হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। প্রতিবছর এ দিনটির জন্য মুখিয়ে থাকেন প্রায় সব বাঙালি। বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকেন না কেন এ দিনটিতে ষোলআনা বাঙালিয়ানায় উদ্ভাসিত হতে লাল-সাদায় রাঙিয়ে তোলেন নিজেকে। আর সঙ্গে পান্তা ও ইলিশ মাছের স্বাদ চেখে নেয়ার বিষয়টি তো রয়েছেই। তবে এপার বাংলা ও ওপার বাংলাতেই যেন নিহিত পহেলা বৈশাখের সব জাকজমকতা! বাংলাদেশে তো এ দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বিভিন্ন মেলার কথা না বললেই নয়। অন্যদিকে, ওপার বাংলাতেও যেন হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড! সেখানেও পূজা-পার্বণসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলার মাধ্যমে বরণ করা হয় বাংলা মাসের প্রথম দিনটিকে। এছাড়া, দুই বাংলার ব্যবসায়ীরা ‘হালখাতা’র মাধ্যমে পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন। বর্ষবরণে দুই বাংলার এসব রীতিনীতিতে বেশ মিল থাকলেও দুটি ভিন্ন দিনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল এবং পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল। কেন এই বিভাজন? জেনে নিন দুই বাংলার বর্ষবরণের দিনক্ষণ বিভাজনের আদ্যোপান্ত-
এ বিষয়ে ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক ফরহাদ খান বলেন, অবিভক্ত বঙ্গদেশে নবদ্বীপের প-িত স্মার্ত রঘুনন্দন বাংলা পঞ্জিকা সংস্করণ করেন, এরপর ১৮৬৯ সালে আবারও এটি সংস্কার হয়। পরে সেটা মুদ্রিত আকারে প্রকাশ হয়। এরপর ১৮৯০ সালে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পঞ্জিকার প্রকাশ চলতে থাকে। ১৯৫২ সালে মেঘনাদ সাহাকে ভারত সরকার পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্ব দেন। তিনিই শকাব্দ (শকরাজ কর্তৃক প্রবর্তিত অব্দ বা বৎসর) সংস্কার করেন। সেই শকাব্দ অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল। মেঘনাদ সাহার এই সংস্কার বাংলাদেশেও ব্যাপক নাড়া দিয়েছিল। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি ড. শহীদুল্লাকে সভাপতি করে পঞ্জিকা সংস্কার শুরু করে। আগে বাংলা মাসগুলো ৩০, ৩১, ৩২ দিন ছিল। তারপর ঠিক হয়, প্রথম ৫ মাস ৩১ দিনের, বাকি ৭ মাস ৩০ দিনের হবে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে আবারো পঞ্জিকা সংস্কার হয়।
অন্যদিকে, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের মতে, মেঘনাদ সাহার সময়ই একবার পঞ্জিকা সংস্কার হয়েছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পরিবার থেকেই পঞ্জিকা সংকলিত হয়েছে। ঘটনাচক্রে যুগের সঙ্গে পঞ্জিকা দর্শন বা পঞ্জিকা বিচার আস্তে আস্তে ফুরিয়ে এসেছিল। সেই সঙ্গে ৬৭ সালে বামপন্থা যুগ মিলেমিশে গিয়েছিল। এ বিবর্তনের ফলে বিয়ে-শাদি বা পূজার দিনক্ষণ নির্ধারণে শুধু পঞ্জিকা দেখা হতো। দু’দেশের বর্ষবরণ বিভাজন সম্পর্কে তিনি বলেন, বিভাজন শুধু কাঁটাতারের নয়। বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য বইটিতে আহমেদ শরীফ সাহেব বলেছেন, এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ অর্থে মধ্য ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হয়নি। কারণ মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্য নিয়ে যথেষ্ট জিজ্ঞাসু হননি কলকাতার লেখকরা। ফলে বিভাজনটা রয়ে গেছে চেতনাতেও।
সেই আকবরী জামানা থেকে বর্ষবিচার শুরু হওয়ায় আর্থিক যোগ ছিল প্রথম থেকেই। ধর্মের যোগ আসেনি। কলকাতায় হালখাতা উদযাপন করা হয়। দোকানিরা খেরোর খাতা নিয়ে গিয়ে কালীঘাটে পূজা দেয়। অর্থভাগ্য ভালো হওয়ার জন্য আবার মন্দিরে যাওয়া শুরু হলো। পহেলা বৈশাখে কোনো হিন্দুয়ানিও নেই, আবার ইসলামি সংস্পর্শও নেই। এটি বঙ্গীয় সংস্কৃতি। তবে কলকাতার বইপাড়ায় আগে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হতো বই ও পত্রিকা প্রকাশ করে, এখন সেটা আয়েসি ও একঘেঁয়ে ভোগীচেহারা হয়ে গেছে। অনেকটা ক্যালেন্ডার উদযাপন বলা যেতে পারে। সে তুলনায় বাংলাদেশে বর্ষবরণের চেহারা অনেকটাই আলাদা তাতে সন্দেহ নেই। তবে বলতে হবে এই বিতর্ক থাকবেই। চলতে থাকবে ১৪ এপ্রিল ও ১৫ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপন।