাগুয়া, তুরল, কালাপানি, ফোয়ালা, বালিজুড়ী, কাংলি ও ফুটবিলে নানা জাতের নানা রঙের অতিথি পাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। এখন পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে হাওর পাড়ের চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠছে। তবে এদের শিকার করতে স্থানীয় একটি চক্র রয়েছে তৎপর। প্রতিবছরই নানা কারণে অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তবে অতিথি পাখি কমে গেলেও বছর জুড়ে বেশ কিছু মাছ শিকারি দেশীয় পাখির দেখা মেলে। হাকালুকি হাওরে পাখি কমার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক ও পাখি বিশেজ্ঞ ডক্টর পল থমসন বলেন যখন পাখিরা আসে তখন জলাভুমিতে মাছ ধরা পড়ে। বোরো ধান চাষেরও মৌসুম থাকে। ওই এলাকায়  তখন মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। পাখিরা যখন বুঝে নেয় তাদের আবাসস্থলটি নিরাপদ নয়, তখনই পরবর্তী বছরে ওই জায়গাটিতে তারা আর আসতে চায় না। আর একারনেই পাখির আনাগোনা কমতে থাকে।

 

Related image অনিরাপদ আবাসস্থল আর খাদ্য সংকট মূলত এ দু’টি বিষয় পাখি কমবেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। তারা  বলেন, হাকালুকি হাওরের বিলগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মাছ, উদ্ভিদ ও জলজ গাছের সংখ্যা কমছে। অরক্ষিত থাকার কারনে হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট হচ্ছে বা এই প্রাকৃতিক সম্পদের যতাযত ব্যবহার হচ্ছে না। এমন কারনসহ নানা কারনেই হাওরের জীব বৈচিত্র্য ও প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। তারা বলেন, যদি হাওরের সার্বিক উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে সরকার এবং স্থানীয় জনগণ একসঙ্গে কাজ করেন, তাহলেই কেবল এই প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ করা সম্ভব। হাওরের সুন্দর পরিবেশ, বন, জলজ ও উভয়চর প্রাণী, দেশীয় প্রজাতির মাছ, সর্বোপুরী জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষা পাবে। এমনটি হলে হাওর পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন জীবীকা রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন শিল্প বিকাশের পথকে আরো সুগম করবে।

Related image

বাইক্কা বিল: প্রতিবছরের মত এবারো অতিথি আর দেশীয় পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হচ্ছে বাইক্কা বিল। ৪২৫ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বিলের সুনাম প্রকৃতি প্রেমীদের মুখে মুখে। নয়না ভিরাম প্রকৃতি। নানা জাতের গাছ, মাছ আর পাখি। বিলের পাড়ে সবুজ ঘন বন। ওখানেই স্থায়ী নিবাস গড়া পাখি আর পোকা মাকড়ের  হাক ডাক নিস্তব্দতা ভেঙ্গে জানান দেয় ভিন্ন আমেজ। ওখানে প্রকৃতি যেন একে অপরের সাথে মিতালি গড়েছে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী বাইক্কা বিলে প্রায় ৯০ প্রজাতির মাছ ও ১৬০ প্রজাতির পাখির অভয়াশ্রম। বাইক্কা বিল শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের প্রায় ১শ’ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমির নাম। যেটিকে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় এই বিল মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।

Related image

এর পর থেকে এখন পর্যন্ত বিপুল অতিথি পাখি আর দেশীয় নানা জাতের ছোট বড় মাছ ও পাখির নিরাপদ আবাসস্থল এটি। নয়নাভিরাম নানা জলজ প্রকৃতি। বিলের পাড় ও কূল ঘেষে হিজল, করচ ,নল খাগরা, ঢোল কলমি আর ফুল ও লতাগুল্ম। বিলে কুচুরি পানা,শাপলা ও পদ্ম,সিংড়া,ওকল,মাখনা। বাইক্কা বিলে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ নানা জাতের পাখি। বাইক্কা বিলের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত থাকা সমাজ ভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন বড়গাঙ্গিনার  সেক্রেটারি মিন্নত আলী বলেন, এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে আমাদের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা ও সচেতনতার প্রয়োজন। হাওরে মাছ বৃদ্ধির জন্য বেশি করে গভীর অভয়াশ্রম ও পাখির নিরাপদ নিবাসের জন্য বনায়নের গুরুত্বারোপ করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর