ঢাকা ০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোকোকে মা বললেন— নাম না থাকলে বসা যাবে না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১৬:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৮ বার

২৩ ডিসেম্বর ২০০২। তুষারে ঢাকা বেইজিং। তীব্র শীত আর কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ নিয়ে ঐতিহাসিক পিকিং ডাক রেস্টুরেন্টে হাজির হলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। কিছুক্ষণ আগে বেইজিংয়ে পৌঁছেছেন তিনি। ডায়োতাই স্টেট গেস্ট হাউজে উঠেছেন।

বেইজিংয়ের সন্ধ্যার যানজট পেরিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই নৈশভোজের দাওয়াতে পৌঁছে যান। আয়োজক চীনা কংগ্রেসের (পার্লামেন্টের) লেডি ভাইস চেয়ারম্যান তখনও এসে পৌঁছাননি। ডিনার রুমে ঢুকে হেড টেবিলে বসলেন বেগম খালেদা জিয়া। তার পেছনেই আসলেন ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। রুমে ঢুকেই সোজা বসতে গেলেন হেড টেবিলে ঠিক মায়ের সামনে। অমনি মা বলে উঠলেন, ‘দেখ দেখ তোর নাম আছে কি না? নাম না থাকলে কিন্তু এখানে বসা যাবে না।’ বলেই মুচকি হাসলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

আর সাথে সাথেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে প্রতিটি চেয়ারের সামনে লেখা নামগুলো পড়তে লাগলেন কোকো, খুঁজতে লাগলেন নিজের নাম। শুন্য হলে আমি বিস্ময়ভরে দেখছিলাম মা-ছেলের রসিকতা। মুগ্ধতা কাটলো ম্যাডাম যখন বললেন, দেখছো, আমরা আগে চলে আসছি। এখানে কোনও লোক নেই। বাংলাদেশে হলে এতক্ষণে কতো লোক হয়ে যেতো।

ঢাকায় খবর পাঠানোর তাড়া নিয়ে আমি হল থেকে বেরিয়ে এলাম। পথে পথে ভাবছিলাম মা-ছেলের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে, সেন্স অব হিউমার নিয়ে।

আরাফাত রহমান কোকোর সাথে প্রথম পরিচয় তাদের ঢাকা সেনানিবাসের বাড়িতে। সেদিন ইনকিলাবের রিপোর্টার হিসেবে আমি গিয়েছিলাম তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে। ঠিক সাক্ষাৎকার নয়, আসলে একটি ঘটনায় বেগম জিয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে। স্মৃতি যদি প্রবঞ্চনা না করে এটা ১৯৯৭ সালের কথা। বিরোধী দলের ডাকে টানা হরতাল চলছিল। সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রতিবাদে।

ওই হরতালে সন্ধ্যায় বাইরে থেকে বাড়ি ফিরছিলেন বড় ছেলে তারেক রহমান। সেনানিবাসের মূল রাস্তা থেকে শহীদ মইনুল রোডে ঢুকে সামান্য এগোলেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। মেইন রোড থেকে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে তারেক রহমান দেখলেন শহীদ মইনুল রোডের প্রবেশমুখে বসানো হচ্ছে বাঁশকল। এটা যান ও মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য দেয়া এক ধরনের ব্যারিকেড। বলা নেই, কওয়া নেই, বাড়ির সামনে বসানো হচ্ছে বাঁশকল। দেখে হতবাক তারেক রহমান! বাঁশকল লাগানোর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে এর কারণ জানতে চান তিনি। সংশ্লিষ্টরা কোনও সদুত্তর না দিয়ে জড়িয়ে পড়েন বিতর্কে। খবর শুনে বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে আসেন খালেদা জিয়া। তার বাড়ির প্রবেশ পথে তার অনুমতি বা ইচ্ছা ছাড়া বাঁশকল বসাতে বারণ করেন তিনি । শেষ পর্যন্ত পিছু হটে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা।

একে তো হরতাল, তার উপরে আবার ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের ঘটনা বলে পুরো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই খবরের সন্ধানে ‘সংবাদপত্র’ লেখা স্কুটারে চড়ে ছুটে গেলাম। বনানী সৈনিক ক্লাবের গেট থেকে একটু দূরে নেমে গেলাম। সৈনিক ক্লাবের গেট পেরিয়ে হেঁটে চললাম ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে। হেঁটেই পৌঁছতে হলো ১০ নম্বর শহীদ মইনুল রোডের বাড়ির গেটে। নিরাপত্তা কর্মীরা আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললাম তারেক রহমানের কাছে এসেছি। তারা বললেন, তিনি না আসলে তারা আমাকে ভেতরে যেতে দেবেন না। রিসেপশন থেকে ভেতরে ফোন করে খবর দেয়া হলো। একটু পরেই আসলেন তারেক রহমান। তার সাথে ভেতরে গেলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, কী ঘটনা ঘটেছে? বললেন, আম্মা কথা বলবেন। এ কথা বলে সামনের ছোট্ট বসার ঘরে নিয়ে আমাকে বসালেন। আর বললেন, আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। ততক্ষণে চা খেয়ে নিন। এই বলে ভেতরে গেলেন তিনি।

একটু পর ফিরলেন ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছোট ভাইকে বললেন, আমাকে একটু সময় দিতে। ততক্ষণে চা-নাস্তা এলো। অল্প-স্বল্প দু-চারটা কথা হলো কোকোর সঙ্গে। তার সঙ্গে সেদিনই প্রথম পরিচয়।

এখনও পরিষ্কার মনে পড়ে, ওই রাতে তারেক রহমানের চোখে-মুখে আমি উদ্বেগের ছাপ দেখেছি। কিন্তু আরাফাত রহমান কোকোর কথা-বার্তায় তারমধ্যে সামান্য উদ্বেগও দেখিনি। মনে হলো রাষ্ট্রচিন্তা-রাজনীতি ভাবনা থেকে তার অবস্থান অনেক দূরে। একেবারে সাদামাটা একজন উচ্ছল তরুণ। বাড়ির গেটে কী ঘটেছে তা নিয়ে এতটুকু চিন্তিত নন তিনি।

বছর কয়েক পরে আরেকবার তার সঙ্গে বসেছিলাম হাইকুর এক পাঁচতারা হোটেলের লবিতে, যা চীনের হাইনান প্রদেশের রাজধানী শহরে। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের একদল আড্ডা জমিয়েছিল সেখানে। লবির পাশে হোটেলের ফ্যাক্স রুম। ওখান থেকে ফ্যাক্সে ঢাকায় যুগান্তর অফিসে খবর পাঠিয়ে লবিতে আসতেই কেউ একজন ডেকে বসালেন তাদের আড্ডায়। পরিচয় করিয়ে দিলেন আরাফাত রহমান কোকোর সাথে। অত্যন্ত সজ্জন, বন্ধুবৎসল কোকোকে আবার কাছ থেকে দেখলাম। সামান্য বাক্যালাপেই তার আন্তরিকতার ছোয়া পেলাম।

বছর তিনেক পরে আরেকবার ক্ষণিকের জন্য দেখা হলো আরাফাত রহমানের সাথে। সাভারের অদূরে আশুলিয়ায় তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘খালেদা জিয়া ওল্ড হোম’ এর উদ্বোধনীতে। আবারও কোকোর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারেক রহমান। সামান্য হেসে কুশলাদি জানতে চাইলেন।

তারপর অনেকবার দেখা হয়েছে কোকোর সঙ্গে। তবে কোনও রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নয়। কখনও দেখেছি তার বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা দিতে। কখনও সিথি ভাবীকে নিয়ে মুভেনপিক বা ক্লাব জিলাটোতে। দেখা হলে সালাম দিলেই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলতেন, ভালো-মন্দ খোঁজখবর নিতেন।

তখন বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী পুত্রকে রাতের বেলায় কোনও ধরনের নিরাপত্তা ছাড়া গুলশান-বনানীতে দেখে নিরাপত্তা কর্মীরা উদ্বিগ্ন হয়ে যেতেন। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে আরাফাত রহমান কোকোর কোনও ভাবনাই ছিল না। তার জন্য বাড়তি নিরাপত্তা কিংবা নিরাপত্তা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার কথা বললে বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করতেন। বলতেন, ওগুলো লাগবে না। আমি নিজেই গাড়ি চালিয়ে চলে যাবো।

সম্ভবত কোকোর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল আজাদ মসজিদে ঈদের জামাতে। তারপর নিজ বাড়িতে বন্দিদশা, গ্রেফতার, নির্যাতন, কারাবরণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলেন ব্যাংককে চিকিৎসা নিতে। রাষ্ট্রক্ষমতা-রাজনীতির সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক না থাকলেও রিমান্ডের নামে নির্মম নির্যাতনের শিকার হলেন তিনি। ক্রিকেটপাগল সদা প্রাণোচ্ছল তরুণ কোকোকে ঠেলে দেয়া হলো গুরুতর অসুস্থতার দিকে। অ্যাম্বুলেন্সে করে অক্সিজেন মাস্ক পরা কোকোকে আদালতে নিতে দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। ক্রীড়ামোদী সুস্থসবল কোকোকে গ্রেফতার পরবর্তী নির্যাতনে হুইল চেয়ারে বসিয়ে আদালতে হাজির করতেও দেখেছে। আদালতের সিঁড়িতে এক হাত বুকে রেখে আরেক হাতে নিরাপত্তী রক্ষীদের ওপর ভর দিয়ে হেঁটে চলা প্রচন্ড যন্ত্রণায় কোঁকড়ানো কোকোর মুখ টেলিভিশন-সংবাদপত্রে দেখেছেন সকলে। দুঃখ পেলেও নির্যাতনকারীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা ছাড়া তীব্র প্রতিবাদের সুযোগ ছিল না সেই সময়।

বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে দেয়া হলো সাজা। বাতিল করা হলো প্যারোল। ততদিনে ফুরিয়ে যায় কোকোর পাসপোর্টের মেয়াদ। আশির দশকের শেষভাগে মেলবোর্নের মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে অ্যাকাউন্টিংয়ে গ্র্যাজুয়েশনের সুবাদে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে থাকার নাগরিকত্ব নেয়ার সুযোগ ছিল কোকোর। কিন্তু দেশের টানে মায়ের কাছে বাংলাদেশে ফিরে আসা আরাফাত রহমান কোকো গুরুতর অসুস্থতার সময়ে ব্যাংককের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হলেন। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তার পাসপোর্ট নবায়ন বা নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করতে রাজি হয়নি থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস। উল্টো বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয় । বাধ্য হয়ে গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে ব্যাংকক ছেড়ে যান তিনি।

এরপর একেবারে নীরবে-নিভৃতে নির্বাসিত জীবন কাটান কুয়ালালামপুরে। স্ত্রী আর দুই কন্যাকে নিয়ে কুয়ালালামপুরের জীবনে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না বলে শুনেছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা মালয়েশিয়ায় যথাযথ চিকিৎসা তিনি পেয়েছিলেন কি না তা নিয়েও কারও কারও মনে সংশয় রয়েছে। এসবের মাঝেই ২৪ জানুয়ারি ২০১৫-এ অকালে চলে গেলেন আরাফাত রহমান কোকো।

পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী বনানীর সেনা কবরস্থানে দাফনেরও সুযোগ দেয়া হলো না কোকোকে। এত জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচারের কারণে কি না জানি না, তবে কোকোর জানাযায় লাখো লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে তার প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়েছে।

লেখক: ব‍্যারিস্টার ও সাবেক প্রিন্সিপাল লেকচারার ইন পুলিশ এডুকেশন, অ‍্যাংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, ইউকে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

কোকোকে মা বললেন— নাম না থাকলে বসা যাবে না

আপডেট টাইম : ১২:১৬:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫

২৩ ডিসেম্বর ২০০২। তুষারে ঢাকা বেইজিং। তীব্র শীত আর কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ নিয়ে ঐতিহাসিক পিকিং ডাক রেস্টুরেন্টে হাজির হলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। কিছুক্ষণ আগে বেইজিংয়ে পৌঁছেছেন তিনি। ডায়োতাই স্টেট গেস্ট হাউজে উঠেছেন।

বেইজিংয়ের সন্ধ্যার যানজট পেরিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই নৈশভোজের দাওয়াতে পৌঁছে যান। আয়োজক চীনা কংগ্রেসের (পার্লামেন্টের) লেডি ভাইস চেয়ারম্যান তখনও এসে পৌঁছাননি। ডিনার রুমে ঢুকে হেড টেবিলে বসলেন বেগম খালেদা জিয়া। তার পেছনেই আসলেন ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। রুমে ঢুকেই সোজা বসতে গেলেন হেড টেবিলে ঠিক মায়ের সামনে। অমনি মা বলে উঠলেন, ‘দেখ দেখ তোর নাম আছে কি না? নাম না থাকলে কিন্তু এখানে বসা যাবে না।’ বলেই মুচকি হাসলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

আর সাথে সাথেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে প্রতিটি চেয়ারের সামনে লেখা নামগুলো পড়তে লাগলেন কোকো, খুঁজতে লাগলেন নিজের নাম। শুন্য হলে আমি বিস্ময়ভরে দেখছিলাম মা-ছেলের রসিকতা। মুগ্ধতা কাটলো ম্যাডাম যখন বললেন, দেখছো, আমরা আগে চলে আসছি। এখানে কোনও লোক নেই। বাংলাদেশে হলে এতক্ষণে কতো লোক হয়ে যেতো।

ঢাকায় খবর পাঠানোর তাড়া নিয়ে আমি হল থেকে বেরিয়ে এলাম। পথে পথে ভাবছিলাম মা-ছেলের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে, সেন্স অব হিউমার নিয়ে।

আরাফাত রহমান কোকোর সাথে প্রথম পরিচয় তাদের ঢাকা সেনানিবাসের বাড়িতে। সেদিন ইনকিলাবের রিপোর্টার হিসেবে আমি গিয়েছিলাম তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে। ঠিক সাক্ষাৎকার নয়, আসলে একটি ঘটনায় বেগম জিয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে। স্মৃতি যদি প্রবঞ্চনা না করে এটা ১৯৯৭ সালের কথা। বিরোধী দলের ডাকে টানা হরতাল চলছিল। সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রতিবাদে।

ওই হরতালে সন্ধ্যায় বাইরে থেকে বাড়ি ফিরছিলেন বড় ছেলে তারেক রহমান। সেনানিবাসের মূল রাস্তা থেকে শহীদ মইনুল রোডে ঢুকে সামান্য এগোলেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। মেইন রোড থেকে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে তারেক রহমান দেখলেন শহীদ মইনুল রোডের প্রবেশমুখে বসানো হচ্ছে বাঁশকল। এটা যান ও মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য দেয়া এক ধরনের ব্যারিকেড। বলা নেই, কওয়া নেই, বাড়ির সামনে বসানো হচ্ছে বাঁশকল। দেখে হতবাক তারেক রহমান! বাঁশকল লাগানোর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে এর কারণ জানতে চান তিনি। সংশ্লিষ্টরা কোনও সদুত্তর না দিয়ে জড়িয়ে পড়েন বিতর্কে। খবর শুনে বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে আসেন খালেদা জিয়া। তার বাড়ির প্রবেশ পথে তার অনুমতি বা ইচ্ছা ছাড়া বাঁশকল বসাতে বারণ করেন তিনি । শেষ পর্যন্ত পিছু হটে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা।

একে তো হরতাল, তার উপরে আবার ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের ঘটনা বলে পুরো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই খবরের সন্ধানে ‘সংবাদপত্র’ লেখা স্কুটারে চড়ে ছুটে গেলাম। বনানী সৈনিক ক্লাবের গেট থেকে একটু দূরে নেমে গেলাম। সৈনিক ক্লাবের গেট পেরিয়ে হেঁটে চললাম ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে। হেঁটেই পৌঁছতে হলো ১০ নম্বর শহীদ মইনুল রোডের বাড়ির গেটে। নিরাপত্তা কর্মীরা আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললাম তারেক রহমানের কাছে এসেছি। তারা বললেন, তিনি না আসলে তারা আমাকে ভেতরে যেতে দেবেন না। রিসেপশন থেকে ভেতরে ফোন করে খবর দেয়া হলো। একটু পরেই আসলেন তারেক রহমান। তার সাথে ভেতরে গেলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, কী ঘটনা ঘটেছে? বললেন, আম্মা কথা বলবেন। এ কথা বলে সামনের ছোট্ট বসার ঘরে নিয়ে আমাকে বসালেন। আর বললেন, আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। ততক্ষণে চা খেয়ে নিন। এই বলে ভেতরে গেলেন তিনি।

একটু পর ফিরলেন ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছোট ভাইকে বললেন, আমাকে একটু সময় দিতে। ততক্ষণে চা-নাস্তা এলো। অল্প-স্বল্প দু-চারটা কথা হলো কোকোর সঙ্গে। তার সঙ্গে সেদিনই প্রথম পরিচয়।

এখনও পরিষ্কার মনে পড়ে, ওই রাতে তারেক রহমানের চোখে-মুখে আমি উদ্বেগের ছাপ দেখেছি। কিন্তু আরাফাত রহমান কোকোর কথা-বার্তায় তারমধ্যে সামান্য উদ্বেগও দেখিনি। মনে হলো রাষ্ট্রচিন্তা-রাজনীতি ভাবনা থেকে তার অবস্থান অনেক দূরে। একেবারে সাদামাটা একজন উচ্ছল তরুণ। বাড়ির গেটে কী ঘটেছে তা নিয়ে এতটুকু চিন্তিত নন তিনি।

বছর কয়েক পরে আরেকবার তার সঙ্গে বসেছিলাম হাইকুর এক পাঁচতারা হোটেলের লবিতে, যা চীনের হাইনান প্রদেশের রাজধানী শহরে। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের একদল আড্ডা জমিয়েছিল সেখানে। লবির পাশে হোটেলের ফ্যাক্স রুম। ওখান থেকে ফ্যাক্সে ঢাকায় যুগান্তর অফিসে খবর পাঠিয়ে লবিতে আসতেই কেউ একজন ডেকে বসালেন তাদের আড্ডায়। পরিচয় করিয়ে দিলেন আরাফাত রহমান কোকোর সাথে। অত্যন্ত সজ্জন, বন্ধুবৎসল কোকোকে আবার কাছ থেকে দেখলাম। সামান্য বাক্যালাপেই তার আন্তরিকতার ছোয়া পেলাম।

বছর তিনেক পরে আরেকবার ক্ষণিকের জন্য দেখা হলো আরাফাত রহমানের সাথে। সাভারের অদূরে আশুলিয়ায় তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘খালেদা জিয়া ওল্ড হোম’ এর উদ্বোধনীতে। আবারও কোকোর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারেক রহমান। সামান্য হেসে কুশলাদি জানতে চাইলেন।

তারপর অনেকবার দেখা হয়েছে কোকোর সঙ্গে। তবে কোনও রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নয়। কখনও দেখেছি তার বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা দিতে। কখনও সিথি ভাবীকে নিয়ে মুভেনপিক বা ক্লাব জিলাটোতে। দেখা হলে সালাম দিলেই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলতেন, ভালো-মন্দ খোঁজখবর নিতেন।

তখন বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী পুত্রকে রাতের বেলায় কোনও ধরনের নিরাপত্তা ছাড়া গুলশান-বনানীতে দেখে নিরাপত্তা কর্মীরা উদ্বিগ্ন হয়ে যেতেন। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে আরাফাত রহমান কোকোর কোনও ভাবনাই ছিল না। তার জন্য বাড়তি নিরাপত্তা কিংবা নিরাপত্তা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার কথা বললে বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করতেন। বলতেন, ওগুলো লাগবে না। আমি নিজেই গাড়ি চালিয়ে চলে যাবো।

সম্ভবত কোকোর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল আজাদ মসজিদে ঈদের জামাতে। তারপর নিজ বাড়িতে বন্দিদশা, গ্রেফতার, নির্যাতন, কারাবরণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলেন ব্যাংককে চিকিৎসা নিতে। রাষ্ট্রক্ষমতা-রাজনীতির সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক না থাকলেও রিমান্ডের নামে নির্মম নির্যাতনের শিকার হলেন তিনি। ক্রিকেটপাগল সদা প্রাণোচ্ছল তরুণ কোকোকে ঠেলে দেয়া হলো গুরুতর অসুস্থতার দিকে। অ্যাম্বুলেন্সে করে অক্সিজেন মাস্ক পরা কোকোকে আদালতে নিতে দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। ক্রীড়ামোদী সুস্থসবল কোকোকে গ্রেফতার পরবর্তী নির্যাতনে হুইল চেয়ারে বসিয়ে আদালতে হাজির করতেও দেখেছে। আদালতের সিঁড়িতে এক হাত বুকে রেখে আরেক হাতে নিরাপত্তী রক্ষীদের ওপর ভর দিয়ে হেঁটে চলা প্রচন্ড যন্ত্রণায় কোঁকড়ানো কোকোর মুখ টেলিভিশন-সংবাদপত্রে দেখেছেন সকলে। দুঃখ পেলেও নির্যাতনকারীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা ছাড়া তীব্র প্রতিবাদের সুযোগ ছিল না সেই সময়।

বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে দেয়া হলো সাজা। বাতিল করা হলো প্যারোল। ততদিনে ফুরিয়ে যায় কোকোর পাসপোর্টের মেয়াদ। আশির দশকের শেষভাগে মেলবোর্নের মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে অ্যাকাউন্টিংয়ে গ্র্যাজুয়েশনের সুবাদে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে থাকার নাগরিকত্ব নেয়ার সুযোগ ছিল কোকোর। কিন্তু দেশের টানে মায়ের কাছে বাংলাদেশে ফিরে আসা আরাফাত রহমান কোকো গুরুতর অসুস্থতার সময়ে ব্যাংককের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হলেন। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তার পাসপোর্ট নবায়ন বা নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করতে রাজি হয়নি থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস। উল্টো বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয় । বাধ্য হয়ে গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে ব্যাংকক ছেড়ে যান তিনি।

এরপর একেবারে নীরবে-নিভৃতে নির্বাসিত জীবন কাটান কুয়ালালামপুরে। স্ত্রী আর দুই কন্যাকে নিয়ে কুয়ালালামপুরের জীবনে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না বলে শুনেছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা মালয়েশিয়ায় যথাযথ চিকিৎসা তিনি পেয়েছিলেন কি না তা নিয়েও কারও কারও মনে সংশয় রয়েছে। এসবের মাঝেই ২৪ জানুয়ারি ২০১৫-এ অকালে চলে গেলেন আরাফাত রহমান কোকো।

পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী বনানীর সেনা কবরস্থানে দাফনেরও সুযোগ দেয়া হলো না কোকোকে। এত জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচারের কারণে কি না জানি না, তবে কোকোর জানাযায় লাখো লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে তার প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়েছে।

লেখক: ব‍্যারিস্টার ও সাবেক প্রিন্সিপাল লেকচারার ইন পুলিশ এডুকেশন, অ‍্যাংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, ইউকে।