ঢাকা ০৯:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাশ্মীরে মানুষ মরলে মরুক, রাজ্যটা তো আমাদের হবে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৫০:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯
  • ২৫৫ বার

প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল কাশ্মীরের মানুষজনের সঙ্গে গোটা দেশের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় টুকরো টুকরো খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও আগুন লাগার খবর, কোথাও গ্রেফতার হওয়ার খবর, কখনও জীবনদায়ী ওষুধের জন্য হাহাকার চলার খবর। অথচ, আমাদের দৈনন্দিন জীবন কিন্তু নিজের নিয়মে চলছে। ধীরে ধীরে প্রথম পাতা থেকে সংবাদপত্রের ছয় নম্বর পাতায় চলে যাচ্ছেন ওরা।

ক্রমশ আরও ছোট হবে কাশ্মীরের খবর। তারপর সেটাও একদিন মেনে নেয়া হতে হতে কাশ্মীর আর খবরই হবে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে হতে কিছু মানুষ হারিয়ে যাবেন। আমরা হয়তো জানতেও পারব না বা বলা ভালো জানতে চাইবে না পরবর্তী প্রজন্ম। ধীরে ধীরে নতুন ঘটনাক্রমকেই মানুষজন সত্যি বলে মেনে নেবেন আগামী দিনে।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু সেই কণ্ঠও এতটাই ক্ষীণ যে, রাষ্ট্রের ঢক্কানিনাদের পাশে তা একেবারেই আর শোনা যাবে না। কেউই আর তখন প্রশ্ন করলেও উত্তর পাবেন না-আচ্ছা, সত্যিটা ঠিক কী ছিল? বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু বড়জোর একদিন।

কিন্তু যে মানুষদের ওপর দিয়ে এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বুলডোজারটি চালানো হল, তারা কি কখনও ভুলতে পারবেন এই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা? তাদের বাড়ির শিশুরা যদি এর পরবর্তীকালে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মেলায়, তখন কি ভারত ভূখণ্ডের মানুষ, সংখ্যাগুরু হিন্দু মনন তাকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেবে?

কাশ্মীরকে বুঝতে গেলে সেখানকার মানুষদের আগে বুঝতে হতো। কোনো দিন কি সারা ভারত ভূখণ্ডের মানুষজন সেই কাশ্মীরকে বোঝার চেষ্টা করেছে? বরং সত্যি-মিথ্যা মেশানো নানা কথা বারবার দেশের সমস্ত অংশের মানুষের কাছে পৌঁছানো হয়েছে, যে কাশ্মীরি মানেই ‘সন্ত্রাসবাদী’। কাশ্মীরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে।

যেহেতু, ভারতের বেশির ভাগ মানুষ ‘জাতীয়তাবাদ’ বলতে ক্রিকেট বোঝেন, সুতরাং তাদের বোঝানটাও এমন কিছু কষ্ট সাধ্য হয়নি, যে ভারত ক্রিকেটে পরাজিত হলে কাশ্মীরে বাজি পোড়ানো হয়, কাশ্মীরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে ইত্যাদি-প্রভৃতি। কিন্তু আমরা কখনই সত্যি কী তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।

আমরা কখনও কি জানতে চেয়েছি যে, ৩৭০ ধারার জন্য সত্যিই কি কিছু সুবিধা ওখানকার মানুষ পেয়েছেন? ওখানকার মানুষের দৈনিক মজুরি কত? সেটা কি ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় কম, না বেশি? এটা কি জানার চেষ্টা করেছেন যে, কাশ্মীরে জমির বণ্টন কী রকম হয়েছে? না। এ সব নিয়ে পড়াশোনা না করলেও চলবে। শুধু এইটুকু জানা থাকলেই হবে যে, কাশ্মীর মূলত মুসলিমপ্রধান রাজ্য, এবং মুসলমান মানেই যেহেতু ‘সন্ত্রাসবাদী,’ওখানকার প্রতিটি মানুষ হয় সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা বা নিজেই সন্ত্রাসবাদী।

অথচ, প্রতি বছর যে কাশ্মীরি শালবিক্রেতারা আসেন তাদের সঙ্গে যদি কথা বলা যায়, তাহলেই বোঝা যাবে সাধারণ কাশ্মীরি মানুষরা কেমন আছেন? তারা কি আদৌ পাকিস্তানের সমর্থক? গত বছর পুলওয়ামার ঘটনার পর আমার পাড়ায় দেখা গিয়েছিল কাশ্মীরি শালবিক্রেতারা মৃত সৈন্যদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। তা হলে কি এই মানুষরা দেশকে ভালোবাসেন না? না কি আমরা কল্পনায় ভেবে নিয়েছি কাশ্মীরি মানুষ মাত্রই সন্ত্রাসবাদী?

যোগাযোগ বন্ধ হলে কি হতে পারে? আজকের সময়ে প্রতিটি মানুষ কম-বেশি ফোনের দাস। সেই ফোন ১২ সংখ্যার একটি নম্বরের সঙ্গে যুক্ত, যার নাম আধার। যা ছাড়া প্রতিটি মানুষ আজকের সময়ে অচল। তা সে রান্নার গ্যাসের বুকিং হোক বা ব্যাংক পরিষেবা পেতে হোক কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হতে। মোটামুটি ফোন ছাড়া সবাই অচল। যদিও আধার কার্ড করার সময়ে বলা হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরকে এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়া হবে।

কিন্তু দেখা গিয়েছে যে, প্রায় ৬৭ শতাংশ কাশ্মীরি মানুষের আধার আছে। তার মানে কী দাঁড়াল? সাধারণ কাশ্মীরিরা এটা প্রমাণ করতে চেয়েছেন ২০০৯ সাল থেকে তারা কিন্তু সন্ত্রাসবাদী নয়। তা হলে এখন যদি যোগাযোগ বন্ধ থাকে কী কী অসুবিধা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

সরকার থেকে যতই আশ্বাস দেয়া হোক যে, জনজীবন স্বাভাবিক হচ্ছে কিন্তু কোনো অভিভাবক কি তার সন্তানদের স্কুলে কিংবা কলেজে পাঠাতে পারবেন এই যোগাযোগবিহীন সময়ে? কোনো মানুষ কি নিশ্চিন্তে তার কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবেন? না কি গেলেও সেখানে কাজ হবে? এটা কি এক ধরনের ‘নাগরিক মৃত্যু’নয়? এই সময়ে এই শাস্তিটা কি একটু বেশিই হয়ে গেল না?

আমরা কি এক বারও ওই মানুষদের স্থানে নিজেদের বসিয়ে দেখেছি? একবারও কি ভেবেছি যে, আমি আমার সন্তানদের বা আমার উপর নির্ভরশীল মানুষদের জন্য কীভাবে খাবারের সংস্থান করব?

না কি আমরা এই যান্ত্রিক সময়ে ঘাড় গুঁজে মোবাইল দেখতে দেখতে ক্রমশ কখন যে নিজেই একা হয়ে গিয়েছি জানতেও পারিনি। সেই জন্যই কি আমাদের কিছু আসে-যায় না, যখন প্রায় ৭০ লাখ লোক গত এক মাস ধরে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে আছেন? আমরা কি এতটাই নির্মম হয়ে গিয়েছি?

আমরা তো আর বিপদে পড়ে নেই। সুতরাং আমাদের আর কী- এই ধারণাই কি আমাদের গ্রাস করেছে?

৩৭০ ধারা বাতিল নিয়ে এবং আরও বেশকিছু সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে মামলা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। আদালত সেই সব মামলাকে ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা অক্টোবর মাস থেকে শুনানি শুনবে। কত দিন সেই শুনানি চলবে কেউ জানে না। আপাতত যা দেখা যাচ্ছে, সামনের এক মাসে মুক্তি নেই। তারপরও কবে আছে কেউ বলতে পারবেন কি?

কারণ, কাশ্মীরের বর্তমান রাজ্যপালও জানিয়েছেন যে, মোবাইল ফোন নাকি সন্ত্রাসবাদীরা ব্যবহার করতেন, তাই তারা মোবাইল যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন।

ঠিক এখানেই আসল ভয়। মানুষের কণ্ঠ যা বলছে, ক্ষমতার কণ্ঠও তাই বলছে। কিংবা বলা ভালো দু’টো কণ্ঠ কোথাও মিলে যাচ্ছে। কোথাও কোনো বিরোধী স্বর নেই। এটাই কি তবে ফ্যাসিবাদ? যেখানে আছে শুধু অন্য জাতির প্রতি ক্ষোভ, অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ? আর নিজের জাতির জন্য থাকে উগ্র জাত্যাভিমান? যে জাত্যাভিমান নিশ্চিন্তে এটা মেনে নেয়- মানুষ মরে মরুক কিন্তু রাজ্যটা বা বলা ভালো জমিটা তো আমাদের হবে! কিংবা ওখানকার মহিলাদের সম্পর্কেও লোলুপ দৃষ্টি প্রকাশিত হয়ে যায় আমাদের অজান্তে!

তবে কি কাশ্মীর একটা পরীক্ষাগার মাত্র? এর পর এটা সারা দেশে যে কোনো জায়গার জন্য প্রযোজ্য হবে? যেখানেই বিরোধীস্বরকে চাপা দেয়ার দরকার হবে, সেখানেই কি এই মডেল প্রয়োগ করা হবে?

বেশ কিছুদিন আগে উইকিলিক্সের এডওয়ার্ড স্নোডেন বলেছিলেন, ভারতের প্রতিটি নাগরিক এমনিই মারা যাবেন, যদি তিনি আধারের সঙ্গে সবকিছুকে যুক্ত করতে বাধ্য হন। আজকের কাশ্মীর কি সেই দিকেই এগুনোর প্রথম ধাপ? এটাও কি এক ধরনের গণহত্যা নয়

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

কাশ্মীরে মানুষ মরলে মরুক, রাজ্যটা তো আমাদের হবে

আপডেট টাইম : ০৯:৫০:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল কাশ্মীরের মানুষজনের সঙ্গে গোটা দেশের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় টুকরো টুকরো খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও আগুন লাগার খবর, কোথাও গ্রেফতার হওয়ার খবর, কখনও জীবনদায়ী ওষুধের জন্য হাহাকার চলার খবর। অথচ, আমাদের দৈনন্দিন জীবন কিন্তু নিজের নিয়মে চলছে। ধীরে ধীরে প্রথম পাতা থেকে সংবাদপত্রের ছয় নম্বর পাতায় চলে যাচ্ছেন ওরা।

ক্রমশ আরও ছোট হবে কাশ্মীরের খবর। তারপর সেটাও একদিন মেনে নেয়া হতে হতে কাশ্মীর আর খবরই হবে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে হতে কিছু মানুষ হারিয়ে যাবেন। আমরা হয়তো জানতেও পারব না বা বলা ভালো জানতে চাইবে না পরবর্তী প্রজন্ম। ধীরে ধীরে নতুন ঘটনাক্রমকেই মানুষজন সত্যি বলে মেনে নেবেন আগামী দিনে।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু সেই কণ্ঠও এতটাই ক্ষীণ যে, রাষ্ট্রের ঢক্কানিনাদের পাশে তা একেবারেই আর শোনা যাবে না। কেউই আর তখন প্রশ্ন করলেও উত্তর পাবেন না-আচ্ছা, সত্যিটা ঠিক কী ছিল? বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু বড়জোর একদিন।

কিন্তু যে মানুষদের ওপর দিয়ে এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বুলডোজারটি চালানো হল, তারা কি কখনও ভুলতে পারবেন এই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা? তাদের বাড়ির শিশুরা যদি এর পরবর্তীকালে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মেলায়, তখন কি ভারত ভূখণ্ডের মানুষ, সংখ্যাগুরু হিন্দু মনন তাকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেবে?

কাশ্মীরকে বুঝতে গেলে সেখানকার মানুষদের আগে বুঝতে হতো। কোনো দিন কি সারা ভারত ভূখণ্ডের মানুষজন সেই কাশ্মীরকে বোঝার চেষ্টা করেছে? বরং সত্যি-মিথ্যা মেশানো নানা কথা বারবার দেশের সমস্ত অংশের মানুষের কাছে পৌঁছানো হয়েছে, যে কাশ্মীরি মানেই ‘সন্ত্রাসবাদী’। কাশ্মীরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে।

যেহেতু, ভারতের বেশির ভাগ মানুষ ‘জাতীয়তাবাদ’ বলতে ক্রিকেট বোঝেন, সুতরাং তাদের বোঝানটাও এমন কিছু কষ্ট সাধ্য হয়নি, যে ভারত ক্রিকেটে পরাজিত হলে কাশ্মীরে বাজি পোড়ানো হয়, কাশ্মীরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে ইত্যাদি-প্রভৃতি। কিন্তু আমরা কখনই সত্যি কী তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।

আমরা কখনও কি জানতে চেয়েছি যে, ৩৭০ ধারার জন্য সত্যিই কি কিছু সুবিধা ওখানকার মানুষ পেয়েছেন? ওখানকার মানুষের দৈনিক মজুরি কত? সেটা কি ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় কম, না বেশি? এটা কি জানার চেষ্টা করেছেন যে, কাশ্মীরে জমির বণ্টন কী রকম হয়েছে? না। এ সব নিয়ে পড়াশোনা না করলেও চলবে। শুধু এইটুকু জানা থাকলেই হবে যে, কাশ্মীর মূলত মুসলিমপ্রধান রাজ্য, এবং মুসলমান মানেই যেহেতু ‘সন্ত্রাসবাদী,’ওখানকার প্রতিটি মানুষ হয় সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা বা নিজেই সন্ত্রাসবাদী।

অথচ, প্রতি বছর যে কাশ্মীরি শালবিক্রেতারা আসেন তাদের সঙ্গে যদি কথা বলা যায়, তাহলেই বোঝা যাবে সাধারণ কাশ্মীরি মানুষরা কেমন আছেন? তারা কি আদৌ পাকিস্তানের সমর্থক? গত বছর পুলওয়ামার ঘটনার পর আমার পাড়ায় দেখা গিয়েছিল কাশ্মীরি শালবিক্রেতারা মৃত সৈন্যদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। তা হলে কি এই মানুষরা দেশকে ভালোবাসেন না? না কি আমরা কল্পনায় ভেবে নিয়েছি কাশ্মীরি মানুষ মাত্রই সন্ত্রাসবাদী?

যোগাযোগ বন্ধ হলে কি হতে পারে? আজকের সময়ে প্রতিটি মানুষ কম-বেশি ফোনের দাস। সেই ফোন ১২ সংখ্যার একটি নম্বরের সঙ্গে যুক্ত, যার নাম আধার। যা ছাড়া প্রতিটি মানুষ আজকের সময়ে অচল। তা সে রান্নার গ্যাসের বুকিং হোক বা ব্যাংক পরিষেবা পেতে হোক কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হতে। মোটামুটি ফোন ছাড়া সবাই অচল। যদিও আধার কার্ড করার সময়ে বলা হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরকে এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়া হবে।

কিন্তু দেখা গিয়েছে যে, প্রায় ৬৭ শতাংশ কাশ্মীরি মানুষের আধার আছে। তার মানে কী দাঁড়াল? সাধারণ কাশ্মীরিরা এটা প্রমাণ করতে চেয়েছেন ২০০৯ সাল থেকে তারা কিন্তু সন্ত্রাসবাদী নয়। তা হলে এখন যদি যোগাযোগ বন্ধ থাকে কী কী অসুবিধা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

সরকার থেকে যতই আশ্বাস দেয়া হোক যে, জনজীবন স্বাভাবিক হচ্ছে কিন্তু কোনো অভিভাবক কি তার সন্তানদের স্কুলে কিংবা কলেজে পাঠাতে পারবেন এই যোগাযোগবিহীন সময়ে? কোনো মানুষ কি নিশ্চিন্তে তার কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবেন? না কি গেলেও সেখানে কাজ হবে? এটা কি এক ধরনের ‘নাগরিক মৃত্যু’নয়? এই সময়ে এই শাস্তিটা কি একটু বেশিই হয়ে গেল না?

আমরা কি এক বারও ওই মানুষদের স্থানে নিজেদের বসিয়ে দেখেছি? একবারও কি ভেবেছি যে, আমি আমার সন্তানদের বা আমার উপর নির্ভরশীল মানুষদের জন্য কীভাবে খাবারের সংস্থান করব?

না কি আমরা এই যান্ত্রিক সময়ে ঘাড় গুঁজে মোবাইল দেখতে দেখতে ক্রমশ কখন যে নিজেই একা হয়ে গিয়েছি জানতেও পারিনি। সেই জন্যই কি আমাদের কিছু আসে-যায় না, যখন প্রায় ৭০ লাখ লোক গত এক মাস ধরে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে আছেন? আমরা কি এতটাই নির্মম হয়ে গিয়েছি?

আমরা তো আর বিপদে পড়ে নেই। সুতরাং আমাদের আর কী- এই ধারণাই কি আমাদের গ্রাস করেছে?

৩৭০ ধারা বাতিল নিয়ে এবং আরও বেশকিছু সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে মামলা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। আদালত সেই সব মামলাকে ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা অক্টোবর মাস থেকে শুনানি শুনবে। কত দিন সেই শুনানি চলবে কেউ জানে না। আপাতত যা দেখা যাচ্ছে, সামনের এক মাসে মুক্তি নেই। তারপরও কবে আছে কেউ বলতে পারবেন কি?

কারণ, কাশ্মীরের বর্তমান রাজ্যপালও জানিয়েছেন যে, মোবাইল ফোন নাকি সন্ত্রাসবাদীরা ব্যবহার করতেন, তাই তারা মোবাইল যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন।

ঠিক এখানেই আসল ভয়। মানুষের কণ্ঠ যা বলছে, ক্ষমতার কণ্ঠও তাই বলছে। কিংবা বলা ভালো দু’টো কণ্ঠ কোথাও মিলে যাচ্ছে। কোথাও কোনো বিরোধী স্বর নেই। এটাই কি তবে ফ্যাসিবাদ? যেখানে আছে শুধু অন্য জাতির প্রতি ক্ষোভ, অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ? আর নিজের জাতির জন্য থাকে উগ্র জাত্যাভিমান? যে জাত্যাভিমান নিশ্চিন্তে এটা মেনে নেয়- মানুষ মরে মরুক কিন্তু রাজ্যটা বা বলা ভালো জমিটা তো আমাদের হবে! কিংবা ওখানকার মহিলাদের সম্পর্কেও লোলুপ দৃষ্টি প্রকাশিত হয়ে যায় আমাদের অজান্তে!

তবে কি কাশ্মীর একটা পরীক্ষাগার মাত্র? এর পর এটা সারা দেশে যে কোনো জায়গার জন্য প্রযোজ্য হবে? যেখানেই বিরোধীস্বরকে চাপা দেয়ার দরকার হবে, সেখানেই কি এই মডেল প্রয়োগ করা হবে?

বেশ কিছুদিন আগে উইকিলিক্সের এডওয়ার্ড স্নোডেন বলেছিলেন, ভারতের প্রতিটি নাগরিক এমনিই মারা যাবেন, যদি তিনি আধারের সঙ্গে সবকিছুকে যুক্ত করতে বাধ্য হন। আজকের কাশ্মীর কি সেই দিকেই এগুনোর প্রথম ধাপ? এটাও কি এক ধরনের গণহত্যা নয়