ঢাকা ০১:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কৃষিতে আস্থা হারাচ্ছে কৃষক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৩৭:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০১৯
  • ৩১৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গ্রামীণ জীবনযাত্রার সর্বত্র যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে তা নয়। পাওয়ার টিলার আর উন্নত প্রযুক্তির যুগে এখনও প্রান্তিক কৃষক লাঙ্গল-জোয়াল আর গরু দিয়ে হাল চাষ করে। জীবনে যান্ত্রিকতা নয়, আছে জীবিকার জন্য সংগ্রাম। এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ, সহজ-সরল। প্রান্তিক গ্রামগুলোতেও কৃষিভিত্তিক সমস্যাগুলো মাথায় নিয়ে আজও খুড়িয়ে চলছে গ্রামীণ কৃষক। গ্রামীণ সমাজের মূল নায়ক কৃষক। এই কৃষক শ্রেণির ভাষা, আচার, প্রথা, সংস্কার, জীবনযাপন প্রণালী, ধর্ম, পেশা প্রভৃতির সমন্বয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

গ্রামে কৃষক ছাড়াও আরো যেসব শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে তারাও মূলত কৃষি বা কৃষক সংশ্লিষ্ট গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে একাত্ম। গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিভিত্তিক পেশা জড়িয়ে আছে। গ্রামীণ অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, ক্ষমতা কাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ সব কিছুই কৃষির সাথে সম্পর্কিত। প্রতিটি গ্রামেই কৃষিভিত্তিক পেশা আর কৃষিপ্রধান জীবন ব্যবস্থা গ্রামীণ মানুষের জীবন আর জীবনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দুই প্রহরের রোদ, খালি মাথা আর খালি গা, খালি পায়ে এক হাঁটু কাদা সব মিলিয়ে আমাদের কৃষকের সংস্কৃতি। নুন লঙ্কা আর রাঙ্গা মোটা চালের ভাত কৃষক যখন নিজেই আহারের প্রয়োজনে ভক্ষণ করে তখনও ভাবনার ঝুড়ি মাথায় থাকে কীভাবে সুন্দর চালের ভাত তুলে দেয়া যাবে সমগ্র বাঙালির খাবারের থালায়। হয়তো জমিদার মহাজনের দৌরাত্ম্য এখন নেই, মহাজনী প্রথা হ্রাস পেয়েছে অনেক, তাই কৃষকের জীবনধারায় হয়তো আজ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

তবুও ক্ষমতা কাঠামো ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা, পরিবেশগত সমস্যাসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কাছে প্রতিনিয়ত হার মানতে হয় সত্যিকার কৃষক সমাজকেই। এমন নানা কারণে গ্রামীণ কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক পরিবার। ইদানীং কৃষিভিত্তিক পেশা ছেড়ে শিল্পভিত্তিক পেশার দিকে ঝুঁকছেন প্রান্তিক কৃষক পরিবারের তরুণ সদস্যরা। তারা কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে ছুটছেন শহরে। বাবা-দাদার সেই মাথাল আর হালের লাঙ্গল এখন ঘুণ আর উইপোকার দখলে।

কৃষিভিত্তিক পেশা থেকে সরে যাবার কারণ কী তা নিয়ে কথা হয়, বরগুনার ১০ নং নলটোনা ইউনিউয়নের বালিয়াতলি গ্রামের কৃষক মোসলেম হাওলাদারের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমার বড় পোলায় ঢাকার একটা গার্মেন্সে কাম (কাজ) করে। আগে আমার লগে (সাথে) ক্ষেত খামারে কাম করতো। তয় হ্যাতে (তাতে) যে টাহা রোজগার হইতো তা দিয়া সংসার চলে না। তাই আমিও বাধা দেইনায় শহরে যাইতে।’

বরগুনার একই এলাকার একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে উঠে আসে কৃষি বিপ্লবের কিছু প্রতিবন্ধকতা। তারা জানান, অধিকাংশ কৃষি জমির মালিক নিজে কৃষক নয়। অপরদিকে নদী ভাঙ্গন, খরা, বন্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নষ্ট হয় ফসল। এমন পরিস্থিতিতেও জমির মালিকগণ বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে চুক্তি অনুযায়ী কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেয় পাওনা। এমন সময়ে কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলো ধার দেনায় ডুবে যায়।

কৃষকরা বলছেন, ধানের দাম না পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে যদি প্রতি বছর চাষাবাদ শুরু করতে হয় তাহলে জমিতে কখনোই কৃষকের মন মজে না। যার ফলে কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতি বছর ফসলের দাম না পাওয়া নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রান্তিক পর্যায়ে ছুটে আসা কিংবা সংবাদ প্রকাশের পরেও কোনো সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করেন কৃষকসমাজ। ৬০ বছর বয়স্ক কৃষক বাবুল মৃধা বাবা-চাচাদের সাথে প্রথম কৃষি কাজ শুরু করেছিলেন ১৫ বছর বয়সে। তিনিও প্রতিনিয়ত আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষি কাজের উপর। তিনি বলেন, ধানের সময় ধানের দাম পাই না, সবজির আবাদ বেশি হলে সেবছর গরু-ছাগলকে সবজি খাওয়াতে হয়, বাজারে দাম নেই বলে। আবার আলুর ফলন উঠার সময়ে দাম হয় কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা। এমন হলে কৃষকরা কেন আবাদ করবে?

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন প্রান্তিক কৃষক। পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতে কিংবা কৃষিজাত ফসল কৃষকের ঘরে ওঠার আগেই কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ ও কৃষিবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ করে কৃষকরা। তবে সমাজ গবেষকরা বিষয়টি দেখছেন ভিন্নভাবে, তারা বলছেন সমাজিকভাবে ভালো থাকা ও গ্রামীণ মানুষের শহরমুখী বসবাসের প্রবণতা বৃদ্ধিও কৃষিতে প্রভাব ফেলছে।

এ বিষয়ে কথা হলে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিলাশ মল্লিক বলেন, দিনে দিনে মানুষের এই শিল্পের দিকে পা বাড়ানো কৃষির জন্য হুমকি হয়ে পড়েছে। সকলেই চায় উন্নত পারিবারিক অবস্থা। খুব কম মানুষই কষ্ট করে রোজগার করতে চায়। তাই দাড়িপাল্লায় শিল্পের দিকটাই ভারি হয়ে উঠছে। গ্রামীণ কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো ক্ষুদ্র হয়ে পড়ছে। গ্রামীণ পরিবেশে এসেছে পরিবর্তন। শহরের ছোঁয়া লেগেছে গ্রাম্য জীবনে। একটা সময় হয়তো দেখা যাবে কৃষি হয়ে যাবে শিল্পনির্ভর। তাই শহরের দিকে না ছুটে গ্রামে থেকেই জীবনমানের উন্নতির চেষ্টা করতে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

কৃষিতে আস্থা হারাচ্ছে কৃষক

আপডেট টাইম : ০৩:৩৭:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গ্রামীণ জীবনযাত্রার সর্বত্র যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে তা নয়। পাওয়ার টিলার আর উন্নত প্রযুক্তির যুগে এখনও প্রান্তিক কৃষক লাঙ্গল-জোয়াল আর গরু দিয়ে হাল চাষ করে। জীবনে যান্ত্রিকতা নয়, আছে জীবিকার জন্য সংগ্রাম। এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ, সহজ-সরল। প্রান্তিক গ্রামগুলোতেও কৃষিভিত্তিক সমস্যাগুলো মাথায় নিয়ে আজও খুড়িয়ে চলছে গ্রামীণ কৃষক। গ্রামীণ সমাজের মূল নায়ক কৃষক। এই কৃষক শ্রেণির ভাষা, আচার, প্রথা, সংস্কার, জীবনযাপন প্রণালী, ধর্ম, পেশা প্রভৃতির সমন্বয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

গ্রামে কৃষক ছাড়াও আরো যেসব শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে তারাও মূলত কৃষি বা কৃষক সংশ্লিষ্ট গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে একাত্ম। গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিভিত্তিক পেশা জড়িয়ে আছে। গ্রামীণ অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, ক্ষমতা কাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ সব কিছুই কৃষির সাথে সম্পর্কিত। প্রতিটি গ্রামেই কৃষিভিত্তিক পেশা আর কৃষিপ্রধান জীবন ব্যবস্থা গ্রামীণ মানুষের জীবন আর জীবনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দুই প্রহরের রোদ, খালি মাথা আর খালি গা, খালি পায়ে এক হাঁটু কাদা সব মিলিয়ে আমাদের কৃষকের সংস্কৃতি। নুন লঙ্কা আর রাঙ্গা মোটা চালের ভাত কৃষক যখন নিজেই আহারের প্রয়োজনে ভক্ষণ করে তখনও ভাবনার ঝুড়ি মাথায় থাকে কীভাবে সুন্দর চালের ভাত তুলে দেয়া যাবে সমগ্র বাঙালির খাবারের থালায়। হয়তো জমিদার মহাজনের দৌরাত্ম্য এখন নেই, মহাজনী প্রথা হ্রাস পেয়েছে অনেক, তাই কৃষকের জীবনধারায় হয়তো আজ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

তবুও ক্ষমতা কাঠামো ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা, পরিবেশগত সমস্যাসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কাছে প্রতিনিয়ত হার মানতে হয় সত্যিকার কৃষক সমাজকেই। এমন নানা কারণে গ্রামীণ কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক পরিবার। ইদানীং কৃষিভিত্তিক পেশা ছেড়ে শিল্পভিত্তিক পেশার দিকে ঝুঁকছেন প্রান্তিক কৃষক পরিবারের তরুণ সদস্যরা। তারা কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে ছুটছেন শহরে। বাবা-দাদার সেই মাথাল আর হালের লাঙ্গল এখন ঘুণ আর উইপোকার দখলে।

কৃষিভিত্তিক পেশা থেকে সরে যাবার কারণ কী তা নিয়ে কথা হয়, বরগুনার ১০ নং নলটোনা ইউনিউয়নের বালিয়াতলি গ্রামের কৃষক মোসলেম হাওলাদারের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমার বড় পোলায় ঢাকার একটা গার্মেন্সে কাম (কাজ) করে। আগে আমার লগে (সাথে) ক্ষেত খামারে কাম করতো। তয় হ্যাতে (তাতে) যে টাহা রোজগার হইতো তা দিয়া সংসার চলে না। তাই আমিও বাধা দেইনায় শহরে যাইতে।’

বরগুনার একই এলাকার একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে উঠে আসে কৃষি বিপ্লবের কিছু প্রতিবন্ধকতা। তারা জানান, অধিকাংশ কৃষি জমির মালিক নিজে কৃষক নয়। অপরদিকে নদী ভাঙ্গন, খরা, বন্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নষ্ট হয় ফসল। এমন পরিস্থিতিতেও জমির মালিকগণ বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে চুক্তি অনুযায়ী কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেয় পাওনা। এমন সময়ে কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলো ধার দেনায় ডুবে যায়।

কৃষকরা বলছেন, ধানের দাম না পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে যদি প্রতি বছর চাষাবাদ শুরু করতে হয় তাহলে জমিতে কখনোই কৃষকের মন মজে না। যার ফলে কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতি বছর ফসলের দাম না পাওয়া নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রান্তিক পর্যায়ে ছুটে আসা কিংবা সংবাদ প্রকাশের পরেও কোনো সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করেন কৃষকসমাজ। ৬০ বছর বয়স্ক কৃষক বাবুল মৃধা বাবা-চাচাদের সাথে প্রথম কৃষি কাজ শুরু করেছিলেন ১৫ বছর বয়সে। তিনিও প্রতিনিয়ত আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষি কাজের উপর। তিনি বলেন, ধানের সময় ধানের দাম পাই না, সবজির আবাদ বেশি হলে সেবছর গরু-ছাগলকে সবজি খাওয়াতে হয়, বাজারে দাম নেই বলে। আবার আলুর ফলন উঠার সময়ে দাম হয় কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা। এমন হলে কৃষকরা কেন আবাদ করবে?

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন প্রান্তিক কৃষক। পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতে কিংবা কৃষিজাত ফসল কৃষকের ঘরে ওঠার আগেই কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ ও কৃষিবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ করে কৃষকরা। তবে সমাজ গবেষকরা বিষয়টি দেখছেন ভিন্নভাবে, তারা বলছেন সমাজিকভাবে ভালো থাকা ও গ্রামীণ মানুষের শহরমুখী বসবাসের প্রবণতা বৃদ্ধিও কৃষিতে প্রভাব ফেলছে।

এ বিষয়ে কথা হলে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিলাশ মল্লিক বলেন, দিনে দিনে মানুষের এই শিল্পের দিকে পা বাড়ানো কৃষির জন্য হুমকি হয়ে পড়েছে। সকলেই চায় উন্নত পারিবারিক অবস্থা। খুব কম মানুষই কষ্ট করে রোজগার করতে চায়। তাই দাড়িপাল্লায় শিল্পের দিকটাই ভারি হয়ে উঠছে। গ্রামীণ কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো ক্ষুদ্র হয়ে পড়ছে। গ্রামীণ পরিবেশে এসেছে পরিবর্তন। শহরের ছোঁয়া লেগেছে গ্রাম্য জীবনে। একটা সময় হয়তো দেখা যাবে কৃষি হয়ে যাবে শিল্পনির্ভর। তাই শহরের দিকে না ছুটে গ্রামে থেকেই জীবনমানের উন্নতির চেষ্টা করতে হবে।