ঢাকা ০১:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐতিহ্যবাহী ভাসমান সবজি চাষ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩০:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
  • ২ বার
দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জের কিছু অংশে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এ অঞ্চলগুলোতে ৩০০ থেকে ৪০০ বছর ধরে ভাসমান বাগানে সবজি চাষ হয়ে আসছে

বাংলাদেশের রয়েছে শত বছরের পুরনো ভাসমান চাষের ঐতিহ্য। দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জের কিছু অংশে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এ অঞ্চলগুলোতে ৩০০ থেকে ৪০০ বছর ধরে ভাসমান বাগানে সবজি চাষ হয়ে আসছে।

স্থানীয় ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলে ধাপ বা বায়রা।প্রকৃত অর্থে বাগানগুলো মূলত ভাসমান কৃত্রিম দ্বীপ। জোয়ার-ভাটায় পানির স্তরের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধাপগুলোও ওঠানামা করে। বাংলাদেশের আদি এক পদ্ধতি এই ভাসমান চাষ।

আশির দশকের মাঝামাঝিতে এই চাষপদ্ধতি প্রথম জনসমক্ষে তুলে আনার সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তারপর চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর ক্যামেরায়ও বহুবার দেশের প্রাচীন এই চাষপদ্ধতি আমি তুলে ধরেছি।আমাদের আদি ঐতিহ্যের বিবেচনায় ২০১৫ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা দক্ষিণের ভাসমান চাষ ব্যবস্থাকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার নিচু এলাকা দেউলবাড়ি দোবড়া, মালিখালী ও দীর্ঘা ইউনিয়নের মুগারঝোর, কলারদোয়ানিয়া, দীর্ঘা, বৈঠাকাটা, খলনি, মেদা, সাচিয়া, পাকুরিয়া, গাঁওখালী, পদ্মডুবিসহ অনেক গ্রামে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে।

মুগারঝোর এলাকায় সবচেয়ে বেশি জায়গাজুড়ে চাষ করা হয় বলে এক শীতের সকালে আমাদের গন্তব্য ছিল সেখানেই।মুগারঝোরে যখন পৌঁছলাম, জোয়ারের পানি নামতে শুরু করেছে। একটা নৌকা নিয়ে দ্রুত নেমে গেলাম ভাসমান চাষের মাঠে। বিশাল এলাকায় সারি সারি শাক-সবজির বেড। নিচু জমিতে জমে থাকে কচুরিপানা, শেওলা, দুলালী বন, ফ্যানা ঘাসসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের স্তূপে তৈরি সারি সারি ধাপ।

পানির ওপর ভাসমান এই একেকটি ধাপ ৭০ থেকে ৮০ ফুট লম্বা এবং পাঁচ-ছয় ফুট চওড়া। অনেকটা ভেলার মতো কাঠামো। এভাবেই গড়ে ওঠে ছোট ছোট দ্বীপ আকারের ভাসমান সবজিক্ষেত।বেডের পরিচর্যা করছিলেন কৃষক আক্তারুজ্জামান। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই কৃষির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব তাঁরা বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন। আগে এখানে কোনো রকম সার বা কীটনাশক ছাড়াই চারা উৎপাদন ও সবজি চাষ করা যেত। কিন্তু এখন চারায় এক ধরনের মরিচার মতো দাগ দেখা যায়, বাড়ছে নানা রকম ভাইরাসের আক্রমণও।

বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, বেশ পরিবর্তন এসেছে এখানকার চাষ ব্যবস্থাপনায়। শতভাগ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চলা এই কৃষি অনুশীলনেও এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সার ও কীটনাশক।

এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষি বিভাগের প্রশিক্ষণকে দায়ী করেছেন কয়েকজন। একজন বললেন, ‘তারা আমাদের ট্রেনিং দেয়। কিন্তু আমরা এটা করে আসছি শৈশব থেকে, আমরাই তাদের শিখিয়েছি। এখন তারা বলে সার দিতে, কীটনাশক দিতে। কিন্তু আগে কখনো আমাদের এসব ব্যবহার করতে হয়নি।’

বেশির ভাগ কৃষক ভাসমান ধাপ বা বেড ভাড়া নিয়ে চাষ করছেন। ছোট একেকটি বেডের ভাড়া ছয়-সাত হাজার টাকা। কৃষক শহিদুল জানান, ৩২টি ধাপে সবজি ও চারা উৎপাদন করে আগে ভালো লাভ হলেও দিন দিন লাভের পরিমাণ কমছে। সার-কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে উৎপাদন খরচও।

নিরাপদ সবজি উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র দক্ষিণাঞ্চলের ভাসমান চাষকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সরকারের আরো সুপরিকল্পনা। তা না হলে এই চাষব্যবস্থা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ঐতিহ্যবাহী ভাসমান সবজি চাষ

আপডেট টাইম : ১২:৩০:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জের কিছু অংশে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এ অঞ্চলগুলোতে ৩০০ থেকে ৪০০ বছর ধরে ভাসমান বাগানে সবজি চাষ হয়ে আসছে

বাংলাদেশের রয়েছে শত বছরের পুরনো ভাসমান চাষের ঐতিহ্য। দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জের কিছু অংশে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এ অঞ্চলগুলোতে ৩০০ থেকে ৪০০ বছর ধরে ভাসমান বাগানে সবজি চাষ হয়ে আসছে।

স্থানীয় ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলে ধাপ বা বায়রা।প্রকৃত অর্থে বাগানগুলো মূলত ভাসমান কৃত্রিম দ্বীপ। জোয়ার-ভাটায় পানির স্তরের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধাপগুলোও ওঠানামা করে। বাংলাদেশের আদি এক পদ্ধতি এই ভাসমান চাষ।

আশির দশকের মাঝামাঝিতে এই চাষপদ্ধতি প্রথম জনসমক্ষে তুলে আনার সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তারপর চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর ক্যামেরায়ও বহুবার দেশের প্রাচীন এই চাষপদ্ধতি আমি তুলে ধরেছি।আমাদের আদি ঐতিহ্যের বিবেচনায় ২০১৫ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা দক্ষিণের ভাসমান চাষ ব্যবস্থাকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার নিচু এলাকা দেউলবাড়ি দোবড়া, মালিখালী ও দীর্ঘা ইউনিয়নের মুগারঝোর, কলারদোয়ানিয়া, দীর্ঘা, বৈঠাকাটা, খলনি, মেদা, সাচিয়া, পাকুরিয়া, গাঁওখালী, পদ্মডুবিসহ অনেক গ্রামে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে।

মুগারঝোর এলাকায় সবচেয়ে বেশি জায়গাজুড়ে চাষ করা হয় বলে এক শীতের সকালে আমাদের গন্তব্য ছিল সেখানেই।মুগারঝোরে যখন পৌঁছলাম, জোয়ারের পানি নামতে শুরু করেছে। একটা নৌকা নিয়ে দ্রুত নেমে গেলাম ভাসমান চাষের মাঠে। বিশাল এলাকায় সারি সারি শাক-সবজির বেড। নিচু জমিতে জমে থাকে কচুরিপানা, শেওলা, দুলালী বন, ফ্যানা ঘাসসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের স্তূপে তৈরি সারি সারি ধাপ।

পানির ওপর ভাসমান এই একেকটি ধাপ ৭০ থেকে ৮০ ফুট লম্বা এবং পাঁচ-ছয় ফুট চওড়া। অনেকটা ভেলার মতো কাঠামো। এভাবেই গড়ে ওঠে ছোট ছোট দ্বীপ আকারের ভাসমান সবজিক্ষেত।বেডের পরিচর্যা করছিলেন কৃষক আক্তারুজ্জামান। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই কৃষির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব তাঁরা বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন। আগে এখানে কোনো রকম সার বা কীটনাশক ছাড়াই চারা উৎপাদন ও সবজি চাষ করা যেত। কিন্তু এখন চারায় এক ধরনের মরিচার মতো দাগ দেখা যায়, বাড়ছে নানা রকম ভাইরাসের আক্রমণও।

বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, বেশ পরিবর্তন এসেছে এখানকার চাষ ব্যবস্থাপনায়। শতভাগ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চলা এই কৃষি অনুশীলনেও এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সার ও কীটনাশক।

এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষি বিভাগের প্রশিক্ষণকে দায়ী করেছেন কয়েকজন। একজন বললেন, ‘তারা আমাদের ট্রেনিং দেয়। কিন্তু আমরা এটা করে আসছি শৈশব থেকে, আমরাই তাদের শিখিয়েছি। এখন তারা বলে সার দিতে, কীটনাশক দিতে। কিন্তু আগে কখনো আমাদের এসব ব্যবহার করতে হয়নি।’

বেশির ভাগ কৃষক ভাসমান ধাপ বা বেড ভাড়া নিয়ে চাষ করছেন। ছোট একেকটি বেডের ভাড়া ছয়-সাত হাজার টাকা। কৃষক শহিদুল জানান, ৩২টি ধাপে সবজি ও চারা উৎপাদন করে আগে ভালো লাভ হলেও দিন দিন লাভের পরিমাণ কমছে। সার-কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে উৎপাদন খরচও।

নিরাপদ সবজি উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র দক্ষিণাঞ্চলের ভাসমান চাষকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সরকারের আরো সুপরিকল্পনা। তা না হলে এই চাষব্যবস্থা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।