অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমঃ
ক্যামেরা বন্দি করে নিয়ে এসেছি, এই সেই আমার বাপ দাদার বসত ভিটা। বাবার মুখে শোনেছি দাদার দাদা আসাম থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছিলো।
চৌচালা একটি টিনের ঘরে আমরা ৫ ভাই বোনকে নিয়ে বাবা মা বসবাস করতেন। রান্না করার জন্য একটি আলাদা ঘর ছিলো। আখের পাতা ও বাঁশের চালা, বাশেঁর তরজার বেড়া দিয়ে নির্মান করা হয়েছিলো। গাই গরু রাখার জন্য আরো একটি ঘর ছিলো।সে ঘরে পার্টিশানের ওপারে একটি রুম ছিলো। অথিতি বা অপরিচিত কেউ আসলে বাবা সেখানে বসে গল্প করতেন। আমাদের এই ঘরগুলি ছিলো স্বল্পমারিয়া গ্রামে, মারিয়া ইউনিয়নে,কিশোরগঞ্জ সদর থানায। অর্থাৎ ভোটার আইডি কার্ড অনুযায়ী সেটাই আমাদের স্থায়ী ঠিকানা।
বসত ঘরের টানা লম্বা একটি বারান্দা ছিলো।বারান্দা পেরিয়ে একটি বড় রুমছিলো। রুমের এক পাশে কাঠের চকিতে ভাই, বোন,মা,বাবা, আমরা ৭ জন রাত্রি যাপন করতাম।অন্য পাশে মাটির তৈরী রড় রড় মঠকা সাজানো ছিলো।সে গুলোতে ধান, চাল বা অন্য কিছু শুকনা জাতীয় জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হতো।
ঘরের এক কর্ণারে ছিলো একটি পড়ার টেবিল। কূপির বাতির আলোতে সেদ্ধ হতো আমাদের পড়াশোনার জীবন। পেটে ভাত না থাকলেও লবন লংকার জীবনে, আমরা ভাই বোনেরা ছিলাম পড়া শোনার প্রতি প্রচন্ড আন্তরিক। বাবা মাও ছিলো খুব সর্তক,সর্বদা চোখে রাখতেন আমাদেরকে। বাবা গ্রাম্য প্যাচে জড়াতেন না।তাঁর সন্তানই ছিলো বড় সম্পদ।
আমাদের বাবা মোঃ ইমাম হোসেন ছিলেন স্বল্পমারিয়া সরকারি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। মা আমেনা বেগম পড়তে ও লিখতে পারতেন। পুতিঁ শুনাতেন খুব মধুর সুরে।আমাদের প্রিয় নবিজীর নাতি হাসান হোসেনের ফুরাত নদীর হৃদয় বিধারক কাহিনী শুনিয়ে মা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতেন। আমরা ভাই বোনেরা আগামাতা কিছু না বুঝলেও, মায়ের সাথে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিযে পরতাম টের পেতাম না।আহারে সেই দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেলো। গোসল করার জন্য ও কাপড় ধুয়ার কাজের প্রয়োজনে একটি পুকুর ছিলো। গাভির দুধ, পুকুরের মাছ, বাড়ীর আঙ্গিনার সাক সবজিই ছিলো আমাদের নিত্য দিনের খাবারের জোগান।খাবারের পানি সংগ্রহ করতে হতো প্রায় আধা মাইল দুরের টিউবয়েল থেকে।
মা ছিলেন হার্টের রোগী।তার অসুখের ব্যয়,ভাই বোনদের পড়ার খরচ মিট আপ করতে গিয়ে সর্ব শেষ চাষের জমিটুকোও বাবা বিক্রি করে দেন। একবারও ভাবেননি তাঁর জীবনের শেষ কাল কি ভাবে পার হবে।
আল্লাহ র রহমতে বড় ভাই এ কে এম আশরাফুল হক (বাবলু) বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চলে যান চাকুরী করতে তৈলের দেশ কুয়েতে। তখন থেকেই আমাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। বাবার সংসারের সকল দায়িত্ব তুলে নেন নিজের ঘাড়ে।
চার ভাই বোনেরপড়াশোনা,বিয়েসাদি, ঢাকায় বাড়ি করা( ১/এ নর্থ ধানমন্ডি,কলাবাগান,ঢাকা), নিজের সংসারের আয় উন্নতি অত্যান্ত দক্ষতার সাথেই পালন করছিলেন।
অতপর আরো সুখের খোঁজে চলে যান সুখের স্বর্গ রাজ্য বলে খ্যাত অমেরিকায়। সেই থেকেই ওখানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন।
আমরা বালিশ কম্বল নিয়ে ঢাকায় চলে আসার পর বাবার ঘরটির জায়গা হয় অন্যের বাড়িতে। বাপ দাদার ভিটে মাটি পরে থাকলেও এখন ঘর শুন্য বাড়িতে সাপ বিচ্চু করে বসবাস। ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে বাড়িতে যাই।চোখ ভিজিয়ে চলে আসি। আমার পায়ের চিহ্ন, বাবা,মার স্নেহ আদরের গন্ধ খোঁজে পাই না। তারপরও “মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে”।
বর্তমানে বড় ভাই -অমেরিকা,মেজো ভাই শিবলি সাদিক বকুল -কানাডায়,ছোট বোন বিলকিস সরকার নাহার অমেরিকায়,ছোট ভাই নোমান শাহীন, মুকুল ঢাকায়,আমি ঢাকায় আল্লাহ র রহমতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছি। বাবাকে ১৯৯০ সালে,মাকে ১৯৯৫ সালে হারিয়েছি। দুই জনকেই বনানি গোড়স্থানে দাফন করা হয়েছে। মা বাবা হারানোর পর সংসারের বন্ডিং ভেঙ্গে পরে।তখন অনুভব করতে পারি অহংকারের মা বাবা ছিলো কতো আপন প্রিয়।
অজ পাড়া গা থেকে ওঠে এসে বাবার অক্লান্ত চেষ্টা,বড় ভাইয়ের বধান্যতায়,মহান রবের দয়ায় আমরা নিজেদেরকে সৃষ্টির সুন্দর ফুলদানীতে সাজিয়েছি। আমাদের সন্তানরাও মেধাবী।তারা প্রতিষ্টার আরও উচ্চ আসনে জায়গা করে নিচ্ছে।এরপর কি হবে জানি না।
লেখকঃ কবি,গবেষক, অধ্যক্ষ,সাবেক সিনেট সদস্য,জাবি।