হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইসলামের নবী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, কূটনৈতিক উপায়ে বিভিন্ন সংকট নিরসন ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের মিত্র খুঁজে বের করার মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিলেন।
সরাসরি যুদ্ধ করে প্রতিপক্ষকে যতটুকু পর্যুদস্ত করা যায়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি করা যায় কূটনৈতিকভাবে ঘায়েল করার মাধ্যমে। এ জন্য তিনি (সা.) বলেছিলেন ‘যুদ্ধ হচ্ছে কৌশলের নাম।’ অর্থাৎ গায়ের জোরে সর্বদা বিজয় আসে না। বিজয় অর্জনের জন্য কৌশল করতে হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনীতির মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য ইসলাম দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এ জন্যে একজন কূটনীতিকে হত্যার দায়ে তৎকালিন পরাশক্তি রোমের বিরুদ্ধে রাসূল (সা.) যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। কারণ, এই হত্যাকে যদি বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। রাসূল (সা.) বাস্তব জীবনে কূটনীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে এর গুরুত্ব দেখিয়ে গেছেন।
খন্দকের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী যখন কোনোভাবেই পেরে ওঠছিল না তখন রাসূল (সা.) কূটনীতির আশ্রয় নেন। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ্যের ঐক্যে ফাটল ধরালেন। তখন অমুসলিমরা যুদ্ধ ছাড়াই রাতের আধারে পালাতে বাধ্য হন। ওই বিজয়ের ফল ছিল সুদূর প্রসারী। যুদ্ধের পর তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘এতদিন ওরা এসে আমাদের ওপর হামলা করত, আমরা তা প্রতিহত করতাম। এখন থেকে আমরা গিয়ে তাদের ওপর হামলা করব।’ তাই কূটনীতিকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়ে এসেছে।
রাসূল (সা.) এর কূটনীতির উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিত্র খুঁজে বের করা, আন্তর্জাতিক ভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে ইসলামের সাম্যের বাণী তুলে ধরে দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়া ও কূটনৈতিকভাবে সংকট নিরসনের চেষ্টা করা। শত্রুদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্যও তিনি কূটনীতিকে ব্যবহার করেছেন। বর্তমান সময়ে মুসলিম বুদ্ধিজীবী মহলে এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। অথচ আন্দোলনের চেয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার গুরুত্ব কোনো দিক থেকেই কম নয়। এই লেখার উদ্দেশ্য যেহেতু রাসূল (সা.) এর কূটনৈতিক মিশনগুলো তুলে ধরা। তাই নিম্নে উল্লেখযোগ্য মিশনগুলো দেয়া হলো-
ইথোপিয়ায় রাসূল (সা.) এর কূটনৈতিক সফলতা:
মক্কায় রাসূল (সা.) এর দাওয়াতে ইসলাম প্রসার হচ্ছিল। বৃদ্ধি পাচ্ছিল মুসলমানের সংখ্যা। অন্যদিকে ইসলামের সফলতা দেখে অন্যরা ক্ষিপ্ত হয়। জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় মুসলমানদের ওপর। তাই রাসূল (সা.) মুসলমানদের নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছিলেন। খুঁজ নিয়ে জানতে পারলেন হাবশার (ইথোপিয়া) বাদশা একজন ন্যায়পরায়ন শাসক। তার রাষ্ট্রে কোনো নিরাপরাধ মানুষ শাস্তি ভোগ করে না। কেউ কারো ওপর জুলুম করবে সে সুযোগও নেই। তাই রাসূল (সা.) মুসলমানদের সেখানে পাঠালেন। হাবশার বাদশা, মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে এ খবর মক্কাবাসী জানতে পেরে মুসলমানদের ফেরত আনার জন্য কূটনৈতিকভাবে তৎপরতা শুরু করেন। এ বিষয়ে দক্ষ আমর ইবনে আস ও আব্দুল্লাহ ইবনে আবু রাবিয়াকে ইথোপিয়ায় পাঠান। সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয় বাদশার মন্ত্রীবর্গের জন্য দামি দামি উপহার উপঢৌকন। প্রথমে তারা মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে সাক্ষাত করে আরবদের পক্ষ থেকে দেয়া উপঢৌকনগুলো তাদের সামনে পেশ করে এবং মন্ত্রীবর্গকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, আরবের কিছু মূর্খ লোক বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করে নতুন ধর্মের প্রতি ঈমান এনেছে। এ কারণে তারা আরব থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাই তাদের কোনো মতামত শুনা ছাড়াই আমাদের সঙ্গে যেন ফেরত পাঠানো হয়। মন্ত্রীবর্গ সে অনুযায়ী দরবারে বিষয়টি উত্থাপন করলে, বাদশা ক্ষিপ্ত হন এবং বলেন, তাদের সঙ্গে কথা না বলে, তাদেরকে তোমাদের সঙ্গে কখনো ফেরত পাঠাতে পারি না। এটা কীভাবে সম্ভব যে, স্বদেশে যাদের হাতে নির্যাতিত হয়ে আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে, আজ ওদের হাতেই তাদেরকে সোপর্দ করে দেব?
হজরত জাফর (রা.) রাজদরবারে ইসলাম সম্পর্কে এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন এবং কোরআনের কিছু অংশ তেলাওয়াত করে শুনান। বাদশা তেলাওয়াত শুনে এতই প্রভাবিত হন যে, চোখের পানি দিয়ে দাড়ি ভিজে যায় এবং মুসলমানদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নাকচ করে দেন। পরের দিন আমর ইবনে আস, মুসলমানদের খৃষ্টবাদ সম্পর্কে ভুল বিশ্বাসের তথ্য বাদশার সামনে পেশ করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। সে তথ্যে মন্ত্রীবর্গের মধ্য থেকে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হলেও, বাদশা বলেন, ‘আল্লাহর কসম, খৃষ্টবাদের আসল চিন্তা তাই, যা মুসলমানরা পেশ করেছে। তাই তোমরা ক্ষিপ্ত হলেও আমি এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হব না এবং মুসলমানদের ফেরত পাঠানোর বদলায় স্বর্ণের পাহাড় দেয়া হলেও আমি তা গ্রহণ করব না।’ এবং নির্দেশ দিলেন, ‘তাদের সমস্ত উপঢৌকন যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়। কারণ, এগুলো মূলত ঘুষ। আল্লাহ তায়ালা ঘুষ ছাড়াই আমাকে রাজত্ব দিয়েছেন। তাই ঘুষ নিয়ে আমি মুসলমানদেরকে আমার রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে পারি না।’ এভাবে আরবদের কূটনৈতিক তৎপরতা এখানে ব্যর্থ হয় এবং মুসলমানরা সফল হয়ে নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে থাকে।
মদিনার সনদ প্রণয়ন:
মদিনায় তিনটি ধর্মের অনুসারীদের বসবাস ছিল। মুসলমান, ইহুদী ও মূর্তিপূজক। মদিনায় ইসলামের প্রচার শুরু হয় হিজরি এগারো সনে। মদিনার কিছু মুশরিক হজ করার জন্য মক্কায় এলে রাসূল (সা.) এর সঙ্গে সাক্ষাত হয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করে। দুই বছরের মাঝে মদিনার আওস ও খাজরাজ গোত্রের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হয়ে যায়। মক্কায় মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বাড়তে থাকলে, মুসলমানরা দলে দলে মদিনায় হিজরত করে। এক পর্যায়ে রাসূল (সা.) নিজেও হিজরত করতে বাধ্য হন। আওস ও খাজরাজ গোত্রের সঙ্গে ইহুদীদের প্রায়ই যুদ্ধ হত। হিজরতের পর রাসূল (সা.) চাইলেন, বিবাদমান গ্রুপগুলোকে একটি সংবিধানের আওতায় এনে সে অনুযায়ী মদিনা রাষ্ট্রটি পরিচালিত হোক। সে উদ্দেশ্যে মদিনার ইহুদী, মূর্তিপূজক ও মুসলমানদের সম্মতিতে একটি সনদ প্রণয়ন করা হয়। সেটিই আজ মদিনার সনদ হিসেবে খ্যাত। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এর আগে লিখিত কোনো সংবিধান কোথাও ছিল না। রাজা-বাদশাদের যখন যা মনে চাইত, সেভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনা করত। ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে মদিনার সনদ প্রণয়নের ফলে ইহুদীদের তরফ থেকে রাসূল (সা.) অনেকটা নিরাপদ হলেন। এবং মদিনার বাইরে দৃষ্টি দেয়ার ফুরসত পেলেন। মদিনার বিবাদমান গ্রুপগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য জাতিসমূহেকে এক করতে পারাটা ছিল রাসূল (সা.) এর কূটনৈতিক সফলতা।
হুদাইবিয়ার সন্ধি ও রাসূল (সা.) এর কূটনৈতিক দূরদর্শিতা:
৬ হিজরিতে ওমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে চৌদ্দশ সাহাবায়ে কেরামের এক কাফেলা রওয়ানা হয়। হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে, রাসূল (সা.) ওসমানকে মক্কায় পাঠায় এ বার্তা দেয়ার জন্য যে, শুধু ওমরা আদায় করাই আমাদের উদ্দেশ্য, অন্য কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই। কিন্তু হজরত ওসমান (রা.) এর শাহাদাতের ভুল সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে কুরাইশরা প্রতিনিধি পাঠায় সন্ধি স্থাপনের জন্য। সন্ধিতে এমন অনেক বিষয় ছিল, বাহ্যিকভাবে যা মেনে নেয়া মানহানিকর। কিন্তু রাসূল (সা.) সেগুলোকে মেনে নিয়েই সন্ধি স্থাপন করলেন। বাহ্যিক পরাজয়কেই আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করলেন বিজয় হিসেবে। হুদাইবিয়া সন্ধির সুফল ছিল সুদূর প্রসারী।
নিম্নে কয়েকটি তুলে ধরছি-
(এক) সন্ধির ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত পোঁছে দেয়া সহজ হয়। এতদিন মক্কার মুশরিকদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে, রাসূল (সা.) অন্যদিকে মনোযোগ দেয়ার ফুরসত পায়নি। এবার তিনি বাইরের দিকে মনোযোগ দিলেন। তৎকালিন পরাশক্তি রোম, পারস্য ও আঞ্চলিক অন্যান্য রাজা-বাদশার নিকট দাওয়াত সম্বলিত চিঠি পাঠান। দাওয়াত পেয়ে তাদের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। আরবরা, রাসূল (সা.) এর দূরদর্শিতা বুঝতে পারে ওই সময়, যখন রোমের বাদশা আবু সুফিয়ানকে ডেকে রাসূল (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন এবং রাসূল (সা.)-কে সত্য নবী বলে মেনে নেন।
(দুই) আরবের অন্য গোত্রগুলো মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে দ্বীন গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয় এই সন্ধির কারণে। কারণ, ইতোপূর্বে আরবের অন্যান্য গোত্রগুলোর ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল যে, কেউ মুসলমানদের সঙ্গে মিশতে পারবে না। তাই এতদিন তারা ইসলামের সৌন্দর্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পায়নি। এবার মুসলমানদের সঙ্গে মিলে ইসলামের সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করার দ্বারা তাদের ভুল ভাঙ্গে। তাই দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে। তাই হুদাইবিয়া সন্ধির সময় মুসলমানের সংখ্যা চৌদ্দশ থাকলেও বিদায় হজের সময় মুসলমানের সংখ্যা ছিল লাখের চেয়ে বেশি।
মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে সংকট নিরসনের জন্য কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা:
হুদাইবিয়া সন্ধির একটি ধারা ছিল ‘আরবের যে কোনো গোত্র, যে কোনো পক্ষালম্বনে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে। জোর জবরদস্তি করে কেউ কাউকে নিজের পক্ষাবলম্বন করতে বাধ্য করতে পারবে না।’ সে হিসেবে মক্কার বনু বকর, কুরাইশদের পক্ষালম্বন করে; বনু খোজা করে মুসলমানদের পক্ষালম্বন। মক্কায় থেকে মুসলমানদের পক্ষালম্বন করাতে খোজাদের প্রতি কুরাইশ ও তার মিত্র বনু বকর ক্ষিপ্ত হয়। এ যেন আধুনিক কালের কিউবা। যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থেকে সুদূর রাশিয়ার পক্ষালম্বন। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, রাতের বেলায় বনু বকর খোজাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। খোজারা হারাম শরিফে আশ্রয় নিলে সেখানেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বনু বকরের পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধন ছিল কুরাইশদের। পরের দিন খোজা গোত্রের আমর ইবনে সালেমের নেতৃত্বে চল্লিশ জনের একটি প্রতিনিধি দল রাসূল (সা.) এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং ঘটনার বিবরণ দেন। বিস্তারিত জানার পর, রাসূল (সা.) এর তরফ থেকে কুরাইশদের কাছে দূত পাঠিয়ে তিনটি বিষয় আলোচনার কথা বলা হয়-
(এক) হয়তো খোজা গোত্রের নিহতদের রক্তপন আদায় করতে হবে।
(দুই) অথবা বনু বকরের সঙ্গে কুরাইশদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
(তিন) অন্যথায় হুদাইবিয়ার চূক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে।
কুরাইশরা তৃতীয়টি মেনে নিয়ে হুদাইবিয়ার চূক্তিকে বাতিল করে দেয়। পরে অবশ্য হুশ এসেছিল। কিন্তু ততক্ষণে পানি অনেক গড়িয়ে যায়।