রানী ক্লোড ফল এবং বিষণ্ণ ইতিহাস

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পশ্চিম ইউরোপে সেপ্টেম্বরের শুরুতেই বাজারে হরেক রকম ফলের সঙ্গে সবুজ অথবা খানিকটা হলুদাভ একটি ফল, খুব টসটসে এবং মিষ্টি, এক ধরনের আলুবোখারার আবির্ভাব ঘটে। ফরাসিরা নাম দিয়েছে রেন ক্লোড, বাংলায় নাম দেওয়া যেতে পারে রানী ক্লোড, ইংরেজরা বলে গ্রিনগেজ। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন Prunus domestica। তা যে নামেই ডাকা হোক, স্বাদ কিন্তু একই। নামকরণের আবার একটু ইতিহাস আছে। ষোড়শ শতাব্দীতে উদ্ভিদবিজ্ঞানী পিয়ার বেলন প্রথম এ ফলের গাছটি শনাক্ত করেন।

তিনি তৎকালীন রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়ার স্ত্রী, রাজমহিষীর নামানুসারে এটির নামকরণ করেন। আসলে কোষ্ঠী ঘাঁটলে দেখা যায়, এ ফলের আদি নিবাস সেই ইরানে। যতদূর জানা যায়, ১৭২৪ সালে স্যার উইলিয়াম গেজ প্রথম ফ্রান্স থেকে এই ফল ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। পরে ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে রানী কোল্ডের চাষ করা হয়েছিল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ও টমাস জেফারসন এই ফল খুব পছন্দ করে নিজের বাড়ির বাগানে চাষ করেছিলেন।

দেখতে গোলাকার, প্রতিটি ফলের ওজন ৩০-৪০ গ্রাম হয়ে থাকে। উৎসাহীরা এ ফলের রস ঘন করে নানাভাবে, নানা খাবারে ব্যবহার করে। জ্যাম, জেলি তো আছেই, নানা রকম মুখরোচক পিঠাপুলির কথা আজ না হয় উহ্যই থাকল।

তবে যখনই এমন রসে টইটম্বুর মিষ্টি ফলটি হাতে নিই তখনই সেই বয়সে নবীন রানীর কথা মনে পড়ে। মনটা বিষণ্ণ হয়। কারণ যিনি এই চমৎকার ফলটির নামের মধ্যে আজও বেঁচে আছেন সেই রাজমহিষীর খানিকটা করুণ ইতিহাস আছে। আজ থেকে প্রায় ৫২১ বছর আগে অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর ১৪৯৯ রানী ক্লোড জন্ম নিয়েছিলেন।

নাম ক্লোড, ফরাসিরা অনেকটা স্নেহ করে নাম দিয়েছিল ‘ফ্রান্সের ক্লোড’। তিনি ছিলেন ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়ার (১৪৯৪-১৫৪৭) প্রথম স্ত্রী। এই ফরাসি রাজমহিষীর জীবনে এসেছিল মাত্র ২৪টি বসন্ত, নিতান্তই তরুণ বয়সে দেহত্যাগ করেছিলেন। প্রথম সন্তানের মা হন মাত্র সাড়ে পনেরো বছর বয়সে। তারপর আর বিরতি না দিয়ে প্রায় প্রতি বছরই সন্তান প্রসব করেছেন। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে অতটুকু বয়সেই পৃথিবীকে উপহার দিয়ে গেছেন মোট সাতটি সন্তান।

ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া শিল্পকলা, সাহিত্যের কদর করতেন খুব। তিনি ইতালীয় রেনেসাঁ শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজদরবারে মর্যাদার আসনটি দিয়েছিলেন। জোকোন্ডোর রূপসী স্ত্রী লিসার যে রহস্যময় হাসির অবয়ব এঁকেছিলেন শিল্পী লিওনার্দো, তা তিনি ফ্রান্সের রাজাকে উপহার দিয়েছিলেন।

প্রথম ফ্রাঁসোয়া ছিলেন একজন দাপুটে রাজা। দুর্দণ্ড প্রতাপে রাজ্য শাসন করতেন। তিনিই প্রথম রাজ্যজুড়ে আইন করে সব আঞ্চলিক ভাষা নিষিদ্ধ করে সেই ১৫৩৯ সাল থেকে ফরাসি ভাষাকে ফ্রান্সের দাপ্তরিক অর্থাৎ সরকারি ভাষা ঘোষণা করেন।

তিনি কঠোরভাবে এ আইন প্রয়োগ করছিলেন এবং শ্রুতি আছে, যারা তার এ আইনের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের কারও কারও জিহ্বা কর্তনের মতো নির্মম কাজটি করতেও রাজার অনুচররা দ্বিধা করেনি। ফরাসিরা তাদের মুখের ভেতরে লুকিয়ে থাকা রসনা আস্বাদনের মোক্ষম অঙ্গ জিহ্বা হারানোর ভয়ে ফরাসি ভাষায় তাদের জবান খুলে দেন। আজ ফরাসি ভাষা বিশ্বে পঞ্চম স্থান দখল করে আছে। সে আরেক ইতিহাস।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর