হাওর বার্তা ডেস্কঃ গৃহদাহে পুড়ছে ছোট একাধিক রাজনৈতিক দল। নেতৃত্বের বিরোধসহ অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখে বেশ কয়েকটি দল ভাঙনের মুখে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে ভাগ হতে পারে আরও অনেক দল।
সম্প্রতি দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি।
কেন্দ্রীয় কংগ্রেসকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়েছে দলটি। এর আগে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতেও ভাঙনের সুর ওঠে।
মতবিরোধের কারণে ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে কর্নেল অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি। সংকট চলছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামেও।
এছাড়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনসহ ছোট ছোট আরও কয়েকটি দলও ঘরের আগুনে পুড়ছে। যার আঁচ লেগেছে বড় দল বিএনপিতেও।
ইতিমধ্যে বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা দল ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দলটির কেউ কেউ রাজনীতি থেকেও বিদায় নেয়ার কথা জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তারেক শাসমুর রেহমান এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘মূলত ছোট দলগুলোর কোনো গণভিত্তি নেই। অনেক দলই এক নেতা বা এক ব্যক্তিনির্ভর এবং নামসর্বস্ব। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এরা সক্রিয় হয়। মন্ত্রী-এমপি হওয়ার জন্য বড় দলের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করে। এতে কোনো কোনো দলের নেতা সফল হন। আবার অনেকেই ব্যর্থ হন। নির্বাচন শেষ, এদের কর্মকাণ্ডও শেষ।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছোট দলগুলোর নেতাদের আদর্শিক অবস্থান যতটা না, এর চেয়ে বেশি তাদের ব্যক্তিস্বার্থ। এই স্বার্থে আঘাত লাগলেই এরা একজন আরেকজনকে ছেড়ে যান, একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। দল ভাঙেন, আলাদা দল গঠন করেন। এরা কখনোই জাতীয় রাজনীতিতে, এমনকি সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। তাই দিন শেষে আবার ভোট এলে বড় দলের ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।’
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং ব্যক্তিস্বার্থই মূলত দলগুলোর ভেতরে টানাপোড়েনের মূল কারণ।’
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথম সংকটে পড়ে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি। নিজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খানকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য করা, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে রাশেদ খান মেননের নাম আসা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়।
এছাড়া দলটির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে থাকা-না-থাকা নিয়ে কথা ওঠে। গঠনতন্ত্রের নিয়ম উপেক্ষা করে কংগ্রেসকে সামনে রেখে পার্টিতে নতুন সদস্য করাসহ নানা ইস্যুতে মতপার্থক্য দেখা দেয়।
২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত পার্টির দশম কংগ্রেস ঘিরে এই নিজেদের মধ্যে দূরত্বের বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ নেয়। ‘কমিউনিস্ট আদর্শভিত্তিক দলের যে রাজনৈতিক চরিত্র থাকা উচিত, ওয়ার্কার্স পার্টি তা থেকে অনেক আগেই দূরে সরে গেছে।’
এমন দাবি করে পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পলিটব্যুরোর সদস্য বিমল বিশ্বাস দল ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। প্রাথমিক সদস্যপদসহ পার্টির সব জায়গা থেকে তিনি ইস্তফা দেন।
বিমল বিশ্বাস ছাড়াও দলটির পলিটব্যুরোর দুই সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা কংগ্রেস বর্জন করেন। বিক্ষুব্ধ এই অংশটি এখন আলাদা দল গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা বলেছিল ওয়ার্কার্স পার্টি ভাঙছে, তাদের কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কংগ্রেসের পর ওয়ার্কার্স পার্টি আরও সুসংগঠিত ও শক্তিশালী হয়েছে।’
ওয়ার্কার্স পার্টির পরপরই ভাঙনের মুখে পড়ে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি। স্বাধীনতার পরপরই আওয়ামী লীগের বিপরীতে গড়ে ওঠা শক্তিশালী এই দলটি নানা সময়ে ভেঙেছে।
বর্তমানে এর একটি অংশ আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি বিএনপির সঙ্গে মিলে সরকারবিরোধী জোট ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করে। আর এই জোট গঠনের দেড় বছরের মাথায় এসে ভাঙনের মুখে পড়েছে জেএসডি।
মূলত দলীয় নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দেয়া এবং বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ এনেই দলের শীর্ষ নেতারা দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেছেন।
একদিকে সভাপতি আ স ম আবদুর রব, অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন। একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে দু’পক্ষই পাল্টাপাল্টি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল আহ্বান করেছেন। মাঝে সমঝোতার একটি উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে গেছে। এখন অপেক্ষা দলটির আরও একটি ব্র্যাকেটবন্দি হওয়ার।
জেএসডি কি ভাঙনের মুখে- এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল মালেক রতন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের দল চলবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গঠনতন্ত্র মেনে। সেখানে ব্যক্তিতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত থাকবে না। দল চলবে নেতাকর্মীদের মতের ভিত্তিতে।
একটি অংশ জেএসডিকে ব্যক্তিস্বার্থে বিএনপি-জামায়াতের বি-টিম বানাতে চায়। আমরা তা হতে দিতে পারি না।’ তবে এ বিষয়ে দলটির সভাপতি আ স ম আবদুর রব কোনো মন্তব্য করেননি।
সংকট চলছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামেও। স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দল পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ কারণে ভাঙনের মুখে গণফোরামও। ড. কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে দলটির একটি অংশ গঠনতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, ব্যক্তিস্বার্থে অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দল পরিচালনার অভিযোগ এনেছে।
এছাড়া দলের নীতি, আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিসর্জন দিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে ঐক্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে। গণফোরামের ছয় শীর্ষ নেতা তার বিরুদ্ধে লিখিতভাবে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এই ছয় শীর্ষ নেতাই গণফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য।
এ প্রসঙ্গে মফিজুল ইসলাম খান কামাল রোববার যুগান্তরকে বলেন, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আমরা গণফোরাম প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। এ দল আমাদের হাতে গড়া। দলটির ক্ষতি হোক, আমরা তা চাই না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- যে লক্ষ্য, নীতি, আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে গণফোরামের জন্ম হয়েছিল, দলটি এখন সে জায়গায় নেই।
ড. কামাল হোসেনসহ কয়েকজন সুবিধাভোগী নেতা গণফোরামকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গী বানিয়ে ফেলেছেন। আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। দলের সভাপতিকে লিখিতভাবে আমাদের কথা জানিয়েছি। যদি তারা না শুধরান, তবে আমরা আমাদের মতো করে পথ চলব।’
এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সমস্যা থাকলে আমরা আলোচনায় বসে তা সমাধান করব। এ নিয়ে বাইরে কথা বলা সমীচীন মনে করি না।’
সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর ভেঙে যায় কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি। ৯ নভেম্বর কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে সভাপতি এবং ড. রেদোয়ান আহমেদকে মহাসচিব করে নতুন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা হয়।
এই কমিটি থেকে বাদ পড়েন দলটির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। তারপর থেকেই মূলত দলে ভাঙনের গুঞ্জন ওঠে। ১৮ নভেম্বর তা চূড়ান্ত রূপ পায়।
এদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এলডিপির পদবঞ্চিত নেতারা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অলি আহমেদ এবং রেদোয়ান আহমেদের বিপরীতে ৭ সদস্যের নতুন সমন্বয় কমিটি ঘোষণা দেয়। এলডিপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম এই কমিটি ঘোষণা করেন। আবদুল করিম আব্বাসীকে সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং শাহাদাত হোসেন সেলিমকে সদস্য সচিব করা হয়।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে শাহাদাত হোসেন সেলিম রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সঙ্গেই ঐক্য অটুট রাখা। এর বিকল্প হিসেবে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’
সংকট চলছে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপাতেও। সংশ্লিষ্টদের মতে, ছোট দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। উল্লেখযোগ্য সভা-সমাবেশ নেই। কিন্তু নিজেদের বিবাদে পুড়ছে এসব দল।
নেতায়-নেতায় দ্বন্দ্ব, দলে নেতৃত্বের প্রশ্ন এবং পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাসের কারণেই অস্থিরতা বিরাজ করছে দলগুলোয়। চলছে ভাঙনের খেলা। এর আঁচ লাগছে বড় দল, বিশেষ করে বিএনপিতেও।
ইতিমধ্যে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান রাজনীতি থেকেই অবসরে চলে গেছেন। ভাইস চেয়ারম্যান মোর্শেদ খান দল ত্যাগ করেছেন। ফলে ভেতর থেকে চাপে পড়েছে বিএনপি। সিলেটের মেয়র আরিফুল হকসহ বিএনপির স্থানীয় কয়েক নেতার দলত্যাগের গুঞ্জন এই সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
জানুয়ারিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, একাদশ নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। দেশে এসেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। মোরশেদ খান বলেছেন, বিএনপি এখন স্কাইপে পার্টিতে পরিণত হয়েছে।
দল থেকে একাধিক নেতার চলে যাওয়ার বিষয়ে অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, ‘দুই-একজন নেতার পদত্যাগে বিএনপি বিচলিত নয়। বিএনপি একটি বড় দল, দুই-চারজন চলে গেলে কিছু যায় আসে না।