পুঁজিবাজারে লোকসানি কোম্পানির জয়জয়কার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সাত বছর ধরে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কে অ্যান্ড কিউ কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ, ফলে টানা লোকসানে প্রতিষ্ঠানটি। আর পুঞ্জিভূত লোকসানের কারণে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য কমে এখন ঋণাত্মক ১১ টাকার বেশি দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এখন প্রত্যেক শেয়ারদাতা শেয়ার প্রতি এই পরিমাণ টাকা দিলেই কোম্পানির দায় থাকবে না।

কিন্তু এর শেয়ারপ্রতি দর দেখে উপায় নেই যে প্রতিষ্ঠানটির এই দশা। গতকাল এই কোম্পানির প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১২৪ টাকা ২৬ পয়সা দরে। এর চেয়ে বাজে আর্থিক পরিস্থিতি খাদ্য খাতের দুই প্রতিষ্ঠান জিল বাংলা সুগার মিল ও শ্যামপুর সুগার মিলের। জিলবাংলার ১০ টাকার শেয়ারে দায় এখন ৪১৮ টাকা। আর গত বছর শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৫৪ টাকা ৯ পয়সা। এই রকম একটি কোম্পানির শেয়ার বুধবার বিক্রি হয়েছে ৫৮ টাকা ৩০ পয়সা দরে।

শেয়ারবাজারে যেসব কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দিতে পারে না বা যেগুলোর উৎপাদন বন্ধ, সেগুলোকে ‘জেড’ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠান বলে। বর্তমানে বাজারে এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ৪৫টি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে।

লোকসানি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে পুঁজিবাজারের এই ধরনের  (জেড গ্রুপ) প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনলে বা বিক্রি করলে সেগুলো ম্যাচুরড হতে নয় কার্যদিবস সময় লাগে। অর্থাৎ নয় কার্যদিবস পরে বিক্রি করা যাবে এবং এসব শেয়ার বিক্রির নয় কার্যদিবস পরে এই টাকা দিয়ে অন্য শেয়ার কেনা যাবে বা টাকা তুলে নেয়া যাবে। তবে যেসব কোম্পানি লভ্যাংশ দেয় সেগুলো বিক্রি করে সঙ্গে সঙ্গেই অন্য কোম্পানির শেয়ার কেনা যায় বা তৃতীয় দিনে টাকা তুলে নেয়া যায়।

কিন্তু বাজার দেখে উপায় নেই যে লোকসানি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে আগ্রহ কম। বরং যেসব কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দেয়, যেগুলো নিয়মিত হিসাব প্রকাশ করে শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করে সেগুলোর তুলনায় এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের মূল্য অনেকাংশেই বেশি।

কতটা বেশি ? লভ্যাংশ না দেয়ার ইতিহাস থাকলেও সভার রিফ্রাকটরিজ এর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে এখন দাঁড়িয়েছে ১৪২ টাকা ৮০ পয়সায়। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ আছে মাত্র পাঁচ টাকা ৯০ পয়সা টাকা। আর গত বছর শেয়ার প্রতি কোম্পানির লোকসান হয়েছে ১৭ পয়সা।

গত বছর শেয়ার প্রতি ৬৫ টাকা ৭৫ পয়সা লোকসান দেয়া এবং শেয়ারপ্রতি ৬৫৯ টাকা ৭৭ পয়সা দায় থাকা শ্যামপুর সুগার মিলের শেয়ার মূল্য এখন ২৬ টাকা ৬০ পয়সা।

শেয়ার প্রতি ২৯ টাকা ৭৭ পয়সা দায় থাকা এবং গত এক দশকে লভ্যাংশ না দেয়া বস্ত্র খাতের দুলামিয়া কটনের শেয়ারের দাম গত ২৯ অক্টোবর ১৪ টাকার ঘরে থাকলেও সেটি বেড়ে এখন ২০ টাকা ৬০ পয়সা।

এভাবে শেয়ারবাজারে যেসব লোকসানি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হচ্ছে, তার মধ্যে আছে খাদ্য খাতের উৎপাদন বন্ধ রহিমা ফুড (সর্বশেষ দাম ১৭৬ টাকা ১০ পয়সা),  সিরামিক খাতের স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক (সর্বশেষ দর ১০১ টাকা ২০ পয়সা), কাগজ খাতের হাক্কানি পাল্প (সর্বশেষ দাম ৪৯ টাকা), চামড়া খাতের সমতা লেদার (সর্বশেষ দাম ৫১ টাকা), পাট খাতের জুট স্পিনার্স (সর্বশেষ মূল্য ৯৩ টাকা ৬০ পয়সা) প্রভৃতি।

এসব শেয়ারের মধ্যে জুট স্পিনার্স গত অর্থবছরে ১০ টাকার শেয়ার প্রতি লোকসান দিয়েছে ৪৯ টাকারও বেশি। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দায় দাঁড়িয়েছে ২০০ টাকা। কিন্তু এমন একটি কোম্পানির শেয়ার দর সর্বশেষ কার্যদিবসে বেড়েছে ৯.৮৮ শতাংশ। একদিকে যত পরিমাণ বাড়া সম্ভব ততটাই বেড়েছে এই দর। যে খবরে এই দর বেড়েছে, সেটা হলো চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৪.০৫ টাকা, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ১০ টাকা ১৭ পয়সা।

টানা লোকসানে থাকা ওষুধ ও রসায়ন খাতের ইমামবাটন সবশেষ অর্থবছরে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। গত ২৩ অক্টোবর শেয়ারের দাম ২১ টাকার কম ছিল। কিন্তু সেটি সবশেষ কার্যদিবস শুক্রবারে বিক্রি হয়েছে ৩৬ টাকা ৭০ পয়সায়।

লোকসানি সভার রিফ্রাকটরিজের শেয়ারদর গত ৩০ অক্টোবরেও ছিল ৮০ টাকা। সেটি সবশেষ কার্যদিবস গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৪২ টাকা ৮০ পয়সা দরে।  পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোম্পানিটির সচিব সাংবাদিকদেরকে বলেছেন, তাদের আশঙ্কা তাদের শেয়ারের দর নিয়ে কারসাজি হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়।

তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কখনো মুনাফা না দেয়া এবং পুঞ্জিভূত লোকসান বিপুল অংকের হওয়ার পরও খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক ও মেঘনা পেটের দামও গত কয়েক মাসে বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।

কিছু কিছু কোম্পানি আবার অল্প বিস্তর মুনাফা করছে, কিন্তু দাম আকাশ ছোঁয়া। বস্ত্র খাতের মডার্ন ডায়িংয়ের উৎপাদন বন্ধ বহু বছর। তবে কোম্পানির ভবন ভাড়া দিয়ে তারা অল্পবিস্তর মুনাফা করছে। সবশেষ অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে এক টাকা ৩৫ পয়সা, শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে চার টাকা ৭৪ পয়সা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১১ টাকা ৯৮ টয়সা। অর্থাৎ এক বছরে শেয়ারপ্রতি সম্পদ কমেছে সাত টাকার বেশি। কিন্তু এমন প্রতিষ্ঠানের ১০ টাকার শেয়ারের দাম এখন ২০০ টাকা। অথচ উৎপাদনে থাকা, সবশেষ অর্থবছরে দুই টাকা ৫২ পয়সা আয় করা এবং শেয়ারপ্রতি ২৩ টাকা ৭৩ পয়সা সম্পদমূল্য থাকা সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার মূল্য মডার্ন ডায়িংয়ে আট ভাগের এক ভাগেরও কম। সবশেষ কার্যদিবস শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দাম দাঁড়িয়েছে ২৬ টাকা ৮০ পয়সা।

একইভাবে কয়েক বছর লোকসানে থাকার পর অল্পস্বল্প মুনাফা করা প্রকৌশল খাতের বিডিঅটোকারের শেয়ার প্রতি মূল্য এখন ১০১ টাকা। গত অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি মুনাফা হয়েছে ৯৫ পয়সা, আর শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে দুই টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ এই খাতের প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য আফতাব অটোর শেয়ার প্রতি দাম এখন ৬৪ টাকা ৪০ পয়সা। যদিও সবশেষ অর্থবছরে এই কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে বিডিঅটোকারের চার গুণেরও বেশি (চার টাকা ১২ পয়সা) আর এর সম্পদমূল্য বিডি অটোকারের প্রায় ২০ গুণ বেশি, ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা।

একইভাবে প্রকৌশল খাতের স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিলের শেয়ার দাম ৮০ টাকার কম হলেও দুর্বল কোম্পানি হিসেবে পরিচিত আজিজ পাইপের দাম ১২০ টাকা।

আবার জ্বালানি খাতের সরকারি প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম গত অর্থবছরে শেয়ার প্রতি ২০ টাকা ২৮ পয়সা আয় করে মুনাফা ঘোষণা করেছে ১১ টাকা করে। এই কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য ৯১ টাকা ৩৫ পয়সা। এর সবশেষ দাম ১৯৪ টাকা। একই খাতের সিভিও পেট্রো ক্যামিকেল দুই শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে, যদিও তাদের শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে তিন টাকা ৪২ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ৫৭ পয়সা। অথচ এর দাম মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কাছাকাছি, ১৮৮ টাকা ৮০ পয়সা। তখনও তখনও তার মেঘনা পেট্রোলিয়ামের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায়।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারসাজি করে, গুজব ছড়িয়ে বা কয়েকজন ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে যোগসাজস করে নানা সময় এসব দুর্বল মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায়। আর প্রলোভনে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে দীর্ঘ লোকসানে পড়েন।

এসব কারসাজির বিরুদ্ধে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কোনো কোম্পানির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে বিএসইসি কোম্পানিকে নোটিশ করে এবং কোম্পানিগুলো গতানুগতির জবাব দিয়ে জানায়, তাদের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে অপ্রকাশিক কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

পুঁজিবাজার বিশ্লেসকরা বরাবর বিনিয়োগকারীদেরকে এই ধরনের শেয়ার না কিনতে পরামর্শ দেন। কিন্তু তাদের কথা গুরুত্ব পায়, সেটি পুঁজিবাজারের লেনদেন দেখলে কেউ বলবে না।

দুর্বল মৌলভিত্তির এসব শেয়ারের দাম সহজে বাড়ানোর কারণ এগুলোর শেয়ার সংখ্যা। স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা নিতান্তই কম। এ কারণে অল্প কয়েকজন বিনিয়োগকারীর পক্ষেই কারসাজি করা সম্ভব। গত কয়েক মাস ধরে স্বল্প মূলধনের এসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে আলাদা ব্যবস্থা করার আলোচনা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি।

২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের সাত বছর পর চলতি ২০১৭ সালে আবারও বাজার চাঙ্গা। এই অবস্থায় আবারও দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ারের দর কারসাজি করে বাড়ানো হচ্ছে। এসবে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে বাজারে আবারও অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বেশ কিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে। এতে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি বাড়ছে। এসব কোম্পানি থেকে বিনিয়োগকারীদের খুবই সতর্ক হতে হবে।’

‘আবার বিনিয়োগকারীদেরও নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝে বিনিয়োগ করা উচিত। কারণ গুজবে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। কারণ গুজব থাকলেও সেটি খোঁজ-খবর নিয়ে বিনিয়োগে আসা দরকার।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর