হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রাচীন কবি দ্বিজবংশী ভট্টাচার্যের জন্মস্থান পাতুয়াইর গ্রামে যা কিশোরগঞ্জ জেলা শহর হতে পাঁচ মাইল উত্তরে নীলগঞ্জ রেল স্টেশনের পূর্ব পাশে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত। দ্বিজবংশীকৃত সুবৃহৎ পদ্মাপুরাণ আজও বৃহত্তর ময়মনসিংহে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের গীত হয়। তিনি একজন সুগায়কও ছিলেন এবং দলবল নিয়ে তাঁর করুন সুললিত মনসার ভাসান বা বেছলার গান গেয়ে ঘুরে ঘুরে লোকশিক্ষার সাহায্য করিতেন। কথিত আছে, একবার তিনি এক ভীষন নরঘাতক দস্যুর কবলে পড়লে দস্যু তাঁর গান শুনে নিজবৃত্তি ত্যাগ করে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে। আজও বহু লোক তাঁর পদ্মাপুরাণ গাহিয়া জীবিকা উপার্জন করেন। ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে দ্বিজবংশী ছিলেন অন্যতম। তিনি নিজগৃহে একটি টোল পরিচালনা করতেন।
রামায়ন,দস্যু কেনারামের উপাখ্যান, দেওয়ান ভাবনা, মসূয়া প্রভৃতি গ্রন্থ রচিয়িত্রী বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী কবি দ্বিজবংশীর কন্যা। কবি চন্দ্রাবতী ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সেই টোলে চন্দ্রাবতী সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন জয়ানন্দকে। দু’জনে একসঙ্গে লেখাপড়া করতেন, মন্দিরে পুজোর জন্য ফুল তুলতেন আর দ্বিজবংশীর মুখে কাব্য শুনতেন। ক্রমে দু’জনেই বড় হলেন, একে অপরকে ভালবাসলেন।
চন্দ্রাবতী কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ ও গুণের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু চন্দ্রার মন বাঁধা রয়েছে সহপাঠী ব্রাহ্মণ যুবক জয়ানন্দের কাছে। বাল্যসাথীকে চিরসাথী হিসেবে পাওয়ার বাসনা একে অপরের নিকট ব্যক্ত করলেন। জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর পিতার নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে দ্বিজবংশী দাশ আনন্দে এ প্রস্তাবে রাজি হলেন। কোষ্ঠী বিচার করে বিবাহের দিনক্ষণ পর্যন্ত ধার্য হলো। চন্দ্রাবতী আনন্দে গেয়ে ওঠে, ‘বাড়ির আগে ফুইটা রইছে মল্লিকা মালতী, জন্মে জন্মে পাই যেন তোমাকেই পতি।’
কিন্তু এর মধ্যে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। জয়ানন্দ ছিল দুর্বল চরিত্রের লোক। জলের ঘাটে কাজীর মেয়েকে দেখে তাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে চিঠি লেখে। অবশেষে জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে সেই মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে। এ খবর শুনে চন্দ্রাবতী শোকে একেবারে ভেঙে পড়ে, ‘না কান্দে না হাসে চন্দ্রা, নাহি বলে বাণী/আছিলো সুন্দর কন্যা হইলো পাষাণী।’ কন্যার এই অবস্থা দেখে দ্বিজ বংশী দাশ বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি আবার মেয়ের বিয়ে ঠিক করতে চান। কিন্তু চন্দ্রাবতী পিতার কাছে আজীবন কুমারী থাকার বাসনা ব্যক্ত করেন এবং একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার অনুরোধ জানান, যেখানে তিনি শিবের উপাসনায় জীবন কাটাবেন। তার কথামতো দ্বিজবংশী দাশ মেয়ের জন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। কবি চন্দ্রাবতী প্রেমাস্পদ জয়ানন্দের বিচ্ছেদজ্বালা ভোলার জন্য ফুলেশ্বরী নদী তীরের সেই মন্দিরে শিবের ‘আরাধনা’য় মগ্ন হন এবং সেই সঙ্গে কাব্যচর্চায় মন দেন।
বাবার আদেশে কবিতায় রামায়ণের কাহিনী রচনা করতে জীবন উৎসর্গ করলেন। তিনি যখন রামায়ণ রচনায় মগ্ন, তখন একদিন জয়ানন্দ নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে চন্দ্রাবতীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য দর্শনপ্রার্থী হয়। অনেক দিন পর চন্দ্রাবতীর মন্দিরে দেখা দিল জয়ানন্দ। কিন্তু চন্দ্রাবতী তাকে মন্দিরের দরজা থেকে ফিরিয়ে দেন। এমনকি দর্শন পর্যন্ত দেননি জয়ানন্দকে। চন্দ্রাবতীর দর্শনলাভে ব্যর্থ হয়ে অভিমানী জয়ানন্দ মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে সন্ধ্যামালতী ফুল কুড়িয়ে ফুলের রসে মন্দিরের কপাটে চিরদিনের মতো বিদায় প্রার্থনা করে এক পত্র লেখে-
‘দ্বার খোল দ্বার খোল চন্দ্রা তোমায় একবার দেইখ্যা যাই/অভাগা জয়ানন্দ ডাকি আমি শেষ বিদায় চাই।’ চন্দ্রাবতী দ্বার খোলে না। দুঃখ, বেদনা আর অনুশোচনায় জয়ানন্দ ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।
এদিকে পুজো শেষে মন্দিরের কপাটের লেখার ওপর চন্দ্রার চোখ পড়ে-
দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দাও আমারে॥
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থ্যাকা খাড়া।
ইহ জন্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া॥
দেব পূজার ফুল তুমি গঙ্গার পানি।
আমি যদি ছুঁই কন্যা হইবা পাতকিনী॥
নয়ন ভরে দেখ্যা যাই জন্মশোধ দেখা।
শৈশবের নয়ন দেখি নয়ন ভঙ্গি বাঁকা॥
এই ঘটনার কয়েক দিন পর চন্দ্রাবতীও ফুলেশ্বরীর জলে বিসর্জন দিয়ে জয়ানন্দের অনুগামিনী হন!!
‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ‘জয়-চন্দ্রাবতী’ উপাখ্যানের নায়িকারূপে তিনি অমর হয়ে আছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দীনেশ চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মৈমনসিংহ গীতিকা। এতে ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলে প্রচলিত এবং চন্দ্রকুমার দে কর্তৃক সংগৃহীত দশটি লোকগীতিকা স্থান পায়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে গীতিকাগুলো গুণীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এগুলো এক অমূল্য আবিষ্কার হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং স্বীকৃতি লাভ করে। দীনেশ চন্দ্র সেন এর ইংরেজী অনুবাদ করেন। তাঁর ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হলে রোঁমারোঁলাসহ অনেক মনীষী এর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। চন্দ্রাবতীর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা ‘রামায়ণ কথা’ অসমাপ্তই থেকে যায়। এরপর দীনেশ চন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর রামায়ণও প্রকাশ করেন এবং আরও গীতিকা সংগ্রহের সন্ধানে মনোনিবেশ করেন। এবার চন্দ্রকুমার দে’র সঙ্গে সংগ্রহকাজে যোগ দেন কবি জসীমউদ্দীন ও আশুতোষ চৌধুরী। এভাবে আরও পঁয়তাল্লিশটি রচনা সংগৃহীত হয়। এগুলো দীনেশ চন্দ্রের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদালয় থেকে ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ নামে প্রকাশিত হয়।
পরে পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ, রওশন ইজদানী ও ক্ষিতীশ মৌলিকের মতো সাহিত্যপ্রেমী এসব লোকগীতিকার নানান ভাষ্য সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে কলকাতা ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। এসব গীতিকায় ফুটে উঠেছে বাংলা মৌলিক সাহিত্যের এক অকৃত্রিম নিদর্শন। এতে গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা তাদের নিজস্ব জবানীতে প্রতিফলিত হয়েছে।
পূর্ববঙ্গ গীতিকার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর ধর্মনিরপেক্ষতা। কোন বিশেষ ধর্মের মতের প্রতিফলন এতে ঘটেনি। শুধু তাই নয়, বরং নর-নারীর যে প্রণয়াবেগ, ধর্মবন্ধন ও সামাজিক শাসন অস্বীকার করে, এসব গীতিকায় সেই প্রণয়াবেগেরই স্তুতি করা হয়েছে। প্রেমই গীতিকাগুলোর প্রধান উপজীব্য এবং সাধারণত সে প্রেম বিয়োগান্ত। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রণয়কাহিনী ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করেছে সত্য, কিন্তু এর অন্তরালবর্তী আবেগের রয়েছে মৌলিক ঐক্য।
আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, গীতিকাগুলোতে রয়েছে নারীর এক বিশেষ স্থান ও মর্যাদা। যে প্রেমনিষ্ঠা পুরুষ চরিত্রে সর্বত্র দেখা যায় না, সেই প্রেমনিষ্ঠাই নারী চরিত্রকে করেছে মোহনীয়। বিবাহপূর্ব প্রেম কিংবা বিবাহিতা জীবনের প্রেম জীবনের উভয় ক্ষেত্রেই এই নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়। এই নিষ্ঠা গীতিকার নারী চরিত্রকে দীপ্ত করেছে, স্বাধীন বিকাশ ঘটিয়েছে ব্যক্তিত্বের।
কিশোরগঞ্জ জেলার শ্যামল প্রকৃতির বুকে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর মন্দির, বসতভিটা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা কবি, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে মুখরিত হয় বাংলা সাহিত্যের আদি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর মন্দির প্রাঙ্গণ।